চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

৭ জুনের আগে-পরের ৩ দিনে বঙ্গবন্ধু

৭ জুন মহান ছয় দফা দিবস। এই দিন বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ বাস্তবায়নের জন্য পূর্ববাংলার মানুষ জুলুমবাজ পাকিস্তানি সরকারের বিরুদ্ধে রক্তের ঋণ দিয়ে ইতিহাস গড়েছিল। সেসময় বঙ্গবন্ধু ছিলেন ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি।কারণ বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ৬ দফা দেবার পর গ্রেফতার হন ৮ মে। ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত বন্দি থাকেন। এই বন্দিদশায় তিনি ৭ই জুনের হরতালের আগে-পরের অনুভূতি ব্যক্ত করে গেছেন তাঁর দিনলিপিতে। বিশেষত ১৯৬৬ সালের ৬ থেকে ৮ জুন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর মনোজগতের বিবরণ ঐতিহাসিক ছয় দফার জন্য আত্মত্যাগী মানুষের সংরাগের সঙ্গে মিলিয়ে পড়া যায়।

২. বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক জীবনে ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাভোগ করেছেন। এর মধ্যে স্কুলের ছাত্র অবস্থায় ব্রিটিশ আমলে সাত দিন কারাভোগ করেন। বাকি ৪ হাজার ৬৭৫ দিন তিনি কারাভোগ করেন পাকিস্তান সরকারের আমলে। কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বসেই তিনি স্বাধীন বাংলার পরিকল্পনা করেছিলেন। বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা ছিল তারই চূড়ান্ত রূপরেখা। ছয় দফা দেওয়ার পর জাতির পিতা যেখানে সমাবেশ করতে গেছেন, সেখানেই গ্রেফতার হয়েছেন। ওই সময়ে তিনি ৩২টি জনসভা করে বিভিন্ন মেয়াদে ৯০ দিন কারাভোগ করেন। আর ৬৬ সালের ৮ মে আবারও গ্রেফতার হয়ে ১৯৬৯ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মুক্তি পান। এ সময় তিনি ১ হাজার ২১ দিন কারাগারে ছিলেন।

উল্লেখ্য, ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী দলসমূহের জাতীয় সম্মেলনের বিষয় নির্বাচনী কমিটিতে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক ছয়-দফা দাবি পেশ করেন। যদিও তাঁর দাবিকে শাসকগোষ্ঠী ও তাদের অনুগতরা পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্র হিসেবে অভিহিত করে অবজ্ঞা প্রদর্শন করেছিল কিন্তু তিনি দমে যাবার পাত্র ছিলেন না। ঢাকায় ফিরে সেই দাবিনামা নিয়ে ব্যাপকভাবে প্রচারের জন্য আত্মনিয়োগ করেন।প্রস্তাবিত ছয়-দফা ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ। ৬৬এর মার্চ মাসে তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। এরপর ছয়-দফার পক্ষে জনমত সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সারা পূর্ববাংলায় গণসংযোগ সফর শুরু করেন। এ সময় তাঁকে সিলেট, যশোহর, ময়মনসিংহ ও ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে বার বার গ্রেফতার করা হয়। শেখ মুজিব এ বছরের প্রথম তিন মাসে আট বার গ্রেফতার হন। আর একনাগাড়ে প্রায় তিন বছর কারাবাস করার কথা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি।

৭ জুন বঙ্গবন্ধু ও আটক নেতৃবৃন্দের মুক্তির দাবিতে এবং ছয়-দফার সমর্থনে সারাদেশে হরতাল পালিত হয়। হরতালের সময় ঢাকার তেজগাঁও, নারায়ণগঞ্জ ও টঙ্গীতে পুলিশের গুলিতে মনুমিয়াসহ বেশ কয়েকজন নিহত হন। এই দিনই ছয়-দফা বাংলাদেশের মহাসনদে (ম্যাগনাকাটা) পরিণত হয়। তবে ১৯৬৫ সালেও বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও আপত্তিকর বক্তব্য প্রদানের অভিযোগে দায়েরকৃত মামলায় এক বছরের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে হাইকোর্টের নির্দেশে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তিনি মুক্তি লাভ করেন।

