রোববার (২৪ ফেব্রুয়ারি) বিকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত দুবাইগামী একটি যাত্রীবাহী বিমান ছিনতাই প্রচেষ্টার খবরটি ছিল ‘টক অব দ্যা কান্ট্রি’। আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির বদৌলতে অতিদ্রুত অনলাইন গণমাধ্যম, টেলিভিশন চ্যানেল ও ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে চাঞ্চল্যকর তথ্যটি ছড়িয়ে পড়ায় তা সকল মহলের আলোচনার শীর্ষে চলে আসে। শোনা গেলো, এক যুবক পিস্তল ও বোমা (অথবা বোমা সদৃশ) নিয়ে বিমানটি ছিনতাইয়ের চেষ্টা করেন এবং পাইলট ও ক্রুসহ বিমানের সবযাত্রীকে জিম্মি করে রেখেছেন।
খবরটি নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। গুলশানের হোলি আর্টিজান রেঁস্তোরায় জঙ্গি হামলায় জাতির ললাটে লেপটে যাওয়া কলঙ্কের তিলক এখনও মোছেনি। গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর চকবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মাত্র ২০ সেকেন্ডের (বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য মতে) ধ্বংসযজ্ঞে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে। তাই এর মাত্র চারদিনের মাথায় ১৪২ আরোহীসহ বিমান ছিনতাই প্রচেষ্টার খবর শুনে গোটা জাতি স্বাভাবিকভাবেই উৎকণ্ঠিত হয়ে ওঠে। সেই সঙ্গে বিস্তৃত হতে থাকে নানামুখী গুজবের ডালপালা।
এদিন বাংলাদেশ বিমানের ময়ূরপঙ্খী উড়োজাহাজটি ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিকেল ৫টা ৫ মিনিটে ছেড়ে চট্টগ্রাম হয়ে দুবাই যাওয়ার কথা ছিল। ঢাকা থেকে উড্ডয়নের পরই উড়োজাহাজটি ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে। তবে সন্ধ্যা ৭টা ২৪ মিনিটে চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মাত্র আট মিনিটের কমান্ডো অভিযানে উড়োজাহাজটিতে থাকা অস্ত্রধারী তরুণ নিহত হন। এর মধ্য দিয়ে প্রায় দুই ঘণ্টার টান টান উত্তেজনার পর উড়োজাহাজ ছিনতাই চেষ্টার অবসান ঘটে। বিমানে থাকা পাইলট, কো-পাইলট ও যাত্রী মিলিয়ে সকল আরোহী অক্ষত থাকায় সরকারসহ দেশবাসীও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।
তবে এতে জল্পনা-কল্পনা কিংবা গুজবের অবসান ঘটেনি; ঘটার কথাও নয়। বরং তা আরও বেড়ে গেলো। এর কারণ হলো- বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে যেকোনো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিকট অতীতের চেয়ে অনেক বেশি কঠোর। ঢাকার হযরত শাহজালালও এর বাইরে নয়। এদিন বাংলাদেশ বিমানের ময়ূরপঙ্খী উড়োজাহাজটি চট্টগ্রামের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়লেও এর সর্বশেষ গন্তব্য ছিল দুবাই, তাই উড়োজাহাজটি ছিল মূলত আন্তর্জাতিক রুটের। সুতরাং এর নিরাপত্তাও তুলনামূলক কঠোর ছিল। এ কারণে ছিনতাই চেষ্টার নিষ্পত্তি ঘটলেও এ নিয়ে জল্পনা-কল্পনার তাৎক্ষণিক অবসানের সুযোগ নেই।
গণমাধ্যমের খবর, ওসমান গণি (৩৫) নামে ওই বিমানের এক যাত্রী বলছেন, মাঝ আকাশে গুলিবর্ষণ করেছিলেন অস্ত্রধারী ওই যুবক। ওমান থেকে ঢাকায় নামার পর ওই বিমানে চট্টগ্রামে যাচ্ছিলেন কক্সবাজার জেলার পেকুয়ার বাসিন্দা এই ব্যক্তি। তিনি বলেন, “ওই ব্যক্তি পিস্তল নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে যাত্রীদের বলে, কেউ উঠে দাঁড়ালে বা নড়াচড়া করলে গুলি করা হবে। এ সময় যাত্রীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। ওই ব্যক্তি কয়েক রাউন্ড গুলিও ছোড়ে।” (সূত্র: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, তারিখ: ২৪.০২.২০১৯ ইং)। তবে কমান্ডো বাহিনীর অভিযান শেষ হওয়ার ঘন্টাখানেক পর চট্টগ্রামের পুলিশ কমিশনার জানিয়েছিলেন, ছিনতাইকারীর কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া পিস্তলটি ফেক (খেলনা পিস্তল)। তবে যুবকটির আসল পরিচয় তখনও নিশ্চিত করতে পারেনি কোনো সংস্থা।
