যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে,
সব সংগীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই চরণ বুকের মধ্যে গুঞ্জরণ তুলছিল। প্রেক্ষাপটটা তখন এমনই ছিল। আসি আসি করছে সন্ধ্যা। যদিও সংগীত কিন্তু তখনও থেমে যায় নি। বরং ভিন্ন ভিন্ন সুরের আলাপনে পরিবেশটা হয়ে ওঠে মাধুর্যময়। দূর থেকে ভেসে আসছে পাখিদের কলকাকলি। নদীর মৃদু সুরধুনীধারা। মানুষের কলরোল। ব্রহ্মপুত্র নদের মধ্যিখানে শম্বুকগতিতে বয়ে চলেছে আমাদের নৌকা। কোথাও যাবার কোনো তাড়া নেই। সময়টাকে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করাটাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। দেখছিলাম চারপাশের নৈসর্গিক সৌন্দর্য। চলমান স্বচ্ছ পানি। আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। পাখিদের ক্লান্ত উড়াউড়ি। নদীতে পর্যটনশীল পালতোলা নৌকা। দুই পাশে সবুজের সমারোহ। ভ্রমণপিয়াসীদের ছোটাছুটি। কেউ কাশবনের খোঁজে। কেউবা ক্যামেরায় প্রিয় কোনো মুহুর্ত বা মনের রাখার মতো ফ্রেমের সন্ধানে। নদীর তীরে কত রকম কারুকাজ। প্রকৃতি নামক কুম্ভকার যেন সাজিয়ে দিয়েছে মাটির তৈরি তৈজসপত্র। মাটির আস্তরণ দেখে বোঝা যায়, পলি জমে জমে গড়ে ওঠেছে এই ভূখণ্ড। একটুখানি ভিতরেই গ্রামীণ পরিবেশ। প্রকৃতির অবারিত সান্নিধ্য। উড়ছে প্রজাপতি।
একটু একটু করে নিভে আসছিল আলো। নদীর পানিতে নানান রঙের খেলা। পরিবেশটা হয়ে ওঠে মায়াবী। আলো-আঁধারিতে হঠাৎ ভেসে আসে নারী কণ্ঠে সুরেলা আওয়াজ। নদীর এই নির্জনতায় নিজকে উজাড় করে দিয়ে কে গায় এমন গান? সুরটা খুব পরিচিত মনে হচ্ছিল। গানের কলিগুলো ধরি ধরি করেও ধরা যাচ্ছিল না। ঢেউ হয়ে দুলছিল। কানটাকে অনেক বেশি সজাগ করেও নাগাল পাওয়া যাচ্ছিল না। গানটা একটু একটু দূরে সরে যেতে থাকে। শিল্পীকে এক পলক দেখার জন্য মনটা আকুলি-ব্যাকুলি করলেও ইচ্ছেটা অপূর্ণ রয়ে যায়। অপূর্ণ ইচ্ছে নিয়ে ফিরতে হয় নদীতটে।
কূলে ফিরে আসার পর সে এক অভাবিত দৃশ্য। জোছনায় প্লাবিত চারপাশ। কেমন মোহময় হয়ে ওঠেছে নদী, নদীর তীর আর জয়নুল উদ্যান। উদ্যানের বড় বড় গাছের ফাঁক দিয়ে ঝরছে আলোর বৃষ্টি। সেই বৃষ্টিতে ভিজতে থাকেন বিনোদনপিয়াসীরা। কেউ চাতালে বসে, কেউ ঘাসে শুয়ে স্নাত হচ্ছিলেন জোছনায়। জোছনাগ্রস্ত হওয়ার চমৎকার একটি পরিবেশ। সঙ্গে মাতাল সমীরণ। আর গাছের ফাঁকে ফাঁকে নাচতে থাকে জোনাকি।
ময়মনসিংহ শহরটা মনটাকে বেশ রাঙিয়ে দিয়েছে। শহরের রূপ আগের তুলনায় বেশ খোলতাই হয়েছে। বদলে গেছে দেশের অন্যতম পুরানো শহরটি। শহরে ঢুকলেই পরিবর্তনটা ভালোই চোখে পড়ে। শহরটিকে সাজিয়ে তোলার জন্য একটা সযত্ন প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে মোড়ে নান্দনিক স্থাপত্য। তাতে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সময়ের নানান বিষয় স্থান করে নিয়েছে। ভাস্কর্যগুলো সহজেই দৃষ্টি কেড়ে নেয়। এমনিতেই এই শহরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতির সুখ্যাতি রয়েছে। এক তসলিমা নাসরিনই তো কাঁপিয়ে দিয়েছেন পুরো দুনিয়া। শহরের বেশ কিছু স্থাপনাও মন কেড়ে নেয়। তাতে অনুুধাবন করা যায় পুরনো সময়কে। মনটা নস্টালজিক হয়ে ওঠে।
শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত শশী লজ অর্থাৎ একসময়ের মহারাজ শশীকান্ত আচার্যের বাগানবাড়িটি আকৃষ্ট না করে পারে না। ৯ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত শতাধিক বছরের পুরানো এই বাড়িটি এখন তার আভিজাত্য ও জৌলুশ একটুও হারায় নি। বাড়িটি দেখলেই মনে হবে, এটি কোনো রাজা বা জমিদারের বাড়ি। মূল ফটকে আছে ১৬টি গম্বুজ। ভবনের সামনে রয়েছে বাগান। তাতে শোভা পাচ্ছে ফুল ও দুর্লভ সব গাছ-গাছালি। বাগানের অন্যতম আকর্ষণ শ্বেতপাথরের ফোয়ারা। তার মাঝে আছে গ্রিক দেবী ভেনাসের স্বল্পবসনা স্নানরতা মর্মর মূর্তি। এটি যেন ইউরোপীয় ঘরানার কোনো ভাস্কর্য। বুকের মধ্যে ছড়িয়ে দেয় সৌন্দর্যের আবেশ। কড়া রোদ মাথায় নিয়ে যখন ভবনটিতে যাই, তখন কেউ আপ্যায়িত করার জন্য উপস্থিত ছিলেন না। যে কারণে বাড়ির একদম ভিতরেও প্রবেশাধিকার ছিল না। বোধকরি মূল ভবনে সর্বজনকে এখন ঢুকতে দেওয়া হয় না। শশী লজ অবশ্য দীর্ঘ দিন মহিলা শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাইরে থেকে বাড়িটাকে যতটা দেখা যায়, ততটাই অবলোকন করি। তাতেই মুগ্ধ হয়ে যাই। অচিরেই এটি দর্শনীর বিনিময়ে উম্মুক্ত করা হবে বলে জানা যায়।
ময়মনসিংহের সার্কিট হাউজ এলাকাটি বেশ জমজমাট। পুরো এলাকায় আছে বনেদিয়ানার ছোঁয়া। দেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী ও পুরানো দুই ক্লাব ময়মনসিংহ মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব ও পন্ডিতপাড়া ক্লাব সহ বিভিন্ন ক্লাবের অবস্থান সার্কিট হাউজ মাঠের লাগোয়া। এ এলাকাটিকে অভিহিত করা হয় ক্রীড়া পল্লী হিসেবে। এই মাঠ থেকেই ওঠে এসেছেন জাতীয় পর্যায়ের অনেক নামজাদা ক্রীড়াবিদ। উপমহাদেশের অন্যতম সেরা ফুটবলার অভিলাষ ঘোষ, নগেন দে, রাখাল মজুমদার, পাখী সেন, মোশাররফ হোসেন কালা, রজব আলী, অহি গুহ রায়, জ্যোতিষ কর, জগজীবন দত্ত, গণেশ ঘোষ, পরেশ মুখার্জি, নিধু মজুমদার, খালিক, দেবীনাশ, হালিম, কিবরিয়া বাবুল, মিলু প্রমুখ ক্রিকেটার রামচাঁদ গোয়ালা, বেলায়েত হোসেন বেলাল, আজহার হোসেন, অলোক চক্রবর্তী, হারুনুর রশিদ লিটন, সাইফুল ইসলাম, মাহববুল আলম সেলিম, শরীফুল হক প্লাবন, সানোয়ার হোসেন, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, শুভাগত হোম প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
সাহেব কোয়ার্টারের দৃষ্টিনন্দন পার্কটি এখন শহরের প্রধান আকর্ষণ। ব্রহ্মপুত্র নদের তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা এই পার্কটি হয়ে ওঠেছে বিনোদনের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। সাম্প্রতিক সময়ে পার্কটিকে নতুনভাবে সাজানো হয়েছে। এর নামকরণ করা হয়েছে ‘শিল্পাচার্য জয়নুল উদ্যান’। কত যে গাছগাছালি। বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। তাতে আছে ফল গাছ। ঔষধি গাছ। জানা-অজানা রকমারি গাছ।
পার্কে চা-নাস্তা, চটপটি, ঝালমুড়ি সহ আছে হরেক খাবারের আয়োজন। নদীর তীরটি ব্লক দিয়ে বাঁধাই করা। তীর বেয়ে চলে গেছে সিমেন্টের দীর্ঘ হাঁটা পথ। সেই পথ বেয়ে অনেকটা পথ চলে যাওয়া যায়। পার্কে আয়োজন করা হয় পহেলা বৈশাখ সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান। নদীর তীর দিয়ে যাওয়ার সময় দেখতে পাওয়া যায়, গড়ে তোলা হয়েছে ‘বিপিন পার্ক’। পার্কটি বেশ আধুনিক। নির্মিত এই পার্কটির নামকরণ করা হয়েছে ময়মনসিংহ পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান বিপিন সেনের নামে। এই পার্কটিও সারাদিনমান মুখরিত থাকে।