৩. ৭ জুনের আগে-পরের ৩ দিন বঙ্গবন্ধু কি করেছিলেন তা লেখা রয়েছে ‘কারাগারের রোজনামচা’য়। ১৯৬৬-১৯৬৯ বন্দি সময় ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত ডায়েরির খাতায় লিপিবদ্ধ দিনলিপি স্থান পেয়েছে এ গ্রন্থে। বিশেষত তাঁর গ্রেফতারের পর তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি, পত্র-পত্রিকার অবস্থা, শাসকদের নির্যাতন, ৬ দফা বাদ দিয়ে মানুষের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে নিয়ে যাবার চেষ্টা ইত্যাদি বিষয় তিনি দিনলিপিতে তুলে ধরেছেন। মানুষের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন ও সংগ্রাম তিনি করেছেন যার অন্তর্নিহিত লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা অর্জন। বাংলার মানুষ যে স্বাধীন হবে এ আত্মবিশ্বাস বার বার তাঁর ৬ দফা কেন্দ্রিক লেখায় ফুটে উঠেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এজন্যই লিখেছেন-‘এত আত্মপ্রত্যয় নিয়ে পৃথিবীর আর কোনো নেতা ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেননি। ধাপে ধাপে মানুষকে স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত করেছেন, উজ্জীবিত করেছেন তিনি।’

৬ দফা ছিল মুক্তির সনদ, সংগ্রামের পথ বেয়ে যা এক দফায় পরিণত হয়েছিল, সেই এক দফা স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত সুচারুরূপে পরিকল্পনা করে প্রতিটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। সামরিক শাসকগোষ্ঠী হয়তো কিছুটা ধারণা করেছিল, কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার কাছে তারা হার মানতে বাধ্য হয়েছিল। ৬ দফাকে বাদ দিতে কারা ৮ দফা দাবি প্রচার করে আন্দোলন ভিন্নখাতে নিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিল, সে কাহিনিও রোজনামচায় পাওয়া যায়।

‘কারাগারের রোজনামচা’র সূত্রে জানা যায়, বিনা বিচারেই বঙ্গবন্ধুকে দীর্ঘদিন একাকী কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। তাঁর অপরাধ ছিল তিনি বাংলার মানুষের অধিকারের কথা বার বার বলেছেন। তাঁর শরীর মাঝে মাঝে অসুস্থ হয়ে যেত। তিনি বাংলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন; ক্ষুধা, দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন। বাংলার শোষিত বঞ্চিত মানুষকে শোষণের হাত থেকে মুক্তি দিয়ে উন্নত জীবন দিতে চেয়েছিলেন। ৭ই জুনের হরতালের আগে থেকেই কারাগারে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের দুঃখ দুর্দশা নিয়ে তাঁর উদ্বেগ প্রকাশিত হয়েছে।দলের প্রতিটি সদস্যকে তিনি কতটা ভালোবাসতেন, তাদের কল্যাণে কত চিন্তিত থাকতেন সেকথাও অকাতরে বলেছেন। একাকী থাকার কষ্টের কথা ছাড়া তিনি নিজের কোনো কষ্টের কথা বলেন নি।৩ দিনের দিনপঞ্জির বিস্তারিত বিশ্লেষণে না গিয়ে নিচে হুবহু বঙ্গবন্ধুর নিজের লেখা তুলে দেয়া হলো। তবে জেলের কিছু প্রাত্যহিক বিবরণ বাদ দেয়া হয়েছে।

৪.
৬ই জুন ১৯৬৬।। সোমবার
আগামীকাল ধর্মঘট। পূর্ব বাংলার জনগণকে আমি জানি, হরতাল তারা করবে। রাজবন্দিদের মুক্তি তারা চাইবে। ছয়দফা সমর্থন করবে। তবে মোনায়েম খান সাহেব যেভাবে উস্কানি দিতেছেন তাতে গোলমাল বাঁধাবার চেষ্টা যে তিনি করছেন। এটা বুঝতে পারছি। জনসমর্থন যে তার সরকারের নাই তা তিনি বুঝেও, বোঝেন না।

