রেজিমেন্টের সব ব্যাটারি, ফার্স্ট লাইন আর্টিলারি, ফার্স্ট লাইন স্মল আর্মসসহ গোলাবারুদ নিয়ে সন্ধ্যার আগে নতুন এয়ারপোর্টের কাছে বালুরঘাটে যাবে। বাকি সব অফিসার ও ফোর্স ইউনিট লাইনে হাজির থাকবে। সন্ধ্যায় মার্চ করে টঙ্গী রোড ধরে এয়ারপোর্ট যাবে। প্রত্যেক অফিসার ও জওয়ান ব্যক্তিগত হাতিয়ার সঙ্গে রাখবে। রাত বারোটার মধ্যে দ্বিতীয় ফিল্ড রেজিমেন্টের অফিসার ও জওয়ানরা এয়ারপোর্টের রানওয়েতে জড়ো হলো। রাত দুটায় তাদের পাঠানো হয় বালুরঘাট পজিশনে। সেখানে উপস্থিত সেনাসদস্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয় গুজব। সেনাবাহিনী বিদ্রোহ করেছে এবং দেশে মার্শাল ল’ জারি হয়েছে। কাছেই ল্যান্সার হেডকোয়ার্টার। রাত ১টা। ডালিম, রাশেদ চৌধুরী, হুদা, শাহরিয়ার, রশিদরা সেখানে পৌঁছাল। এসব সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে ল্যান্সার ইউনিটের অস্ত্রাগার থেকে পোশাক ও অস্ত্র দেওয়া হলো। মুহূর্তেই তারা ফৌজী ফর্মেশনে দাখিল হয়ে গেল। পশ্চিম পাশের খোলা জায়গায় ইউনিটের ট্যাঙ্কগুলো সারিবদ্ধ রাখা । রাত ৩টা। সেখানে উপস্থিত হয় দ্বিতীয় ফিল্ড রেজিমেন্টের অফিসাররা। ক্যাম্প টুলে বসে মেজর ফারুক এ সময় পাশে দাঁড়ানো মেজর খন্দকার আবদুর রশিদের সঙ্গে অপারেশনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে শেষ মুহুর্তের আলোচনা সারছিল। ম্যাপ হাঁটুতে রেখেই ফারুক কথা বলছিল। ল্যান্সারের অন্যান্য অফিসার, জেসিও এবং এনসিও পর্যায়ের কর্মকর্তারাও হাজির। পরিকল্পনার কথা সবাইকে জানায় ফারুক। বেশ একটু কানাঘুসা তৈরি হয়। ফারুক জানায়, আর্মির সিনিয়র অফিসাররা এর সঙ্গে রয়েছে। ডেপুটি চিফ অব আর্মি স্টাফ জেনারেল জিয়াউর রহমান খোদ তাকে বলেছেন, গো অ্যাহেড।
আর কী অর্ডার চাই। দিস ইজ দ্যা টাইম টু ডু দি টাস্ক। সবাইকে উত্তেজিত করতে একটি বক্তৃতাও দেয় সে। শেখ মুজিব, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে তার মুখে তুবড়ি ছুটছিল। ডু অর ডাই। এদেরকে খতম করতে না পারলে রক্ষা নাই।
সৈনিকদের উস্কে দিতে সে বলে, মুজিব সেনাবাহিনীর বাজেট কমিয়ে দিয়েছে। আর্মি বোধহয় থাকবে না। ডিসব্যান্ড হয়ে যাবে। বাংলাদেশে সরকার বদলানোর আর কোনো পথ নেই। চাবি একজন, শেখ মুজিব। তাকে দিয়ে ‘প্রক্লামেশন’ করিয়ে যদি ‘চেঞ্জ’ করা যায়। সে যদি রাজি না হয়, যদি ‘রেজিস্টান্স’ হয়, দেশ বাঁচবে না। আমরা কেউ ‘সার্ভাইভ’ করব না। কাজেই তাকে ‘এক্সিকিউট’ করা লাগবে। মুজিব বাঁচলে সে ভয়ঙ্কর। বাঙ্গালিকে পাগলানাচ নাচাতে সে ওস্তাদ।
ফারুক বলল, পলিটিক্যাল পার্টিজ উইল বি ইন কন্ট্রোল। এটা কোন প্রব্লেমই না। মুজিব আর মুজিবের গোষ্ঠী বাদে সব পুষি ক্যাট। অল আর ডার্ক ব্ল্যাক ক্যাট। অন্ধকারে মিউ মিউ করে। আর্মি দেখলে তাদের খুঁজেও পাওয়া যাবে না। ওরা আর্মির মুরগি সাপ্লাইয়ের লাইসেন্স নিতেই ব্যস্ত হয়ে উঠবে। রশীদ ওদেরকে সাইজে রাখার সিস্টেম করেছে। রশীদ চাল্লু মাল। সে মুশতাক সহ সবগুলার দো-আন্ডি এমনভাবে টিপা ধরবে, ওরা ক্যাও ক্যাও করবে। কিন্তু রশীদের কথার অমান্য করবে না।
