সেই একই ঘটনা, একই দৃশ্য। কোনো একটি অভিযোগ খাড়া করে একদল মানুষকে উত্তেজিত করা, তারপর শুরু হয় হামলা, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট। প্রথম দিকে প্রশাসন নির্বিকার থাকে। একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার পর তারা কিছুটা সরব হয়। এর মধ্য দিয়ে সংশ্লিষ্টদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়, বেশি ‘বাড়াবাড়ি’ করো না। এদেশে বসবাস করতে হলে (জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের) মাথা নিচু করে দাসানুদাস হয়ে থাকতে হবে।
প্রতিবাদ করলে কল্পনা চাকমা, রোমেল চাকমা কিংবা গুণমালা চাকমার পরিণতি বরণ করতে হবে। ত্রিশ লক্ষ শহীদের আত্মদানের বিনিময়ে ‘গণতান্ত্রিক’ বাংলাদেশে আমরা পার্বত্য চট্টগামে এমন একটা ব্যবস্থাই কায়েম করেছি। যেন এর কোনো ব্যত্যয় নেই, নেই কোনো প্রতিকার! অথচ এই দেশ নিয়ে, এই দেশের শাসনতন্ত্র নিয়ে আমরা কতই না গর্ব করি!
গত শুক্রবার রাঙামাটির লংগদু উপজেলায় যুবলীগের এক নেতার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে পাহাড়ীদের চারটি গ্রামের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। গুণমালা চাকমা নামে পঁচাত্তর বছর বয়সী এক নারী আগুনে পুড়ে মারা গেছে বলে পাহাড়ীরা দাবি করেছেন। এই ঘটনার পর পাহাড়ীরা আতঙ্কে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন। প্রশ্ন হলো যে মানুষগুলোর বাড়িঘর পোড়ানো হলো, তাদের ক্ষত ও ক্ষতি কীভাবে সারবে? যেই অসহায় নারীকে পুড়িয়ে মারা হলো, তার জীবনেরই বা প্রতিবিধান কিভাবে হবে?
প্রাপ্ত তথ্য মতে, গত বৃহস্পতিবার (১ জুন) লংগদু উপজেলা থেকে ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালক ও স্থানীয় সদর ইউনিয়ন যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নুরুল ইসলাম নয়ন দু’জন যাত্রী নিয়ে দীঘিনালার দিকে রওয়ানা হন। দুপুরের পর দীঘিনালার চার মাইল এলাকায় তার মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখে পুলিশকে খবর দেওয়া হয়। পরে সন্ধ্যায় ফেসবুকে তার মৃতদেহের ছবি দেখে শনাক্ত করে পরিবার ও বন্ধুরা।
ওই যুবলীগ নেতাকে পাহাড়ীরা হত্যা করেছে এমন অভিযোগ তোলার পর যুবলীগের উত্তেজিত নেতাকর্মীরা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। শুক্রবার সকালে হাজার হাজার সেটেলার আওয়ামী লীগের ব্যানারে একত্ হয়ে মিছিল বের করে। ওই মিছিল থেকে হামলা চালিয়ে লংগদু সদরের তিনটিলা ও মানিকজুরছড়ায় পাহাড়ীদের বাড়িঘরে হামলা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ করা হয়। পুরো এলাকা আতঙ্কপুরীতে পরিণত হওয়ার পর বেলা ১২টার দিকে ওই এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে উপজেলা প্রশাসন।
যে যুবলীগ নেতা খুন হয়েছেন, সেই খুনের ঘটনার অবশ্যই প্রতিবিধান হওয়া উচিত। এই খুনের সঙ্গে যদি কোনো পাহাড়ী জড়িত থাকে, তবে তারও আইনানুগ শাস্তি হওয়া উচিত। কিন্তু পুরো পাহাড়ী জনগোষ্ঠীকে দায়ী করা, তাদের সবার বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া, পুড়িয়ে হত্যা করা এটা কোন আইন, কোন নীতি? এই স্বেচ্ছাচারিতার কি কোনো বিচার হবে না? দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনা হবে না? নাকি ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক হিসেবে এই অন্যায়কারীরাও পার পেয়ে যাবে?