…ধরপাকড় চলছে সমানে। কর্মীদের গ্রেফতার করছে। যশোর আওয়ামী লীগ অফিস তল্লাশি করেছে। ভূতপুর্ব মন্ত্রী আওয়ামী লীগ নেতা জনাব মশিয়ুর রহমান প্রতিবাদ করেছেন। জনাব নুরুল আমীন সাহেব আওয়ামী লীগ কর্মী ও নেতাদের গ্রেফতারের তীব্র সমালোচনা করেছেন এবং মুক্তি দাবি করেছেন। তিনি বলেছেন, শত্রুবিনাশের জন্য রচিত আইনে দেশবরেণ্য নেতৃবৃন্দের গ্রেফতার দেশবাসীকে স্তম্ভিত করিয়াছে। ঢাকার মৌলিক গণতন্ত্রী সদস্যরা এক যুক্ত বিবৃতিতে আমাকে সহ সকল রাজবন্দির মুক্তি দাবি করিয়াছে, আর ৬ দফার দাবিকে সমর্থন করিয়াছে এবং জনগণকে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে শরিক হওয়ার আহ্বান জানাইয়াছে।

৯ জন আওয়ামী লীগ দলীয় এমপিও ধরপাকড়ের তীব্র প্রতিবাদ করিয়াছে এবং তাদের মুক্তি দাবি করিয়াছেন। আওয়ামী লীগ, শ্রমিক, ছাত্র ও যুব কর্মীরা হরতালকে সমর্থন করে পথ সভা করে চলেছে। মশাল শোভাযাত্রাও একটি বের করেছে। শত অত্যাচার ও নির্যাতনেও কর্মীরা ভেঙে পড়ে নাই। আন্দোলন চালাইয়া চলেছে। নিশ্চয়ই আদায় হবে জনগণের দাবি।

গভর্নর নারায়ণগঞ্জ জনসভায় আবার হুমকি ছেড়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আইন শৃঙ্খলা ভঙ্গের চেষ্টা করলে কঠোর হস্তে দমন করবেন। আইন শৃঙ্খলা আওয়ামী লীগ কোনোদিন ভাঙতে চায় নাই। তারা বিশ্বাসও করে না ঐ রাজনীতিতে। কিন্তু যিনি আইন শৃঙ্খলার মালিক হয়ে আইন শৃঙ্খলা ভাঙতে উস্কানি দিতেছেন তার বিচার কে করবে? যার সরকার বেআইনি এবং অন্যায়ভাবে কর্মীদের হয়রানি করছেন, গ্রেফতার করছেন তার বিচার কবে হবে? মোনায়েম খান সাহেবের জানা উচিত ১৯৪৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগ কর্মীরা অনেকবার জেলে গেছেন, মিথ্যা মামলার আসামিও হয়েছেন। পূর্বের সরকার এবং মুখপাত্ররা এ রকম হুমকি অনেকবার দিয়েছেন।

সরকার কর্মীদের বন্দি করেও অত্যাচার করেছে, ২৪ ঘণ্টা তালা বন্ধ করে রেখেছে জেলের মধ্যে। নারায়ণগঞ্জে মোস্তফা সারওয়ার, শামসুল হক ভূতপূর্ব এম পিএ, হাফেজ মুছা সাহেব, আবদুল মোমিন এডভোকেট, ওবায়দুর রহমান, শাহাবুদ্দিন চৌধুরীর মতো নেতৃবৃন্দকে ‘সি’ ক্লাস করে রাখা হয়েছে। কি করে এই সরকার সভ্য সরকার বলে দাবি করতে পারে আমি ভেবেও পাই না!