আজ (সোমবার) বিভিন্ন গণমাধ্যমের অনলাইন ভার্সনে ওই যুবকের পরিচয় প্রকাশ হয়। এর আগে অবশ্য গণমাধ্যম কর্মীদের ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে তার পরিচয় জানায় র্যাব। তার নাম আহমেদ পলাশ, বাড়ি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার ফিরোজপুর ইউনিয়নের দুধঘাটা গ্রামের পিয়ার জাহানের ছেলে। আসলে এই যুবক ব্যর্থ প্রেমিক বা প্রেম প্রত্যাখ্যাত নন; তিনি রীতিমতো দু’টো বিয়ে করেছিলেন। প্রথমে মেগলা নামের এক যুবতীকে এবং তার সঙ্গে বিচ্ছেদের পর গত বছর নায়িকা সিমলাকে বিয়ে করেন পলাশ। (সূত্র: সমকাল অনলাইন, ২৫ ফেব্রুয়ারি)। যতোদূর জানা গেছে, প্রথম স্ত্রীর মতো দ্বিতীয় স্ত্রীও তাকে তালাক দিয়েছেন। এই অর্থে তিনি ব্যর্থ প্রেমিক নন; বিরহ-যন্ত্রণা কাতর।
আজ (সোমবার) বিমানবন্দরে বেসামরিক বিমান পরিবহন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী সাংবাদিকদের বলেছেন, বিমানবন্দরে যে তল্লাশি ব্যবস্থা, তাতে অস্ত্র নিয়ে উড়োজাহাজে যাওয়া সম্ভব নয়। এ সময় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম নাইম হাসান সাংবাদিকদের বলেন, তিনটা শব্দ হয়েছে। যাত্রী ও ক্রুদের জিজ্ঞেস করেছি। তারা বলেছেন যে, ধোঁয়া বের হয়েছে। গুলি বের হলে এয়ারক্রাফটে ছিদ্র হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু এ ধরনের কোনো প্রমাণ পাইনি। খেলনা পিস্তল হলেও ঠুস ঠুস ঠুস শব্দ হয়। (সূত্র: প্রথম আলো অনলাইন, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯)।
এছাড়া চট্টগ্রামে অবতরণের পরপরই বিমানের সকল যাত্রী এবং পাইলট ও ক্রুরা সবাই অক্ষত অবস্থায় বেরিয়ে আসেন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থা বিমানটিকে ঘিরে ফেলে। তখন ছিনতাইকারী একাই ছিলেন বিমানে। সে ক্ষেত্রে অভিযান দীর্ঘায়িত হলে তাকে হয়তো জীবিতাবস্থায় আটক করা সম্ভব হতে পারতো। হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার ঘটনায় কিন্তু রাত শেষে পরেরদিন ভোরে চালানো হয়েছিল কমান্ডো অভিযান। কারণ সেখানে দেশি-বিদেশি বেশ কয়েকজন জিম্মি ছিলেন। যদিও রোববারের বিষয়টি এমন হতে পারে যে, ওই যুবকের উদ্ধত আচরণে মনে হয়েছে তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর গুলি ছুঁড়তে পারেন। এ কারণে দ্রুত অভিযান শেষ করা হয়েছে; যার পরিণতি ঘটনাস্থলেই কথিত ছিনতাইকারীর মৃত্যু। ফলে যুবকটির ব্যক্তিগত ইচ্ছা কিংবা মূল উদ্দেশ্য অজানাই রয়ে গেলো।
তবে ১৩২ জন যাত্রী ও পাইলট-ক্রু মিলিয়ে ১৪২ জন (ওই যুবকসহ) আরোহীর উপস্থিতিতে একটি মাত্র যুবক যে নেতিবাচক কাহিনী রচনা করলেন, তা মোটেও তুচ্ছতাচ্ছিল্যের নয়। তাকে পরাস্ত করতে শেষপর্যন্ত কমান্ডো অভিযানও পরিচালনা করতে হলো সেনাবাহিনী তথা সরকারকে। তাই নিজের মনেই একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে- বিরহ-যন্ত্রণা কাতর বখাটের খেলনা পিস্তলও কী ভয়ংকর?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)