পুরানো ব্রহ্মপুত্রের নদের তীরে চার দশকের বেশি সময় আগে গড়ে তোলা হয় শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা। গড়ে তোলার সময় জীবিত ছিলেন খ্যাতিমান এই চিত্রশিল্পী। এটি প্রতিষ্ঠা ছিল তাঁর অন্যতম একটি স্বপ্ন। তিনি ছিলেন বৃহত্তর ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জের সন্তান। ব্রিটিশ আমলে গড়ে তোলা একটি দোতলা বাসভবনে গড়ে ওঠেছে এই সংগ্রহশালা। ছায়াবীথির মাঝে সংগ্রহশালাটি শিল্পরসিকদের প্রলুব্ধ করে থাকে। এখানে সংরক্ষিত আছে শিল্পীর উল্লেখযোগ্য শিল্পকর্ম।
শহরের কেন্দ্রে গাঙ্গিনারপাড় মোড়ের শাপলা স্কোয়ারটি সদা ব্যতিব্যস্ত থাকে। একই সারিতে প্রেস ক্লাব, বইয়ের দোকান, কফি হাউজ, ‘সারিন্দা’র মতো পশ খাবারের দোকান সহ কেনাকাটার জন্য এলাকাটি সারাক্ষণই জমজমাট। স্টেশন রোডের ‘কৃষ্ণা কেবিন’-এর মিষ্টির বেশ কদর আছে।
চলার পথে অনেকের সঙ্গে কথায় কথায় জানা যায়, ময়মনসিংহ শহরটির সৌন্দর্য ও শোভা বর্ধনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন তরুণ মেয়র মো. ইকরামুল হক টিটু। এ ক্ষেত্রে তিনি এগিয়ে চলেছেন মহাপরিকল্পনা নিয়ে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় একপাক ঘুরে না আসলে ময়মনসিংহ শহরটি অসম্পন্ন রয়ে যায়। বিশাল এই চত্বরটি কৃষি শিক্ষার পূর্ণাঙ্গ একটি প্যাকেজ। এটিকে বলা যেতে পারে আধুনিক একটি গ্রাম। কী নেই? পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ব্রহ্মপুত্র নদ। আছে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য। আছে সবুজের বিস্তৃত অরণ্য। ফল-ফুল-গাছগাছালি-শাকসব্জি-মাছের পুকুর-ফসলের জমি। এসব নিয়ে চলছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। আছে পাখির কলতান। এমনকি দেখা যায় বকও। রাতের বেলা বিশ্ববিদ্যালয়টি যে নিঝুম গ্রাম হয়ে যায়, সেটা অনুমান করা যায়। আছে রোমান্টিক নির্জনতা, যেখানে শহীদ কাদরীর কবিতার মতো ‘প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে’। তবে হেঁটে হেঁটে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়টি একদিনে পরিদর্শন করা সহজ কাজ নয়। সেক্ষেত্রে একটি অটোরিক্সা একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্ত ছুটিয়ে নিতে পারে। সেটি হতে পারে আনন্দময় এক ভ্রমণ।
ঢাকা থেকে ময়মনসিংহের দূরত্ব খুব বেশি নয়। যাঁরা নতুনত্ব ও বৈচিত্র্যপিয়াসী তাঁরা চাইলেই চট করে শহরটিতে ঘুরে আসতে পারেন। যতটা শুনেছি, সেই সত্তর দশকের শেষদিকে তো কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ঢাকা থেকে গিয়ে প্রেম করতেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ছাত্রী তসলিমা নাসরিনের সঙ্গে। অনুরূপভাবে তসলিমাও রুদ্র’র সঙ্গে দেখা করার জন্য ছুটে আসতেন ঢাকায়। আর এখন তো অনেক উন্নতি ঘটেছে যোগাযোগ ব্যবস্থার। যাতায়াতে খুব বেশি সময়ও লাগে না। সকালে গিয়ে সারাদিন ঘোরাঘুরি করে বিকেলেই ফিরে আসা যায়। বেড়ানোটা নেহাত মন্দ হবে না। ব্রহ্মপুত্র নদকে কেন্দ্র করে যেভাবে চিত্ত-বিনোদন কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে, তা দেখে একরাশ আক্ষেপও হয়। আমরা আমাদের প্রধান একটি সম্পদ বুড়িগঙ্গা নদীটিকে ক্রমান্বয়ে রীতিমতো হত্যা করে চলেছি। অথচ এই নদীটিকে ঘিরে কত কিছুই না করা সম্ভব। এটি হতে পারে ঢাকা শহরের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র। ময়মনসিংহ যদি পারে, তাহলে রাজধানী হয়েও ঢাকা কেন পারবে না? ময়মনসিংহ ঘুরে আসার পর এ প্রশ্নটি মাথার মধ্যে অহর্নিশ ঘুরপাক খাচ্ছে।