…ভাবি শুধু আমার সহকর্মীদের কথা। এক এক জনকে আলাদা আলাদা জেলে নিয়ে কিভাবে রেখেছে? ত্যাগ বৃথা যাবে না, যায় নাই কোনোদিন। নিজে ভোগ নাও করতে পারি, দেখে যেতে নাও পারি, তবে ভবিষ্যৎ বংশধররা আজাদী ভোগ করতে পারবে। কারাগারের পাষাণ প্রাচীর আমাকেও পাষাণ করে তুলেছে। এ দেশের লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মা-বোনের দোয়া আছে আমাদের উপর। জয়ী আমরা হবই। ত্যাগের মাধ্যমেই আদর্শের জয় হয়।…

৭ই জুন ১৯৬৬ ॥ মঙ্গলবার
সকালে ঘুম থেকে উঠলাম। কি হয় আজ? আবদুল মোনায়েম খান যেভাবে কথা বলছেন তাতে মনে হয় কিছু একটা ঘটবে আজ। কারাগারের দুর্ভেদ্য প্রাচীর ভেদ করে খবর আসলো দোকান-পাট, গাড়ি, বাস, রিকশা সব বন্ধ। শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল চলেছে। এই সংগ্রাম একলা আওয়ামী লীগই চালাইতেছে। আবার সংবাদ পাইলাম পুলিশ আনছার দিয়ে ঢাকা শহর ভরে দিয়েছে। আমার বিশ্বাস নিশ্চয়ই জনগণ বে-আইনী কিছুই করবে না। শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করার অধিকার প্রত্যেকটি গণতান্ত্রিক দেশের মানুষের রয়েছে। কিন্তু এরা শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করতে দিবে না। আবার খবর এল টিয়ার গ্যাস ছেড়েছে। লাঠি চার্জ হতেছে সমস্ত ঢাকায়। আমি তো কিছুই বুঝতে পারি না। কয়েদিরা কয়েদিদের বলে। সিপাইরা সিপাইদের বলে। এই বলাবলির ভিতর থেকে কিছু খবর বের করে নিতে কষ্ট হয় না। তবে জেলের মধ্যে মাঝে মাঝে প্রবল গুজবও রটে।
অনেক সময় এসব গুজব সত্যই হয়, আবার অনেক সময় দেখা যায় একদম মিথ্যা গুজব। কিছু লোক গ্রেফতার হয়ে জেল অফিসে এসেছে। তার মধ্যে ছোট ছোট বাচ্চাই বেশি। রাস্তা থেকে ধরে এনেছে। ১২টার পরে খবর পাকাপাকি পাওয়া গেল যে হরতাল হয়েছে, জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করেছে। তারা ছয়দফা সমর্থন করে আর মুক্তি চায়, বাঁচতে চায়, খেতে চায়, ব্যক্তি স্বাধীনতা চায়। শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি, কৃষকের বাঁচবার দাবি তারা চায়-এর প্রমাণ এই হরতালের মধ্যে হয়েই গেল।

এ খবর শুনলেও আমার মনকে বুঝাতে পারছি না। একবার বাইরে একবার ভিতরে খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে আছি। বন্দি আমি, জনগণের মঙ্গল কামনা ছাড়া আর কি করতে পারি! বিকালে আবার গুজব শুনলাম গুলি হয়েছে, কিছু লোক মারা গেছে। অনেক লোক জখম হয়েছে। মেডিকেল হাসপাতালেও একজন মারা গেছে। একবার আমার মন বলে, হতেও পারে, আবার ভাবি সরকার কি এতো বোকামি করবে? ১৪৪ ধারা দেওয়া হয় নাই। গুলি চলবে কেন? একটু পরেই খবর এল ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। মিটিং হতে পারবে না। কিছু জায়গায় টিয়ার গ্যাস মারছে সে খবর পাওয়া গেল।
বিকালে আরও বহুলোক গ্রেফতার হয়ে এল। প্রত্যেককে সামারী কোর্ট করে। সাজা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। কাহাকেও একমাস, কাহাকে দুই মাস। বেশির ভাগ লোকই রাস্তা থেকে ধরে এনেছে শুনলাম। অনেকে নাকি বলে রাস্তা দিয়া
যাইতেছিলাম ধরে নিয়ে এল। আবার জেলও দিয়ে দিল। সমস্ত দিনটা পাগলের মতোই কাটলো আমার। তালাবদ্ধ হওয়ার পূর্বে খবর পেলাম নারায়ণগঞ্জ, তেজগাঁ, কার্জন হল ও পুরানা ঢাকার কোথাও কোথাও গুলি হয়েছে, তাতে অনেক লোক মারা গেছে।

