চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

ভাবনায় ‘বেস্ট সেলার’ বুক

৫০ বছরে বাংলাদেশের যা কিছু অর্জন, সেটির মধ্যে অন্যতম বৃহত্তম অর্জন অমর একুশে গ্রন্থমেলা। প্রতি বছর ১ ফেব্রুয়ারিতে এই বইমেলা শুরু হয় এবং গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয় জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের, যারা ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে শহীদ হয়েছিলেন বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষে। এই বইমেলা সময়ের পরিক্রমায় অনেক বিস্তৃত হয়েছে। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গন থেকে ছড়িয়েছে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে, আয়োজন করা হচ্ছে জেলা শহরে। বিভিন্ন পরিক্রমায় বইমেলা তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশীয় লেখকদের লেখা পাঠকদের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্যও বইমেলার গুরুত্ব সর্বাধিক। বইমেলার মাধ্যমে বইয়ের বাজারের সম্প্রসারণ হয়েছে। বইমেলাকে ঘিরে প্রকাশকদের একটা বাড়তি উচ্ছ্বাস থাকে ব্যবসায়। মানুষের একটা সহজাত প্রবৃত্তি হল, অন্যরা তার কথা শুনুক এবং তার জানুক। এই বইমেলা মানুষের কথা জানার এবং জানানোর সুযোগ করে দিয়েছে লেখনীর মাধ্যমে। মানুষের গবেষণামনস্ক চিন্তাভাবনার ফল তাদের লেখনীতে প্রকাশ পাচ্ছে। বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখবেন এটাই তো স্বাভাবিক। একজনের বিষয়ের সাথে আর একজনের বিষয়ের মিল থাকতেও পারে , আবার নাও থাকতে পারে। কিন্তু, প্রতিটি লেখাই স্ব স্ব ব্যক্তির জায়গা থেকে গুরুত্বপূর্ণ।

২০২১ সালের করোনার ভয়াবহতার কারণে বিশেষ সিদ্ধান্তে মেলার কার্যক্রম ফেব্রুয়ারির পরিবর্তে মার্চে শুরু হয়। তবে বাংলা একাডেমির অন্যান্য ধারাবাহিক কার্যক্রম আগের ন্যায় চলমান ছিল।

যাহোক, একটি বিষয় নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে তোলপাড় হচ্ছে ‘ সর্বাধিক বিক্রিত (বেস্ট সেলার)’ বই। হ্যাঁ, এটা দাবি করা যেতেই পারে, তবে এই দাবি অমর একুশে গ্রন্থমেলার প্রেক্ষাপটে অবান্তর। সর্বাধিক বিক্রিত (বেস্ট সেলার) বই এবং সর্বাধিক মানসম্পন্ন বই এক নয়। এক কথায়, যে সমস্ত লেখনি যুগের পর যুগ টিকে থাকে, তাদের লেখনিটাই হয়ে ওঠে কালজয়ী। এই কালজয়ী লেখনিকে মানুষ খুঁজে ফেরে নিজের প্রয়োজনে, গবেষণার প্রয়োজনে আত্মতৃপ্তির প্রয়োজনে। এখন আসি বেস্টসেলার বিষয়টিতে। মানুষের আগ্রহের বিষয়টি বিবেচনা করে সর্বাধিক ক্রয়ের মাত্রায় নির্ধারিত হয় এই উপমাটি। এই বিষয়টি নিয়ে অনেক সমালোচনাও রয়েছে। ধরুন- শুধুমাত্র রাজনৈতিক পদে অধিষ্ঠিত থাকার কারণে জীবনে লেখা প্রথম বইও বেস্ট সেলার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে । এই বিষয়টি এভাবে বললাম, সেই বইগুলো সাদা চোখে দেখা কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। তার পরবর্তীতে আর কোন লেখনি আমরা পাইনি। হয়ত, অদূর ভবিষ্যতে পাবো কিংবা পাবো না!

সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের বিষয়টি দিয়ে সামাজিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করা যায়। মনে করুন, একটি বইমেলায় কোন উপন্যাস, গল্প, গোয়েন্দাধর্মী, আত্মজীবনীমূলক সব বিভিন্ন ক্যাটাগরির পরিবর্তে একটি বিদেশি ভাষা শিক্ষণের বই বেশি বিক্রিত হচ্ছে। এটির মাধ্যমে এটাই স্পষ্ট যে, ঐ ভাষাটির গুরুত্ব একটা শ্রেণির মধ্যে গুরুত্ব পাচ্ছে। এর পিছনে বহুবিধ কারণ হতে পারে, এই যেমন- চাকরির প্রত্যাশা, বিদেশি স্কলারশিপ এমনকি এটাও হতে পারে, নিজের প্রয়োজনে ঐ ভাষাভাষি মানুষের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য। কেন এই প্রবণতা , তা নিয়ে হতে পারে বিস্তর গবেষণা। গবেষণার সুবিধার্থে বিভিন্ন বয়সের ভিত্তিতে লৈঙ্গিক পরিচয়কে বিক্রিত তালিকায় সংরক্ষণ করার প্রয়োজন রয়েছে। তবে, ব্যক্তি পরিচয় প্রকাশের ঘোর বিরোধিতা করছি কারণ, এতে ব্যক্তি অধিকার খুন্ন হতে পারে।

সময়ের প্রয়োজনে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়। একটা সময় বইমেলাকে মৌলবাদি গোষ্ঠী নাস্তিকদের আড্ডারস্থল বলে বিষোদ্গার করলেও তাদের কথাকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমান করে বিভিন্ন ধর্মীয় বিষয়ের বইও জায়গা করে নিচ্ছে। এটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ।

পূর্বের কথায় আশা যাক, যেমন সর্বাধিক বিক্রিত বই নিঃসন্দেহে পাঠককে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে বলেই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তবে এর ফলে যদি সৃজনশীল চিন্তা ও মননের ক্ষতি হয়, তা জাতির জন্য অশনিসংকেত।

আসুন ভালো বই কিনি, বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলি। ভালো বই লেখায় উৎসাহ দিয়ে সৃজনশীল সমাজ বিনির্মাণে সহায়ক ভূমিকা পালনে উৎসায়িত করি।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)