‘শিরে হৈলে সপ্যাঘাত, তাগা বাঁধব কুথা?’ এই মোক্ষম সংলাপটি ছিলো তারাশঙ্করের ‘নাগিনীকন্যার কাহিনী’ উপন্যাসে একটি চরিত্রের মুখে। সাপ মাথায় ছোবল দিলে বিষ আটকানোর জন্যে তাগা বাঁধার আর জায়গা থাকে না। চার দশক ধরে এদেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর দুঃখ-দুর্দশা-নিপীড়ন-নির্যাতন বৈষম্য আর বঞ্চনার ধারাবাহিকতা দেখে মনে হয়, আজকের বাংলাদেশের পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর জন্যই যেন তারাশঙ্কর এই সংলাপটি লিখেছিলেন।
বিরাজমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বাধা ও বৈষম্যের কারণে আমাদের পাহাড়ীরা আজ নানা ধরনের সংকটের মুখোমুখি। একদিকে তারা শ্রেণিগতভাবে বিপন্ন, কারণ তারা সমাজের দরিদ্রতম শ্রেণির সদস্য। অন্য দিকে জায়গা দখল ও স্বভূমি থেকে উচ্ছেদ, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে তাদের উপর চালানো হচ্ছে নানা ধরনের হয়রানি ও নির্যাতন। এক ভ্রান্ত নীতি দ্বারা চালিত হয়ে প্রায় চার দশক ধরে পার্বত্য সমস্যাকে জিইয়ে রাখা হয়েছে।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে একদিকে শান্তি বাহিনীর সশস্ত্র বিদ্রোহ দমনের কৌশল হিসেবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সমতল অঞ্চল থেকে বাঙ্গালি সেটলারদের নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের বনাঞ্চল, পাহাড় ও সংখ্যালঘু ক্ষুদ্র জাতিসত্তা অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে বসানো হয়। চাষযোগ্য জমির প্রকট সমস্যা বিরাজমান থাকা সত্ত্বেও তাদেরকে পাহাড়ীদের বংশ পরম্পরায় ব্যবহার করা জমি-জমা বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। গড়ে তোলা হয় গুচ্ছগ্রাম।
এমনকি পাহাড়ীরা যুগ যুগ ধরে যে সব মৌজা ফরেস্ট সংরক্ষণ করে আসছে ধর্মীয় ও সংস্কৃতিক কারণে যেখানে জুম চাষ করা হয় না, কোনো কোনো ক্ষেত্রেও তাও বন্দোবস্ত প্রদান করা হয়েছে সেটলারদের কাছে। অপরদিকে সেনাছাউনি, সেনাক্যাম্প প্রতিষ্ঠা, টহল চৌকি বসানোর জন্যও উচ্ছেদ করা হয় ক্ষুদ্র জাতিসত্তার পাহাড়ী জনগোষ্ঠীকে তাদের বন ও ভূমি থেকে। যা ভূমি, বন ও প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর তাদের সত্ত্বাধিকার ও অভিগম্যতাকে ব্যাপকভাবে সীমিত করে।
সংবিধানে জাতিসমূহের অনুপস্থিতি, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় তাদের এলাকায় তাদেরকে সংখ্যালঘু করে দেওয়া, ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে সাংবিধানিক ঘোষণা, নানান আগ্রাসী উন্নয়ন প্রকল্প, সেনাশাসন, শিক্ষা ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুদের নিজ নিজ মায়ের ভাষার পরিবর্তে বাংলায় পাঠগ্রহণে বাধ্য করা, পাঠ্যপুস্তক-বাংলাপিডিয়াসহ বিভিন্ন জায়গায় হীনভাবে উপস্থাপন, প্রধান রাজনৈতিক দলসমূহের উগ্র-মৌলবাদী শক্তির সঙ্গে ক্ষমতার ভাগাভাগি বা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য চুক্তি এসবই ওই জাতিসমূহের সহজ-স্বাভাবিক মনস্তত্ত্বের জন্য হুমকি হিসেবেই দেখা দিয়েছে।