বুঝতে পারি না সত্য কি মিথ্যা। কাউকে জিজ্ঞাসা করতে পারি না। সেপাইরা আলোচনা করে, তার থেকে কয়েদিরা শুনে আমাকে কিছু কিছু বলে।
তবে হরতাল যে সাফল্যজনকভাবে পালন করা হয়েছে সে কথা সকলেই বলছে। এমন হরতাল নাকি কোনোদিন হয় নাই, এমনকি ২৯শে সেপ্টেম্বরও না। তবে আমার মনে হয় ২৯শে সেপ্টেম্বরের মতোই হয়েছে হরতাল।

গুলি ও মৃত্যুর খবর পেয়ে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছে। …কি হবে? কি হতেছে? দেশকে এরা কোথায় নিয়ে যাবে, নানা ভাবনায় মনটা আমার অস্থির হয়ে রয়েছে। এমনিভাবে দিন শেষ হয়ে এল। মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা জেলে আছি। তবুও কর্মীরা, ছাত্ররা ও শ্রমিকরা যে আন্দোলন চালাইয়া যাইতেছে, তাদের জন্য ভালবাসা দেওয়া ছাড়া আমার দেবার কিছুই নাই।

মনে শক্তি ফিরে এল এবং আমি দিব্যচোখে দেখতে পেলাম ‘জয় আমাদের অবধারিত। কোনো শক্তি আর দমাতে পারবে না।’ …

দৈনিক আজাদ পত্রিকা সংবাদ পরিবেশন ভালই করেছে, ‘আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আজ প্রদেশে হরতাল’। হরতালকে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য আওয়ামী লীগের একক প্রচেষ্টা। প্রোগ্রামটাও দিয়েছে ভাল করে। পাকিস্তান অবজারভার হেড লাইন করেছে ‘হরতাল’ বলে। খবর মন্দ দেয় নাই। মিজানের বিবৃতিটি চমৎকার হয়েছে। হলে কি হবে ‘চোরা নাহি শোনে ধর্মের কাহিনী’।

৮ই জুন ১৯৬৬ ॥ বুধবার
ভোরে উঠে শুনলাম সমস্ত রাত ভর গ্রেফতার করে জেল ভরে দিয়েছে পুলিশ বাহিনী। সকালেও জেল অফিসে বহু লোক পড়ে রয়েছে। প্রায় তিনশত লোককে সকাল ৮টা পর্যন্ত জেলে আনা হয়েছে। এর মধ্যে ৬ বৎসর বয়স থেকে ৫০ বছর বয়সের লোকও আছে। কিছু কিছু ছেলে মা মা করে কাঁদছে। এরা দুধের বাচ্চা, খেতেও পারে না নিজে। কেস টেবিলের সামনে এনে রাখা হয়েছে। সমস্ত দিন এদের কিছুই খাবার দেয় নাই। অনেকগুলি যুবক আহত অবস্থায় এসেছে। কারও পায়ে জখম, কারও কপাল কেটে গিয়াছে, কারও হাত ভাঙ্গা এদের চিকিৎসা করা বা ঔষধ দেওয়ার কোনো দরকার মনে করে নাই কর্তৃপক্ষ। গ্রেফতার করে রাখা হয়েছিল অন্য জায়গায়, সেখান থেকে সন্ধ্যার পর জেলে এনে জমা দেওয়া শুরু করে। দিনভরই লোক আনছিল, অনেক। কিছু সংখ্যক স্কুলের ছাত্রও আছে। জেল কর্তৃপক্ষের মধ্যে কেহ কেহ খুবই ভাল ব্যবহার করেছে। আবার কেহ কেহ খুবই খারাপ ব্যবহারও করেছে। বাধ্য হয়ে জেল কর্তৃপক্ষকে জানালাম, অত্যাচার বন্ধ করুন। তা না হলে ভীষণ গোলমাল হতে পারে। মোবাইল কোর্ট করে সরকার গ্রেফতারের পরে এদের সাজা দিয়ে দিয়েছে। কাহাকেও তিন মাস, আর কাহাকেও দুই মাস, এক মাসও কিছুসংখ্যক ছেলেদের দিয়েছে। সাধারণ কয়েদি, যাদের মধ্যে অনেকেই মানুষ খুন করে অথবা ডাকাতি করে জেলে এসেছে তারাও দুঃখ করে বলে, এই দুধের বাচ্চাদের গ্রেফতার করে এনেছে! এরা রাত ভর কেঁদেছে। ভাল করে খেতেও পারে নাই। এই সরকারের কাছ থেকে মানুষ কেমন করে বিচার আশা করে?
জেল কর্তৃপক্ষ কোথায় এত লোকের জায়গা দিবে বুঝে পাই না! ছোট ছোট ছেলেদের আলাদা করে রাখতে হয়। এরা জেলে আসার পরে খবর এল ভীষণ গুলিগোলা হয়েছে, অনেক লোক মারা গেছে তেজগাঁ ও নারায়ণগঞ্জে। সমস্ত ঢাকা শহরে টিয়ার গ্যাস ছেড়েছে, লাঠিচার্জও করেছে। চুপ করে বসে নীরবে সমবেদনা জানান ছাড়া আমার কি করার আছে! আমার চরিত্রের মধ্যে ভাবাবেগ একটু বেশি। যদিও নিজকে সামলানোর মতো ক্ষমতাও আমার আছে। বন্দি অবস্থায় এই সমস্ত খবর পাওয়ার পরে মনের অবস্থা কি হয় ভুক্তভোগী ছাড়া বুঝতে পারবে না।

