ক সঞ্চয়ের ওপর আবগারি (একসাইস) আরোপ প্রথাগত ধারণার পরিপন্থী বলে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন। চ্যানেল আই অনলাইনকে তারা বলেছেন, সাধারণত মদের মতো কোন পণ্য বা সেবা সম্পর্কে নিরুৎসাহী করতে বা দুষ্প্রাপ্য পণ্যের ব্যবহার কমাতে আবগারি আরোপ করা হয়। ব্যাংক সঞ্চয়ের ওপর আবগারি আরোপ করা হলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি সঞ্চয়ীদের প্রতি একটা রং সিগনাল (ভুল বার্তা) দেওয়া হবে। এতে তারা বিরক্ত হবেন এবং সঞ্চয়ে নিরুৎসাহী হবেন।
সরকারের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা উচিৎ বলে মনে করছেন তারা।
বেসরকারি আইএফআইসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহ এ সরোয়ার চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: মূলধনের ওপর সুদ কম-বেশি দিলে তাতে কেউ কিছু মনে করে বা কেউ করে না। কিন্তু মূলধনে হাত দিলে আমানতকারী খুবই বিরক্ত হয়।
আরেক বেসরকারি ব্যাংক যমুনা ব্যাংকের ব্যাপস্থাপনা পরিচালক শকিকুল আলম চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: বিরাট জনগোষ্ঠীকে আমরা ব্যাংকিং খাতে নিয়ে আসার চেষ্টা করছি। কিন্তু তাদের ওপর যদি আমরা বাড়তি চার্জ আরোপ করি তাহলে তো তাদের আর সে উৎসাহটা থাকবে না। এ ধরনের আবগারি আরোপের ফলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি সঞ্চয়ীদের প্রতি এক ধরনের ভুল বার্তা দেওয়া হবে এবং তারা নিরুৎসাহী হবেন।
ব্যাংকের সঞ্চয়ী হিসাবের ওপর এ ধরনের আবগারি আরোপের ফলে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন বেসরকারি ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম আর এফ হুসেইন।
চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন: এ ধরনের আবগারি আরোপে ইতিবাচক (পজিটিভ) কিছু দেখছি না। এর ফলে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে হচ্ছে।
তবে বিষয়টি সম্পর্কে আরও ভালোভাবে না জেনে এ বিষয় নিয়ে বেশি কিছু বলতে চাননি এই কর্মকর্তা।
ব্যাংকিং খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংকগুলোতে সুদের হার এমনিতেই কম। সঞ্চয়ী হিসাবের ক্ষেত্রে সেটা আরও কম। ফলে কেউ ব্যাংক হিসাবে টাকা সঞ্চয় করলে প্রাপ্ত সুদের বিপরীতে বিভিন্ন আয়কর এবং আবগারি কেটে নিলে গচ্ছিত মূল টাকায় মুনাফার চেয়ে কমে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে।
এ বিষয়ে আইএফআইসি এবং যমুনা ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীরা একই সুরে বলেন: কোন আমানতকারী যদি ব্যাংকে ১ লাখ টাকা রাখেন তবে যে টাকা সুদ পাবেন এবং যে টাকা কেটে রাখা হবে তার যোগ বিয়োগ করে আরও কিছু টাকা মূলধন থেকে কমে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।
শাহ এ সরোয়ার বলেন: ধরুন, মূলধন থেকে ২শ টাকা বা ৫শ টাকা গেল। টাকার অঙ্কে হয়তো এটা খুব বড় নয় বা কারও কারও কাছে বড়ও হতে পারে। কিন্তু মূল ব্যাপার হলো মানুষ এতে খুব বিরক্ত হয়। কারণ আমরা ব্যাংকাররা জানি, কারও মূলধনের ওপর হাত দিলে তিনি বিরক্ত হন।
ব্যাংক হিসাবধারীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সেখান থেকে সরকারের আয় এমনিতেই বেড়েছে। তারপরও এ ধরনের অবগারি আরোপকে একটু বাড়াবাড়ি বলে মনে করেন শকিকুল আলম।
তিনি বলেন: আমরা চাই বিশাল জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির (ফিনান্সিয়াল ইনক্লুশন) মধ্যে নিয়ে আসতে অর্থাৎ জনগণ যাতে ক্যাশ টাকা গচ্ছিত না রেখে ব্যাংকে জমা রাখে। আমাদের চেষ্টায় আমরা সফলও হচ্ছি। কারণ আগের চেয়ে অনেক বেশি ব্যাংক হিসাবে বেড়েছে। সেখান থেকে সরকারের আয়ও বেড়েছে। তারপরেও এ ধরনের আবগারি আরোপ একসেস (বাড়াবাড়ি) হবে।
