মানুষের জীবন একটা পিরামিডের মতো। আমাদের জন্ম যখন হয় তখন আমরা (শৈশবে) থাকি পিরামিডের নীচের অংশে। শৈশবে আমাদের অধিক্ষেত্রের সব কিছু থাকা চাই নিজেদের দখলে। মানে আমাদের জীবনের আঙ্গিনায় যা থাকে তার কোনো কিছুতেই আমরা ছাড় দিতে চাই না। সেই সময় আমাদের নেওয়ার বা পাওয়ার চাহিদা থাকে খুব বেশি। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষের চিন্তা–চেতনা, দৃষ্টিভঙ্গি, রুচি, কাজের স্টাইল, প্রত্যাশা সব পাল্টে যায়।
একটা উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা বুঝানোর চেষ্টা করতে পারি। পিরামিডের বেইজটা অনেক বড় আর উপরের দিকটা আস্তে আস্তে সরু হয়ে যায় ভরাটপাথরের। এই ভরাট অংশ মানে আমাদের চরিত্রে নেওয়ার বা পাওয়ার প্রবণতা। বয়স বাড়ার সাথে সাথে পিরামিড যেমন সরু হয় ঠিক তেমনি আমাদের নেবার প্রবণতা কমতে থাকে আর দেবার প্রবণতা বাড়তে থাকে। এর মানে এই দাঁড়ায় যে বয়স বাড়ার সাথে সাথে সব শ্রেণির মানুষের মাঝেই ভোগের মাত্রা কমে আর ত্যাগের মাত্রা বাড়ে।
পত্রিকার খবরে দেখা গেছে যে, ‘শেপিং দ্য ফিউচার: হাউ চেঞ্জিং ডেমোগ্রাফিকস ক্যান পাওয়ার হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এই অঞ্চলের ৪৫টি দেশের জনসংখ্যাভিত্তিক তথ্য, পরিবর্তনের ধরন এবং করণীয় সম্পর্কে বিশদ বর্ণনা করা হয়েছে। প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে কর্মক্ষম জনসংখ্যা (১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী) ১০ কোটি ৫৬ লাখ। অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ৬৬ শতাংশই কর্মক্ষম। আগামী ১৫ বছরে, অর্থাৎ ২০৩০ সালে কর্মক্ষম জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ১২ কোটি ৯৮ লাখে, যা মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ। দেশে বয়স্ক বা ৬০ বছরের বেশি বয়সী মানুষ ৭ শতাংশ। ২০৩০ ও ২০৫০ সালে তা বেড়ে দাঁড়াবে যথাক্রমে ১২ ও ২২ শতাংশে। এই জনসংখ্যার পুরোটাই কোনো না কোনো কাজে দক্ষ। তারা কিন্তু আমাদের দেশের সম্পদ হয়েও প্রায় অব্যবহৃত আছে বা থাকবে। দেশের না, নিজের ভালোর জন্যেই আমাদের এই বিপুল দক্ষ কিন্তু কর্মক্ষম মানুষকে কাজে লাগাতে পারলে দেশের যে উন্নতি হবে তা হবে।
আমাদের অনেকেই আমরা আমাদের দেশের কোনটা সম্পদ আর কোনটা আবর্জনা বা অদরকারী জিনিস তা নিরপণে ভুল করি উপযুক্ত জ্ঞানের অভাবে। বাংলাদেশে গ্রামীণফোন তার অপারেশন শুরুর আগে কি আমরা জানতাম যে রেলওয়ের অপ্টিক্যাল ফাইবার দিয়ে রাতারাতি এতবড় মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক চালানো যায়! এটার ব্যবহার আছে বহুমূখী! জবাব হচ্ছে, জানতাম না। বাংলাদেশে রেলওয়ের অপ্টিক্যাল ফাইবার এর মতো যত অপ্টিক্যাল ফাইবার ছিল সব এখন আমাদের সম্পদ, আমরা চিনে গেছি বলে।
আমার গ্রামের বাসার পাশের রাস্তা, নদী, পাহাড়, জঙ্গল, বাজার যে আমাদের সামাজিক সম্পদ তা আমরা অনেকেই বুঝি না। দেশে বয়স্ক বা ৬০ বছরের বেশি বয়সী মানুষ ৭ শতাংশ। এরা দেশের সম্পদ হবার পরেও শুধুমাত্র না চেনা আর তাদের ব্যবহারের সঠিক পরিকল্পনার অভাবে দেশ এদের কাজে লাগাতে পারছে না, পড়ে আছে পুরাতন রেল লাইনের অপ্টিক্যাক ফাইবারের মতো। না চেনার কারণে এই দক্ষ জনসম্পদ নষ্ট হচ্ছে।
খবরে বলা হয়েছে যে, ২০৩০ ও ২০৫০ সালে কর্মক্ষম ৬০ বছরের বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে যথাক্রমে ১২ ও ২২ শতাংশে। এদের কাজে লাগাতেই হবে। তা না হলে দেশ এগুবে না। উন্নত দেশের সবাই এটা করে। আমরা যদি বাংলাদেশে বাস্তবায়নাধীন দেশী–বিদেশী উন্নয়ন প্রকল্প দেখি, তাহলে সেখানে দেখা যায় যায় যে, ৮০+ বছর বয়সী অনেক মানুষ খুব দক্ষতার সাথে কাজ করে চলেছেন। তাদের আছে বিস্তর অভিজ্ঞতা, যা বাজারে কিনতে পাওয়া যায় না। আমার বাংলাদেশের ৪৯ শতাংশ মানুষের বয়স ২৪ বছর বা তার নিচে। তার অনেকেই খুব যোগ্য কিন্তু অভিজ্ঞতা নেই। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের বা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের শিক্ষাব্যবস্থায়ও কিছু ঘাটতি আছে অনেকের। আবার অনেকেই আছে খুব মেধাবী। এই ঘাটতি পূরণেও বয়স্ক অভিজ্ঞদের ব্যবহার করতে পারি। তাদের অভিজ্ঞতা সঞ্চারিত করতে পারি নতুনদের মাঝে, খুব কম খরচে। দক্ষ জনশক্তির এ সম্পদ নষ্ট করা কি ঠিক হচ্ছে আমাদের এই সীমিত সম্পদের বাংলাদেশে!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)