বিদ্রোহী প্রার্থী ও দলীয় প্রার্থীর পরস্পর বিরোধী কর্মকাণ্ডে রাজনৈতিক দলগুলোর স্ববিরোধিতা প্রকাশ্য হয়ে উঠেছে। দেশ জুড়ে নির্বাচনী সহিংসতা, সংঘাত, খুনোখুনিও বেশীর ভাগ এই দুই পক্ষের মধ্যেই সংঘটিত হচ্ছে। বিশেষ করে সরকারী দল আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী বনাম দলীয় প্রার্থী আওয়ামী লীগ বনাম এমপির আওয়ামী লীগের নতুন সংযোজন। সংযোজন না বলে সেই পুরনো দ্বন্দ্বের ও গ্রুপিংয়ের সংহত ও সুদৃঢ়করণ বললেও ভুল বলা হবে না।
দেশ জুড়ে দলীয় প্রার্থী কারা হতে পেরেছে? যারা এমপির আশির্বাদপুষ্ট তারাই। এমপি ইউপি নির্বাচনে কোন প্রার্থীর পক্ষে প্রচার কাজে যেতে পারবেন না আবার প্রার্থী তিনিই ঠিক করে দেবেন। আগেকার দিনে সামন্ত জমিদাররা টাকা দিয়ে জমি কিনতো অথবা ক্ষমতা দিয়ে দখল করতো। কিন্তু জমি হাল চাষ করত না, হালচাষ দেখত না, এমন কি যারা হালচাষ করে জমিদার তাদের চিনত ও না, জানত ও না।
বর্তমানে এমপি মহোদয়দের ভূমিকা অনেকটা সেরকমই। মনোনয়ন বাণিজ্যের কথা উঠছে, সাদা কাগজে তৃণমূল নেতাদের সই নিয়ে এমপি কর্তৃক প্রার্থিতা মনোনয়নের কথা উঠছে। মনোনয়ন বাণিজ্যের ব্যাপারে মন্ত্রীরাও মুখ খুলছেন। তারাও স্বীকার করছেন যে মনোনয়ন বাণিজ্য হয়েছে। এও বলছেন, যেখানে যেখানে হয়েছে সেখানে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আসলে এগুলো হচ্ছে বলার জন্য বলা। যেখানে মনোনয়ন বাণিজ্য হয়েছে সেখানে বিদ্রোহী প্রার্থীরা নিশ্চয়ই এই অনৈতিক আচরণের প্রতিবাদ করেই বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধেওতো বহিস্কারের সিদ্ধান্ত নিল দল।
অন্যায়কারী ও অন্যায়ের প্রতিবাদকারী উভয়ের বিরুদ্ধেই সাংগঠনিক শাস্তির ঘোষণা কি ন্যায় সংগত? বাংলাদেশের রাজনীতিতে অর্থ ও ক্ষমতা যেন অন্যতম নিয়ামক হয়ে উঠছে। দলীয় নেতাকর্মি হতে শুরু করে আমলা ও সাধারণ জনগণও ক্ষমতা তোষণে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। ভীতি প্রদর্শন করে ও ক্ষমতা জাহির করে যে নির্বাচনে জয়লাভ করা যায় এটি এবারের ইউপি নির্বাচনে দৃশ্যমান হল।
অনেক জায়গায় সাধারণ মানুষ এরকম ভাবনাও ভেবেছে যে ক্ষমতাধর পক্ষের অনুকূলে না থাকলে নিরাপদে বসবাস করা যাবে না। বিপদে পড়লে তাকে ক্ষমতাধর লোকের কাছেই যেতে হবে। ক্ষমতার বাইরের লোকেরা তার ভালও করতে পারবে না, মন্দও করতে পারবে না।