ফারুকের এই আন্ডি বাত ফৌজীমহলে খুব মশহুর। ফারুক এবার গম্ভীর হয়ে বলে,পলিটিক্যাল সারকম্যাসটেন্সেস যেটা ; সেটা রশিদ ‘ডিল’ করবে। খন্দকার মোশতাক হবে প্রেসিডেন্ট। মুশতাক রাজি। শফিউল্লাহর জায়গায় আর্মি চিফ হবে জিয়াউর রহমান। সে আমাদের ইনডেমনিটির ব্যপারটাও দেখবে। অল লাইন ইজ ক্লিয়ার।
অপারেশন পরিকল্পনাটা আবার খতিয়ে দেখা হলো। উপস্থিত অফিসারদের দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া হলো। শেখ মুজিবের বাড়িতে মেইন অপারেশনের দায়িত্ব মেজর ডালিমকে নিতে বলা হল। ডালিম দ্বিধায় পড়ে যায়। মাত্র কয়েকদিন আগে সেখানে সে কর্মরত ছিল। বলে, এটা আমার জন্য রিস্কি হয়ে যাবে। অসম্মতি জানায় সে। দায়িত্ব দেওয়া হলো আর্টিলারির মেজর মহিউদ্দিনকে। ফারুক বলল, শেখ যেন পালাতে না পারে। কোনো রিস্ক নেয়া যাবে না। বাইরে থেকে তাকে কেউ যেন উদ্ধার করতে না পারে। প্রথমে গিয়েই পুরো এলাকা সিলড করে দেবে। সরাসরি কথা বলবে শেখ মুজিবের সঙ্গে। বাসা থেকে বের করে আনবে তাকে। তারপর ফেলে দেবে তাকে। কিন্তু বাধা এলে বা আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ হলে কোন বিলম্ব করবে না। সঙ্গে সঙ্গে ‘এক্সিকিউট’ করবে। অন্যরাও সমর্থন দিল ফারুককে। । তাদের সাপোর্ট দিতে আর্টিলারি ট্যাঙ্ক রাখা হল। রক্ষীবাহিনী বা অপর কোনো পাল্টা আক্রমণ প্রতিহত করতে ফিল্ড রেজিমেন্টকে বিভিন্ন কৌশলগত অবস্থানে মোতায়েন করা হয়। ডালিম বত্রিশ নম্বরের পাহারার ধরণ নিয়ে বলল। জানাল, শেখের বাড়িতে ফার্স্ট ফিল্ড রেজিমেন্ট থেকে গার্ড মোতায়েন আছে। তারা মহিউদ্দিনকে বাধা দিতে পারে। বজলুল হুদা এর আগে প্রথম ফিল্ড রেজিমেন্টের অ্যাডজুট্যান্ট ছিল। তার পুরো টিমটি নখদর্পণে। সে তাদের ম্যানেজ করতে পারবে । সায় দিল হুদা। হুদা, নূর চৌধুরী এবং মেজর মহিউদ্দিনকে একসঙ্গে মূল অপারেশনের দায়িত্ব দেওয়া হলো। মেজর রশিদ দায়িত্ব নিলো সে অপারেশন সাকসেসফুল হলেই জেনারেল জিয়া ও খন্দকার মোশতাকের কাছে ছুটে যাবে। বিজয় বার্তা দেবে তাদেরকে। জয় বাংলা মুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ। আবার জিন্দাবাদ কায়েম করা সম্ভব হয়েছে।
ফারুকের দায়িত্বে রইল ট্যাঙ্ক। রাশেদ চৌধুরী ও শাহরিয়াররা থাকে ডালিমের সঙ্গে। ডালিম যাবে বাংলাদেশ বেতারে। গিয়েই লাত্থি মেরে উল্টে দেবে সাইনবোর্ড। বখতিয়ারী জজবায় কায়েম করবে রেডিও বাংলাদেশ।
ভোর তখন চারটা।
ইয়াজুজ মাজুজরা জিহ্বা ব্যাদান করতে করতে বেরিয়ে পড়লো অপারেশন জিও পাকিস্তানে। মেজর শাহরিয়ার, মেজর রাশেদ চৌধুরী, ক্যাপ্টেন মোস্তফা এবং ক্যাপ্টেন মাজেদ মিন্টো রোডে আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়িতে গিয়ে ঘটাল তাণ্ডব। রক্ত ঝরতে শুরু হল। মিন্টোরোডের বাড়ি রক্তগঙ্গা। কেউ রক্ষা পেল না সেখানে। ড্রয়িং রুমজুড়ে জমাট বাঁধা রক্ত।
