এ দেশ আমার। আমার বাবার। আমার ঠাকুরদার। এ দেশে আমি জন্মেছি। আমার বাবা জন্মেছে এ দেশে। আমার ঠাকুরদার জন্মও এই সবুজে নিকানো বাংলার কোলে। তার বাবা… ঠাকুরদা… সবাই। এ দেশ পেয়েছি আমি বংশপরম্পরায়।
এখানকার প্রতিটি ধূলিকণা আমার চেনা, আঁকাবাঁকা পায়ে চলা মেঠোপথ আমার চেনা। স্নান করার ঘাট আমার চেনা। বাজার চেনা। পথের ধারের আম, কাঁঠাল, নারকেল, সুপারি, কদম, কামিনী, তুলসী, শিউলি, বেলি সবই আমার চেনা। সকাল-সন্ধ্যার পাখির গান আমার চেনা।
আমার বাড়ির খাট, বিছানা, মা, বোন, ভাই, বাবা, রান্নাঘর, বালিশ, বাথরুম, যত্নে বসানো সরস্বতী, শিতলা, দুর্গা, লক্ষ্মী দেবীর মন্দির… সবই আমার চেনা। আমার বাড়ির পাশের গোলক, ভবেশ, হরিপদ, দুলাল, স্বপন, রিপন আমার চেনা। আরো চেনা রফিক, রুহুল, জাকির, মিরাজ, আলমগীর, জাহিদ, সিরাজ। সবাই পরিচিত। সবই পরিচিত। এই পরিচিত মুখগুলোর অনেকেই হঠাৎ হিংস্রতার মাতাল নেশায় টালমাটাল হয়ে যায়।
পশুত্বের ক্রোধে ম্লান হয়ে যায় বিবেক। উস্কানির ক্ষোভে আগুন লাগে। সেই আগুনের লেলিহান শিখায় বাড়ি জ্বলে। মন্দির জ্বলে। ভাঙচুর চলে…। আমি জানিও না কি আমার অপরাধ। জবাহের পশু আমি। আমাকে জবাহ দেয়া হয় ধর্মের কাছে। আমার নাবালক সন্তান চেয়ে চেয়ে দেখে সেই নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা। আমার মা ছটফট করেন। স্ত্রী চোখের জল ফেলে। আর যুবতী বোন লুকিয়ে থাকে ইজ্জত হারানোর ভয়ে। তারপরও কি শেষ রক্ষা হয়?
ঘটনা ঘটে। আমার গায়ে দগদগে ক্ষত। আমাদের গায়ে রক্ত ঝরে। মলম দিতে সরকার আসে। বিরোধী দল আসে। সুশীল সমাজ আসে। পুলিশ আসে। র্যাব আসে। আরো আসে জানা-অজানা অসংখ্য মানুষ। নিরাপত্তা জোরদার হয়। আমার দেশে, আমার গ্রামে, আমার বাড়িতে, আমি নিরাপত্তাহীন! হায় ধর্ম! হায় বিবেক!
সকলের আশ্বাসে আমি বিশ্বাসী হয়ে উঠি। দিন যায়। রাত আসে। রাত গিয়ে আবার দিন আসে। আবার জ্বলে ওঠে আগুন। সঙ্গে জ্বলে খাক হয় মনের অলিগলি। আবার বাড়ি পোড়ে। আবার ভাঙে আরাধ্য দেবীর মন্দির। সেই সঙ্গে পায়ে দলে যায় মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার অধিকার। এরাই আমার পরিচিত মানুষ। আপনজন। আত্মীয়। আমি এদের পূজার দিন নিমন্ত্রণ করে খাইয়েছি। আমার মা এদের সন্তানের মতো স্নেহ করে। আমার বোন এদেরই দাদা ডাকে। সন্তান কাকা বলে আর স্ত্রী ডাকে বড়দা বলে। হায়রে নির্ভরতা! হায়রে বিশ্বাস! হায়রে বিশ্বাসঘাতক!
আবার পুলিশ আসে। র্যাব আসে। নিরাপত্তার বলয় তৈরি হয় আমাদের ঘিরে। আমার চিরচেনা গ্রাম অচেনা হয়ে যায়। অচেনা হয়ে যায় গ্রামের পথ। আমি বাইরে বেরোতে পারি না। আমি স্নানে যেতে পারি না। বাজারে যেতে পারি না। আমার মা-বোনের দিন কাটে আতঙ্কে। আমার ঠাকুরঘর নেই। রোজগারের উৎস্য নেই। বাড়ি নেই। আমি নিঃস্ব। আমি রিক্ত। আমি ভুলে যাই বংশপরম্পরায় এ দেশ আমার।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)