এছাড়া শাসকগোষ্ঠী বরাবরই চেষ্টা চালিয়েছে অধিপতি জাতির সাধারণ মনস্তত্ত্বকে নিপীড়িত জাতির মনস্তত্ত্বের বিরোধী পাটাতনে দাঁড় করাতে। এক্ষেত্রে শাসকগোষ্ঠী যথেষ্ট সফলই বলা চলে। হাতেগোনা অল্প কয়েকজন ছাড়া প্রায় সব বাঙালিই চাকমা-মারমা-খাসি-সাঁওতাল-পাত্র-মান্দি নির্বিশেষে সবাইকেই বাঙালি জাতির অধীন উপজাতি (!), বহিরাগত (অন্যদেশ থেকে আগত অর্থে) হিসেবে ভাবতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাকর্তৃত্বসহ অন্যান্য বিষয়, ইকোপার্ক ইস্যুতেও শাসকগোষ্ঠীর মনস্তত্ত্বের সঙ্গে উচ্চ শিক্ষিত-নিরক্ষর খেটে খাওয়া বাঙালি মানুষজনের মনস্তত্ত্বের তেমন কোনো ফারাক খুঁজে পাওয়া যায় না।
অথচ পাহাড়ীরা এ দেশেরই মানুষ, তারা আমাদেরই স্বজন। তাদের প্রতিনিয়ত বিপন্নতার মুখে ঠেলে দিয়ে, তাদের চোখের জলকে বাড়তে দিয়ে আর অভিশাপ কুড়িয়ে আমরা কখনওই একটি কাঙ্ক্ষিত দেশ গড়ে তুলতে পারব না। তাদের স্বাতন্ত্র্যকে সম্মান দিয়ে অধিকারকে মর্যাদা ও স্বীকৃতি দিয়েই সম্ভব একটি সকলের সুন্দর আলোকিত বাংলাদেশে গড়ে তোলা। আর এর মাধ্যমে কেবল মানুষ হিসেবে মানুষের পাশে দাঁড়ানো নয়, বরং জাতি হিসেবেও আমরা সম্মানিত হতে পারি। গৌররোজ্জল ও মহিমান্বিত করে তুলতে পারি আমাদের বহুত্ববাদী সংস্কৃতির বৈচিত্র্যময় ধারা।
দেশের কোনো মানুষই যেন বিপন্নতার শিকার না হয়, ধর্ম-সম্প্রদায়-নৃতাত্ত্বিক পরিচয় নির্বিশেষে সবাই যেন সমান নাগরিক মর্যাদা পায়, আজ সেটা নিশ্চিত করাই সবচেয়ে বড় মানবিক দায়িত্ব হওয়া উচিত। ক্ষমতাসীনদের মনে রাখা দরকার, দেশের একটি মানুষকেও যদি অপমান-অসম্মান ও মানবিক মর্যাদার বাইরে রাখা হয়, তাহলে দেশের উন্নয়ন প্রহসনে পরিণত হতে বাধ্য।
কারণ ‘‘দেশ মানুষের সৃষ্টি। দেশ মৃন্ময় নয়, দেশ চিন্ময়। মানুষ যদি প্রকাশমান হয়, তবেই দেশ প্রকাশিত। সুজলা, সুফলা মলয়শীতলা ভূমির কথা যতই উচ্চকণ্ঠে রটান ততই জবাবদিহির দায় বাড়বে, প্রশ্ন উঠবে প্রাকৃতিক দেশ তো উপাদানমাত্র, তা নিয়ে মানবিক সম্পদ কতটুকু গড়ে তোলা হল। মানুষের হাতে দেশের জল যদি শুকিয়ে যায়, ফল যদি যায় মরে, মলয়জ যদি বিষিয়ে ওঠে, শস্যের জমি যদি হয় বন্ধ্যা, তবে কাব্য-কথায় দেশের লজ্জা চাপা পড়বে না। দেশ মাটিতে তৈরি নয়, দেশ মানুষে তৈরি ’’ (আত্মপরিচয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)