… ২টার সময় কাগজ এল। আমি পূর্বে যা অনুমান করেছি তাই হলো। কোনো খবরই সরকার সংবাদপত্রে ছাপতে দেয় নাই।
ধর্মঘটের কোনো সংবাদই নাই। শুধু সরকারি প্রেস নোট। ইত্তেফাক, আজাদ, অবজারভার সকলেরই একই অবস্থা। একেই বলে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা! ইত্তেফাক মাত্র চার পৃষ্ঠা। কোনো জেলার কোনো সংবাদ নাই। প্রতিবাদ দিবস ও হরতাল যে পুরাপুরি পালিত হয়েছে বিভিন্ন জেলায় সে সম্বন্ধে আমার কোনো সন্দেহ রইল না।

খবরের কাগজগুলি দেখে আমি শিহরিয়া উঠলাম। পত্রিকার নিজস্ব খবর ছাপতে দেয় নাই। তবে সরকারি প্রেসনোটেই স্বীকার করেছে পুলিশের গুলিতে দশজন মারা গিয়াছে। এটা তো ভয়াবহ খবর। সরকার যখন স্বীকার করেছে দশজন মারা গেছে, তখন কতগুণ বেশি হতে পারে ভাবতেও আমার ভয় হলো! কত জন যখম হয়েছে সরকারি প্রেসনোটে তাহা নাই। সমস্ত দোষই যেন জনগণের। যেখানে উসকানি দিতেছে সরকারের প্রতিনিধিরা, আওয়ামী লীগ সেখানে পরিষ্কার ভাষায় বলে দিয়েছে, শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ দিবস পালন করতে চাই। এবং সে অনুযায়ী তারা কর্মীদের নির্দেশও দিয়েছে। এখন জনগণকে দোষ দিয়ে লাভ নাই। যেখানে পুলিশ ছিল না সেখানে কোনো গ-গোল হয় নাই। চকবাজার ও অন্যান্য জায়গায় শান্তিপূর্ণভাবে ধর্মঘট হয়েছে। সে খবর পেয়েছি।