সড়ক নম্বর ১৩/১, ধানমণ্ডি, শেখ মণির বাড়ি: মণি ও তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে তাদের এই বাড়িতে খুন করা হয়। অবোধ শিশু তাপসের চোখের সামনেই হত্যা করা হরো তার বাবা মাকে।
বাড়িটি কয়েক মুহূর্তেই তছনছ। মেঝেতে স্পষ্ট রক্তের দাগ। মাঝের টেবিলে একটি অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে কিছু ভিজানো চিড়া।
শুক্রবার ভোর সাড়ে ৪টা। বঙ্গবন্ধু টেলিফোনে তার পিএ মুহিতুল ইসলামকে বললেন, সেরনিয়াবাতের বাড়িতে দুষ্কৃতকারীরা আক্রমণ করেছে জলদি পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন লাগা।
কিন্তু চেষ্টা করেও লাইন না পাচ্ছিল না মুহিতুল। বঙ্গবন্ধু নিজেই দোতলা থেকে নিচে মুহিতুলের অফিস কক্ষে নেমে আসেন। পুলিশ কন্ট্রোল রুম না পেয়ে তিনি সেখান থেকে গণভবন এক্সচেঞ্জে নিজেই রিসিভার নিয়ে কথা বলতে শুরু করেন। পৌনে ৫টার দিকে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দক্ষিণ দিক থেকে লাগাতার গুলি । বঙ্গবন্ধু টেবিলের পাশে শুয়ে পড়েন। কিছু সময় পর গুলি বন্ধ হলে কাজের ছেলে সেলিম ওরফে আবদুল দোতলা থেকে বঙ্গবন্ধুর চশমা ও পাঞ্জাবি নিয়ে আসে। সেখানে দাঁড়িয়েই সেগুলো পরে তিনি বারান্দায় গিয়ে বলেন, ‘এত আর্মি পুলিশ সেন্ট্রি, এত গুলি হলো তোমরা কী কর’। তিনি দোতলায় চলে যান। শেখ কামাল ওপর থেকে নেমে বাড়ির আর্মি ও পুলিশদের তার সঙ্গে আসতে বলেন। এগিয়ে যান বারান্দায় । কিন্তু গুলি বন্ধ হওয়ার পর কালো ও খাকি পোশাক পরা কিছু সৈনিক হ্যান্ডস আপ হ্যান্ডস আপ বলতে বলতে দৌড়ে আসে। তারা গেট দিয়ে বাড়িতে ঢুকে পড়ে। তাদের মধ্য থেকে বজলুল হুদা বারান্দায় দাঁড়ানো শেখ কামালের পায়ে গুলি করে। তিনি তখন বলেন,’আমি শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল’ । বলার সঙ্গে সঙ্গে তাকে লক্ষ্য করে ব্রাশফায়ার করা হয়। একটি গুলি বাড়িতে কর্তব্যরত ডিএসপি নজরুল ইসলামের গায়ে লাগে। বজলুল হুদা ও নূর বাড়ির কাজের লোক এবং পুলিশদের গেটের সামনে লাইন করে দাঁড় করায়। সেখানে একজন এসবি অফিসারকে একজন আর্মি গুলি করে মারে। ল্যান্সার মেজর মহিউদ্দিন গুলি করতে করতে ফোর্স নিয়ে দোতলায় উঠে যায়। বঙ্গবন্ধুকে এ সময় তার কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসতে দেখে তারা তাকে ঘিরে ফেলে। সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায়। একই সময় বজলুল হুদা ও নূর কয়েকজন ফোর্স নিয়ে বাড়ির গার্ড বাহিনীর হাবিলদার কুদ্দুস শিকদারকে তাদের সঙ্গে আসার নির্দেশ দিয়ে দোতলায় উঠছিল। সিঁড়ি দিয়ে দু’এক ধাপ নামার মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু তাকে ঘিরে রাখা আর্মিদের উদ্দেশে বলেন, ‘তোরা কী চাস, কোথায় নিয়ে যাবি আমাকে?’ নিচের দিক থেকে ওপরে উঠে আসার মাঝের ল্যাান্ডিংয়ে দাঁড়িয়ে নূর ইংরেজিতে কিছু একটা বলে। মেজর মহিউদ্দিন ও তার সঙ্গের ফোর্স একপাশে সরে যায়। বঙ্গবন্ধু আবারও প্রশ্ন করেন, ‘তোরা কী চাস’? সঙ্গে সঙ্গে হুদা তার পাশের কারও কাছ থেকে একটি স্টেনগান নিয়ে এবং নূর তার হাতের স্টেনগান দিয়ে একসঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে। সিঁড়িতেই লুটিয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধু। তখন তার পরনে ছিল লুঙ্গি, গায়ে পাঞ্জাবি, এক হাতে সিগারেটের পাইপ, অন্য হাতে দিয়াশলাই। এরপর মেজর মহিউদ্দিন, মেজর নূর, মেজর বজলুল হুদাসহ সবাই নেমে দক্ষিণ দিকের গেট দিয়ে বাইরের রাস্তায় চলে যায়। কিন্তু এর পরপরই মেজর আজিজ পাশা, রিসালদার মোসলেম উদ্দিন ল্যান্সারের ও দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারির সৈন্যদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে প্রবেশ করে। আজিজ পাশা বঙ্গবন্ধুর কক্ষের দরজা খুলতে বলে, কিন্তু ভেতর থেকে না খোলায় দরজায় গুলি করা হয়। বেগম মুজিব দরজা খুলে কক্ষে থাকা পরিবারের অন্যদের না মারার জন্য কাকুতি-মিনতি করেন। কিন্তু একদল ফোর্স বেগম মুজিব, শেখ রাসেল, শেখ নাসের ও রমাকে রুম থেকে বের করে নিয়ে আসে। বেগম মুজিব সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুর লাশ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন। মারলে সেখানেই মারতে বলেন তিনি। গভীর ভাবে শোকাতুর হয়ে পড়েন তিনি। আর অগ্রসর হতে না চান না। অন্যদের নিচে নেওয়া হয়। কিন্তু বেগম মুজিবকে আবার রুমে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। আজিজ পাশা সেখানে রিসালদার মোসলেম উদ্দিনের হাতের স্টেনগান নিয়ে রুমের সবাইকে গুলি করে। সেখানে ছিলেন বেগম মুজিব, শেখ জামাল, শেখ জামালের স্ত্রী রোজি এবং শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা।
দোতলা থেকে নামিয়ে শেখ নাসের ও রাসেলকে অন্যদের সঙ্গে লাইনে দাঁড় করানো হয়। এ সময় নাসের বলেন, ‘স্যার আমি তো রাজনীতি করি না, কোনোরকম ব্যবসা-বাণিজ্য করে খাই।’ পাহারারত একজন আর্মি অপর একজনকে এর জবাবে বলে, শেখ মুজিব ‘বেটার দ্যান’ শেখ নাসের। ঠিক আছে, আপনি ওই রুমে গিয়ে বসেন, বলে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় রিসিপশন রুমে এবং রুমের বাথরুমে নিয়ে তাকে গুলি করা হয়। শেখ নাসের পানি পানি বলে চিৎকার করতে থাকেন। গুলি করে ফিরে আসা আর্মিটি অপর একজনকে বলে, পানি দিয়ে আয়। দ্বিতীয়জন গিয়ে তাকে আবারও গুলি করে।
মুহিতুল ইসলামকে জড়িয়ে ধরেছে ভয়ার্ত শিশু শেখ রাসেল। থর থর করে কাপছে। তার চারপাশে রক্ত আর রক্ত। লাশ আর লাশ। লাইনে দাঁড়িয়ে মুহিতুলকে বলল, ‘ভাইয়া আমাকে মারবে না তো?’
মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করছিল রাসেল। শিশু রাসেলকে তার মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য ল্যান্সারের একজন হাবিলদারকে হুকুম দেয় আজিজ পাশা। তাকে দোতলায় নিয়ে মায়ের লাশের কাছে মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়। ঘাতক আর্মিটি ফিরে আসে। সোল্লাসে পাশাকে জানায়, স্যার সব শেষ।
কী বীভৎসতা! রক্ত, মগজ ও হাড়ের গুঁড়ো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল প্রতিটি তলার দেয়াল, জানালার কাচ, মেঝে ও ছাদে। রীতিমতো রক্তগঙ্গা বইছে যেন ওই বাড়িতে। গুলির আঘাতে দেয়ালগুলোও ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। চারপাশে রক্তের সাগরের মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল ঘরের জিনিসপত্র। প্রথম তলার সিঁড়ির মাঝখানে নিথর পড়ে ছিলেন ঘাতকের বুলেটে ঝাঁঝরা হওয়া চেক লুঙ্গি ও সাদা পাঞ্জাবি পরা স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর লাশ। তলপেট ও বুক ছিল বুলেটে ঝাঁঝরা। অভ্যর্থনা কক্ষে শেখ কামাল, টেলিফোন অপারেটর, মূল বেডরুমের সামনে বেগম মুজিব, বেডরুমে সুলতানা কামাল, শেখ জামাল, রোজী জামাল, নিচতলার সিঁড়ি সংলগ্ন বাথরুমে শেখ নাসের। মূল বেডরুমে দুই ভাবীর ঠিক মাঝখানে বুলেটে ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত রাসেলের লাশ।
প্রথম তলার সিঁড়ির মাঝখানে যে সমতল জায়গাটা তার তিন-চার ধাপ ওপরে একেবারে কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুকে। তার তলপেট ও বুক ছিল বুলেটে ঝাঁঝরা। শেখ মুজিব সব সময় চশমা পরতেন। তাঁর চশমা ও তামাকের পাইপটি পড়া ছিল সিঁড়িতে। পরনে চেক লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি। চশমার একটি গ্লাস ভাঙা। রক্তে পাঞ্জাবির রং ছিল গাঢ় লাল। একটি বুলেট তার ডান হাতের তর্জনীতে গিয়ে লাগে এবং আঙুলটি প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
বেগম মুজিবকে বুকে ও মুখম-লে গুলি করা হয়। তার পরনে ছিল সুতি শাড়ি এবং কালো রঙের ব্লাউজ। গলায় মাদুলি বাঁধা একটি সোনার নেকলেস। কনিষ্ঠা আঙুলে ছোট্ট একটি আংটি। তখনো তার পায়ে ছিল একটি বাথরুম স্লিপার!