এ ধরনের বাড়তি চার্জ ‘কাউন্টার প্রডাক্টিভ’ হবে বলেও মন্তব্য করেন যমুনা ব্যাংকের এ শীর্ষ কর্মকর্তা।
সরকারের এ সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
সঞ্চয়ের ওপর এ ধরনের আবগারি আরোপ না করে বিকল্প পথে সরকার আয় করতে পারতো উল্লেখ করে শাহ এ সারোয়ার বলেন: একজনের ইনকাম থেকে আপনি নাগরিকদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক অনুযায়ী একটি অংশ ট্যাক্স নিতে পারেন। কিন্তু আপনি কারও সঞ্চয় থেকে টাকা কেটে নেবেন এটা পৃথিবীব্যাপী যে প্রথাগত ধারণা তার পরিপন্থী। এটা ব্যাংকিং শিল্পে দেখা যায় না।
‘এই টাকাটা তারা ব্যাংকের সুদের ওপরে নিয়ে নিতে পারতো, অন্যান্য বিকল্প পন্থাও ছিলো। কিন্তু টাকাটা এভাবে নেওয়ার কোন দরকার আছে বলে আমি অন্তত মনে করি না। সমগ্র মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে এটি বিরক্তি উৎপাদন করবে।’
অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা এখনও ঠিক পরিষ্কার নয় উল্লেখ করে শীর্ষ এ ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন: বাজেট বক্তৃতায় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারের মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। বাজেট বক্তৃতায় বলা হয়েছে লেনদেনের কথা। অর্থাৎ আপনি এক লক্ষ টাকা জমা দিতে এলে আপনার থেকে আমি ৮০০ টাকা রেখে দেব। আবার এক লাখ টাকা তুলতে এলেও আপনার কাছ থেকে আমি ৮০০ টাকা রেখে দেব। এটা বাজেটের ভাষ্য অনুযায়ী মনে হচ্ছে।
‘কিন্তু গতবারও কিন্তু এই জিনিসটা ছিল। গতবার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আমাদের যে ধরনের নির্দেশনা এসেছিল সেটা হলো আপনার স্থিতির ওপরে, অর্থাৎ কখনও যদি আপনার স্থিতি ১ লাখ টাকা অতিক্রম করে তখন এটা চার্জ হওয়ার কথা। বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী কারও স্থিতি এক লাখ টাকা থাকলে সেখান থেকে ২০ হাজার টাকা খরচ করলে সেখান থেকে চার্জ করা হয়।
বৃহস্পতিবার বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘বছরের যে কোন সময় অ্যাকাউন্টে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত ডেবিট কিংবা ক্রেডিট হয় এমন অ্যাকাউন্টের ক্ষেত্রে তা পূর্বের ন্যায় আবগারি শুল্ক আরোপ করা হবে না। এখন এক লাখ টাকার অ্যাকাউন্টের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হবে।’
প্রস্তাব অনুযায়ী এক লাখ টাকা থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিদ্যমান ৫০০ টাকার পরিবর্তে ৮০০ টাকা আবগারি দিতে হবে। এ ছাড়া ১০ লাখ থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত দেড় হাজার টাকার পরিবর্তে আড়াই হাজার টাকা, এক কোটি থেকে পাঁচ কোটি পর্যন্ত সাড়ে সাত হাজার টাকার বদলে ১২ হাজার টাকা এবং পাঁচ কোটির ওপরে ১০ হাজার টাকার পরিবর্তে ২৫ হাজার টাকা আবগারি দিতে হবে।
এই আবগারি আরোপের ব্যাখ্যায় অর্থমন্ত্রী বলেন, সরকারের ‘ফিন্যানশিয়াল ইনক্লুশন অ্যাট অল লেভেলস’ নীতি ও দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের সামগ্রিক পরিস্থিতির উন্নতির ফলে ব্যাংকিং খাতে লেনদেনের আকার ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ বিবেচনায় রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে দি এক্সাইজ অ্যান্ড সল্ট অ্যাক্ট, ১৯৯৪-এর সংশোধন হিসেবে তিনি শুল্ক বৃদ্ধির প্রস্তাব দেন।
তবে এ আবগারি আরোপের ফলে মধ্যবিত্ত সমাজে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতার পর থেকেই সামাজিক মাধ্যমে তারা বিষয়টি নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা এবং আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।