বেলা ১১টার সময় ১৪৪ ধারা জারি করে আর সাথে সাথে গুলি শুরু হয়। পূর্বে জারি করলেই তো কর্মীরা আর জনসাধারণ জানতে পারতো। যখন আওয়ামী লীগ তার প্রোগ্রাম খবরের কাগজে বের করে দিল তাতে পরিষ্কার লেখা ছিল, ১০টায় শোভাযাত্রা, বিকালে সভা শেষে আবার শোভাযাত্রা। তখন তো ১৪৪ ধারা জারি করে নাই। পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় সরকারের দালালেরা ও কিছুসংখ্যক অতি উৎসাহী কর্মচারী কোনো এক উপর তলার নেতার কাছ থেকে পরামর্শ করে এই সর্বনাশ করেছে।
সরকার যদি মিথ্যা কথা বলে প্রেসনোট দেয়, তবে সে সরকারের উপর মানুষের বিশ্বাস থাকতে পারে না। জীবন ভরে একই কথা শুনিয়াছি আত্মরক্ষার জন্যই পুলিশ গুলি বর্ষণ করতে বাধ্য হয়। এ কথা কেউ বিশ্বাস করবে? যারা মারা গেল তাদের ছেলেমেয়ে, মা-বাবা তাদের কি হবে? কত আশা করে তারা বসে আছে, কবে বাড়ি আসবে তাদের বাবা। কবে আসছে তাদের ছেলে। রোজগারের টাকা আসবে মাসের প্রথম দিকে। এরা জেলে বন্দি, সহসা আর ফিরে যাবে না, টাকাও আর পৌঁছবে না সংসারে। একথা ভেবে ভীষণভাবে ভেঙে পড়েছি আমি। কিছুতেই মনকে সান্ত¦না দিতে পারছি না। কেন মানুষ নিজের স্বার্থের জন্য পরের জীবন নিয়ে থাকে?

তবে এদের ত্যাগ বৃথা যাবে না। এই দেশের মানুষ তার ন্যায্য অধিকার আদায় করবার জন্য যখন জীবন দিতে শিখেছে তখন জয় হবেই, কেবলমাত্র সময় সাপেক্ষ। শ্রমিকরা কারখানা থেকে বেরিয়ে এসেছে। কৃষকরা কাজ বন্ধ করেছে। ব্যবসায়ীরা দোকান পাট বন্ধ করে দিয়েছে। ছাত্ররা স্কুল কলেজ ছেড়েছে। এতবড় প্রতিবাদ আর কোনোদিন কি পাকিস্তানে হয়েছে?
ছয় দফা যে পূর্ব বাংলার জনগণের প্রাণের দাবি-পশ্চিমা উপনিবেশবাদী ও সাম্রাজ্যবাদীদের দালাল পশ্চিম পাকিস্তানের শোষকশ্রেণী যে আর পূর্ব বাংলার নির্যাতিত গরীব জনসাধারণকে শোষণ বেশি দিন করতে পারবেনা, সে কথা আমি এবার জেলে এসেই বুঝতে পেরেছি। বিশেষ করে ৭ই জুনের যে প্রতিবাদে বাংলার গ্রামে গঞ্জে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ফেটে পড়েছে, কোনো শাসকের চক্ষু রাঙানি তাদের দমাতে পারবে না। পাকিস্তানের মঙ্গলের জন্য শাসকশ্রেণীর ছয়দফা মেনে নিয়ে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করা উচিত।
যে রক্ত আজ আমার দেশের ভাইদের বুক থেকে বেরিয়ে ঢাকার পিচঢালা কাল রাস্তা লাল করল, সে রক্ত বৃথা যেতে পারে না। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য যেভাবে এ দেশের ছাত্র-জনসাধারণ জীবন দিয়েছিল তারই বিনিময়ে বাংলা আজ পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা। রক্ত বৃথা যায় না। যারা হাসতে হাসতে জীবন দিল, আহত হলো, গ্রেফতার হলো, নির্যাতন সহ্য করল তাদের প্রতি এবং তাদের সন্তান-সন্ততিদের প্রতি নীরব প্রাণের সহানুভূতি ছাড়া জেলবন্দি আমি আর কি দিতে পারি! আল্লাহর কাছে এই কারাগারে বসে তাদের আত্মার শান্তির জন্য হাত তুলে মোনাজাত করলাম। আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, এদেও মৃত্যু বৃথা যেতে দেব না, সংগ্রাম চালিয়ে যাবো। যা কপালে আছে তাই হবে। জনগণ ত্যাগের দাম দেয়। ত্যাগের মাধ্যমেই জনগণের দাবি আদায় করতে হবে।