সুলতানা কামালের বুক ও তলপেটে গুলি লাগে। পরনে ছিল শাড়ি ও ব্লাউজ। রোজী জামালের মুখটি দেখাচ্ছিল বিবর্ণ, মলিন। মাথার একাংশ উড়ে গিয়েছিল। তার তলপেট, বুক ও মাথায় গুলি করা হয়। পরনে ছিল শাড়ি ও ব্লাউজ।
শেখ কামালের বুক ও তলপেটে তিনচারটি বুলেট বিদ্ধ হয়। তার পরনে ছিল ট্রাউজার। তার লাশ পড়েছিল নীচতলায়।
শেখ জামালের মাথা চিবুকের নিচ থেকে উড়ে গিয়েছিল। পরনে ট্রাউজার। ডান হাতের মধ্যমায় ছিল একটি মুক্তার আংটি। সম্ভবত এটি ছিল তার বিয়ের আংটি।
শিশু রাসেল। আগুনে তার পা ঝলসে যায়। মাথা উড়ে গিয়েছিল। পরনে ছিল হাফপ্যান্ট। লাশ একটি লুঙ্গিতে মোড়ানো ছিল। সিঁড়িতে ছিল আল্পনা আঁকা।
পবিত্র কোরআন শরিফও মেঝেতে। রেহাই পায়নি ঘাতকদের হাত থেকে। ভূলুণ্ঠিত; ছিন্ন ভিন্ন।
দূর ইউরোপে হাসু ও রেহানা বড়ই বিষণ্ণ। ভয়ংকর দুঃসংবাদের ধারণা তারা পেলেও সবাই দোদুল্যমান। নিশ্চিত করে তাদের কেউ কোনো তথ্য দিচ্ছে না। সবাই ভয় পাচ্ছে, এই মহাশোক তারা সহ্য করতে পারবে তো। দুই কন্যার কাছে বাবা তখন কেবলই স্মৃতির অ্যালবামের ছবি! পুরো পরিবার – সবাই পুষ্পমাল্যের ফ্রেমে বন্দি! অবিশ্বাস্য। কেমন করে তারা বিশ্বাস করবে!
আইয়ুব, ইয়াহিয়া, টিক্কা; ফৌজীখানা, লয়ালপুর। পাকি-জল্লাদের রক্তচক্ষু থেকে শেষ রক্ষা কি হলো না! এবার জল্লাদরা সত্যি কি তাকে খতম করতে পারল; তাকে ফাঁসিতে লটকানো হরো; নাকি ফায়ারিং স্কোয়াডে খতম – নাকি আরেকটা রাত পোহালে শোনা যাবে আবারও, বাবা মরেননি – কেউ পরিষ্কার করে হাসুকে কিছু বলেনি। আম্মা, কামাল, জামাল, রাসেল কারও কোনো খবর নেই। কিছুটি কেউ বলছে না।
সবার মধ্যে আতঙ্ক।
দজ্জালরা রাওয়ালপিন্ডি-ইসলামাবাদ থেকে পৌরানিক দৈত্য পাখির মত উড়ে এসে ইউরোপেও একে একে হত্যা করবে সবাইকে; কেউ বাঁচবে না; কারও বুঝি রক্ষা নেই – এমন ঘূর্ণি-মাতম ভয় সবার মধ্যে। ঢাকায় ফেরার জন্য হাসু ও রেহানার এত ব্যাকুলতা – সেই ব্যাকুল চিত্ত কাউকেই স্পর্শ করছে না। সবাই ভয়ে এমনই অস্থির। ঢাকা কি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে বিশ্ব থেকে। ঢাকা কি কৃষ্ণগহ্বরে হারিয়ে গেছে চিরকালের জন্য। পৃথিবী নামক গ্রহে ঢাকা বলতে কি কোনো গন্তব্য নেই। স্বদেশ কি এখন নিষিদ্ধ। ওয়াজেদ বড় চুপচাপ। ইউরোপে কেমন করে দিনের পর দিন থাকা সম্ভব। কে দেবে আশ্রয়। কারও হাতেই পাউন্ড রুবল নেই বললেই চলে। সব শেষ।
ঢাকায় না ফিরে কোনো উপায় নেই। আব্বা আম্মা জামালকামাল রাসেলের এমন কি হলো – উৎকণ্ঠা ক্রমশই শোকসমুদ্রের মত অথৈ হয়ে উঠছে।