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ভোটারদের মাঝে এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে যে সরকারি দলের দলীয় প্রার্থীকে ভোট না দিলে বিরোধী কিংবা বিদ্রোহী প্রার্থী পাশ করলে এলাকার উন্নয়ন হবে না। এবারের ইউপি নির্বাচন রাজনৈতিক দলের স্ববিরোধিতা ও ভোটারদের গণতান্ত্রিক মূল্যবাদ নষ্টের চিত্র সর্বসমক্ষে উন্মোচিত করল। কেন এই দলীয় প্রতীক ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ? আমরা বিগত জাতীয় নির্বাচনগুলোতে দেখেছি ১৪ দলীয় জোটের জোটীয় প্রতীক নৌকা। রাশেদ খান মেনন ও হাসানুল হক ইনুসহ কয়েকজন জোটীয় প্রতীকে নির্বাচিত হয়ে এসেছেন। আবার কেউ কেউ হাতুড়ি, মশাল নিয়েও নির্বাচিত হয়ে এসেছেন। হাতুড়ি ও মশাল নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়ায় তো তাদের জোট ও দল হতে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত হয়নি।
এতে করে ১৪ দলীয় জোটের জোটবদ্ধ ও দলবদ্ধ রাজনীতিরও কোন সমস্যা হয়নি। তবে ইউপি নির্বাচনে কেন বিদ্রোহী প্রার্থী বনাম দলীয় প্রার্থীর সৃষ্টি ও সাংগঠনিক স্ববিরোধী আচরণের প্রকাশ? দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচন মেজরিটি আসনে চেয়ারম্যান উপহার দিলেও এতে আওয়ামী লীগের সুফল না এনে কুফলই আনবে। এতে দলটির সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক ভূমিকার দৈন্যতা ও অবক্ষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সর্বস্তরের মানুষের কাছে। ভীতি প্রদর্শন ও ক্ষমতার মোহে ভোটারদের আকর্ষণ ও এইসবের প্রাধান্যভিত্তিক নির্বাচন গণতন্ত্রের জন্য সর্বনাশ ডেকে আনছে। আমরা যেন ক্রমশ গণতন্ত্রের অযোগ্য নাগরিকত্বের বৈশিষ্ট্যটি স্পষ্ট করে তুলছি। ভয় দেখিয়ে জনমত সৃষ্টির চেষ্টা চরম পন্থার বৈশিষ্ট্য।
মাওবাদী, আইএস, আলকায়েদা প্রভৃতি মানুষ হত্যার মাধ্যমে মানুষকে নিজেদের পক্ষে টানার চেষ্টা করছে। মাও সে তুঙ বলতেন, বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস। মাওবাদীরা একসময়ে শ্রেনী শত্রু খতমের নামে মানুষ হত্যা, ব্যাংক লুঠ প্রভৃতি করে বেড়াত। তারা নিজেরাই নিজেদের জনগণের বন্ধু ভাবতো আর জনগণ তাদের ডাকাত ভাবত। বাংলাদেশে এ ধারার রাজনীতি জনসমর্থন পায়নি। এর সাথে জড়িত এক সময়ের বাঘা বাঘা নেতা পরবর্তিতে সেই শ্রেণী শত্রুদের দলেই ভিড়ে গেছেন। ভীতি প্রদর্শন যে রাজনীতিতে কোন সুফল বয়ে আনে না এর বহু নজির রয়েছে।
জাসদের গণবাহিনী তত্ত্ব কী ফল এনে দিল জাসদকে ও দেশকে। এক জাসদ ভেঙ্গে কয় জাসদ হল? ভাঙ্গনের ধারাবাহিকতা এখনও চলমানই রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকাণ্ড জনগণ কিভাবে গ্রহণ করছে তা বুঝতে না পারা ও বুঝার চেষ্টা না করা শুভ বুদ্ধির পরিচয় নয়। মেজরিটি আসনে ইউপি চেয়ারম্যান সরকার দলীয় প্রার্থীরা জয়লাভ করছে ভেবে তৃপ্তির ঢেঁকুর ফেলার কারণ নেই। এই মেজরিটিই হয়তো মাইনরিটির ক্ষেত্র প্রস্তুতকারী হতে পারে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)