সমস্ত দিন পাগলের মতোই ঘরে বাইরে করতে লাগলাম। যদি কেহ বন্দি পশুপক্ষী দেখে থাকেন তারা অনুভব করতে পারবেন। শত শত লোককে গ্রেফতার করে আনছে। তাদের দুরবস্থা চিন্তা করতে ভয় হয়। রাস্তায় যাকে পেয়েছে তাকেই গ্রেফতার করে নিয়ে এসেছে। খালি গা-কাপড় নাই, একদিন একরাত পর্যন্ত থানায় বা অন্য কোথাও আটকাইয়া রেখেছিল। খাবারও দেয় নাই। গোসল নাই। সাজা দিয়ে নিয়ে এসেছে। এদের কিছু লোককে কয়েদির কাপড় পরাইয়া দিয়েছে। আমি যেখানে ছিলাম তার পার্শ্বেই পুরানা বিশ সেলে রাতে ৮২ জন ছেলেকে নিয়ে এসেছে, বয়স ১৫ বৎসরের বেশি হবে না কারও। অনেকের মাথায় আঘাত। অনেকের পায়ে আঘাত, অনেকে হাঁটতে পারে না। হাকিম বাহাদুর বোধ হয় কারও কথা শোনেন নাই, জেল দিয়ে চলেছেন। রাতে জানালা দিয়ে দেখলাম এই ছেলেগুলিকে নিয়ে এসেছে। দরজা বন্ধ। জানালা দিয়ে চিৎকার দিয়ে বললাম, ‘‘জমাদার সাহেব এদের খাবার বন্দোবস্ত করে দিবেন। বোধ হয় দুই দিন না খাওয়া।” মানুষ যখন অমানুষ হয় তখন হিংস্র জন্তুর চেয়েও হিংস্র হয়ে থাকে। রাত্রে আমি ঘুমাতে পারলাম না। দুই একজন জমাদার ও সিপাই এদের উপর অত্যাচার করছে। আর সবাই এদের আরাম দেবার চেষ্টা করেছে। কয়েদিরা ছোট ছোট ছেলেদের খুব আদর করে থাকে। নিজে না খেয়েও অনেককে খাওয়াইয়া থাকে। অনেকে নিজের গামছা দিয়েছে। যারা এদের উপর অত্যাচার করেছে তাদের কথা আমার মনে রইলো। নাম আমি লেখব না।
রাত কেটে গেল। একটু ঘুম আসে, আবার ঘুম ভেঙে যায়।

৫.
বঙ্গবন্ধু বন্দিদশার উৎকণ্ঠার মধ্যে ৭ই জুনের হরতালের অনুপুঙ্খ সংবাদ সংগ্রহ করেছিলেন। তেমনি ৮ জুন পেয়েছিলেন তেজগাঁও এবং নারায়ণগঞ্জে কত লোক মারা গেছেন তার সমস্ত বিবরণ।একইসঙ্গে নিজের মা’র অসুস্থতার কথা জানতে পেরে যন্ত্রণা কাতর হয়েছিলেন।তাছাড়া তাঁকে একটি সেলে একাকী রাখায় কারো সঙ্গে কষ্ট শেয়ার করতে পারেননি।ফলে নির্ঘুম রাত কাটে বঙ্গবন্ধুর। যে ছয় দফার জন্য তাঁর এতো আত্মত্যাগ সেই ছয়-দফা শুধু পূর্ব বাংলার বাঁচার দাবি ছিল না, গোটা পাকিস্তানেরই বাঁচার দাবি হিসেবে গণ্য করা হয়েছিল।আসলে তিনি অধিকার বঞ্চিত দেশবাসীর বাঁচার দাবির জন্য সংগ্রাম করার চেয়ে মহৎ কাজ আর কিছুই আছে বলে মনে করতেন না। তিনি বলেছিলেন, যৌবনের কোঠা বহু পিছনে ফেলে প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছেছেন। বাকি জীবনটুকু এদেশের মানুষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি সাধনায় নিয়োজিত করতে চান। আর শেষ পর্যন্ত তা তিনি করেছিলেন বলেই ৭ ই জুনের আগে-পরে তাঁর মনোজগত ছিল রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত।

এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)