ওয়াজেদ কিছু একটা উপায় খুঁজছিলেন। তিনিও হাসুকে কিছু বিস্তারিত খুলে বলেন না। মানুষটা এমনই বিষণ্ণ – তার কাছে কিছু জানতে বড্ড ভয় হয়।
সময়টা তখন বড়ই আততায়ী। সবার চোখেই উদ্বেগ, আশঙ্কা – হাসুরা ইউরোপের নীল পাহাড়ের শহরেও নয় নিরাপদ। নিঃশব্দ আততায়ী তাদেরকে যেন খুঁজছে। মৃত্যু কি তাদের পিছন পিছন হন্যে হয়ে ছুটছে।
কেনো যাওয়া যাবে না ঢাকাতে! ঢাকা কি হত্যাপুরী! কেবলি বিপন্ন বিস্ময়। কেবলি প্রশ্ন। উত্তর নেই।
ওয়াজেদ অবশেষে একটা গতি করলেন। পশ্চিমে আর নয়। পূবের দিকে প্রত্যাবর্তন। গন্তব্য দিল্লি। পঁচিশে আগস্ট। তখন সকাল। এয়ার ইন্ডিয়ার জাম্বোয় উড়ে পালামে অবতরণ। আগমন লাউঞ্জে এসে ওয়াজেদ কাউকে খুঁজছেন। কোথাও কেউ নেই। হাসিনা রেহানা বড় নিঃসঙ্গ বোধ করতে লাগলেন। ঘণ্টা খানেক বাদে ভারত সরকারের দুজন কর্মকর্তা এলেন। তারা ওদেরকে নিয়ে গেলেন ডিফেন্স কলোনীর একটি বাড়িতে। দোতলা বাড়ি নামেই। নিচতলায় ডাইনিং কাম ড্রইং। দুটো ঘুমোবার রুম। প্রচণ্ড ক্লান্তি – দীর্ঘ উড়ানের ধকল। শোকগ্রস্ত পরিবারটি প্রথম রাতটি কাটালো একে অপরকে জড়িয়ে রেখেই। এই অবশিষ্ট বন্ধনটুকু থাকুক অম্লান। দিল্লিতেও আতঙ্কের জের কাটছে না। কর্মকর্তারা বলে গেছে, হাসুদের আসল পরিচয় কেউ জানে না। কাউকে যেন কিছু বলা না হয়।
কেন এই লুকোচুরি। কেন এই অবরুদ্ধ জীবন। দিল্লির পরিবেশও গুমোট। জরুরি অবস্থা চলছে সারা ভারতে।
রেহানার খুব পীড়াপীতিতে ওয়াজেদ একদিন জানালেন, ভারতে তারা পলিটিক্যাল এসাইলাম নিয়েছেন। সেপটেম্বরের শুরুতেই পদস্থ কর্মকর্তা এলেন বাসাতে। জানালেন, বিশেষ সাক্ষাতের জন্য হাসুতে নয়া দিল্লির এক বাড়িতে নেয়া হবে। রাতে গাড়ি ছুটল।
ইন্দিরা গান্ধীর বাসভবন। মাঝারি একটা বসার ঘর। লম্বা সোফায় বসানো হল হাসিনাকে। মিনিট দশেক পরে ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী গান্ধী এলেন। তার বিষণ্ণ শোকার্ত মুখ। গম্ভীর। কণ্ঠও বেশ ভারী। ইন্দিরা কাছে টেনে নিলেন হাসিনাকে। ওয়াজেদের কাছে জানতে চাইলেন, ঢাকায় পনেরোই আগস্টের ট্রাজেডি পুরোপুরি হাসিনা জানে কিনা।
ওয়াজেদের মুখ ফ্যাকাশে। এবার শান্ত্বনার শেষ লুকোচুরিও অবশিষ্ট থাকছে না। হাসু মুহূর্তেই রক্তশূন্য। তার চোখ মুখ সব পাথরের মত নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ল।
কী খবর এখন সে শুনবে। যা কিছু শঙ্কা, যা কিছু উৎকণ্ঠা; যা কিছু উদ্বেগ – সব আবগুণ্ঠন এখনি উন্মোচিত হবে সামনে।
ইন্দিরা বেদনার্ত কণ্ঠে এক কর্মকর্তাকে বললেন, সর্বশেষ ঢাকার পরিস্থিতি জানাতে।
সে বেচারাও শোকগ্রস্ত। দুঃখ ভারাক্রান্ত গলায় জানালেন, বঙ্গবন্ধু পরিবারের কেউ বেঁচে নেই।
ইন্দিরা গান্ধী আগলে ধরে রাখতে চাইলেন কন্যাসমাকে। জড়িয়ে ধরলেন হাসুকে। বাধভাঙা জোয়ারের মত কন্যাটি এখন কাঁদছে। কেমন করে শান্ত্বনা দেবেন এই শোকাতুরাকে। তবুও বললেন, তুমি যা হারিয়েছ তা আর কোনোভাবেই পূরণ করা যাবে না। তোমার একটি শিশুপুত্র, কন্যা রয়েছে। এখন থেকে তোমার ছেলেকেই তোমার বাবা, মেয়েকে তোমার মাতৃসমা ভাবতে হবে। তোমার ছোটবোনও রয়েছে। ছেলেমেয়ে ও বোনকে মানুষ ভার তোমাকে নিতে হবে। এখন তোমার কোনোভাবেই ভেঙ্গে পড়লে চলবে না।
হাসু অঝোরধারায় কাঁদছে। অবিশ্বাস্য। কেমন করে এই সত্য সে মেনে নেবে।
কেউ কি বেঁচে নেই। কেউ না! শত জল্লাদের রক্তরশির নিগড় ছিন্ন করে বাবা মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে রাওয়ালপিন্ডি থেকে ফিরেছিলেন। এবার বাংলায় ঢুকেই তারা কেড়ে নিল তার প্রাণ।
আম্মাকে কে হত্যা করল। কেন হত্যা করল। আম্মা সর্বজননীর মত আগলে ছিলেন সবাইকে। মানুষকে ভালবাসার জন্য এমন নির্মম দণ্ড! এমন নিষ্ঠুরতা।
বাবা স্বাধীন করেছিলেন প্রাণের বাংলাকে। হাজার শতাব্দীর শৃঙ্খল ভেঙ্গে মুক্তি এনেছিলেন । জামাল কামাল! সুলতানা, রোজী ! তারাও কি শিকার হয়েছে সেই সুপ্ত জিঘাংসার। জল্লাদরা গর্ভবতী নারীকেও রেহাই দিল না।
পরম আদরের ছোট রাসেল সোনা। সেই রাসেলও নেই! ওরা টুটি চেপে খতম করল কি তাকেও।
এ কেমন নির্মম নিঠুর সত্য হাসু শুনল। কেন সে শুনতে এলো এখানে। কদিন ধরে কত কল্পনাই সে করেছে। যেসব আশঙ্কা তার মনকে জলজমাট পাথর বানিয়ে রেখেছিল। কেন তার সত্যাসত্য শুনতে এলো সে!
হিমালয়ের হিমবাহ হয়ে হাসু শোককে আগলে রেখেছিল। সেই হিমবাহ গলে গলে একাকার।
জল গড়িয়ে যাচ্ছে মধুমতি, ধানসিড়ির অববাহিকায়।
বাইগারের কাকচক্ষু জল; কিনারায় ঘন শ্যামল সবুজ জঙ্গল। বইচির ঝোপ। সাঁইবাবলার ঝাঁড়। জাম, জামরুল হিজলতমালের বন। পলাশ শিমুল ফুল। কাছেই অর্জুনের ছায়া। রাইসর্ষের খেত দিগন্ত ছোঁয়া। অশথের ডালপালায় বিবর্ণ বিষণ্ণ দুপুর। শেখ মুজিব ফিরলেন তার টুঙ্গিপাড়ায়।
তার পরনে সাদা পাঞ্জাবি। চেক লুঙ্গি। সঙ্গে চশমা। বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়। সেই বুক গুলিতে বিদীর্ন। শুকনো রক্ত সারা শরীরে। ডান হাতের তর্জনী বিচ্ছিন্ন। বাড়ির উঠানেই শেষ ঘুম। শেষ শয্যা পাতা।
হাজার বছর ধরে বাইগার বইছে অনন্ত দক্ষিণে। তার বুকে জলকাকলি; জলতরঙ্গ। জয় বাংলা। আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি। (সমাপ্ত)
অলংকরণ: শিল্পী শাহাবুদ্দিন