যখন আমাদের বাড়ি বানানো হচ্ছিল, প্রায়ই আব্বু বিকেলের দিকে বাসার কাজ কেমন আগাচ্ছে তা দেখার জন্য যেত। আমিও মাঝে মাঝে যেতাম। মাঝে মাঝেই দেখতাম এলাকার পরিচিত মানুষ আসত আব্বুর সাথে দেখা করতে, কথা বলতে। যখন বাড়ির ফাউন্ডেশনের পাইলিং এর কাজ চলছে, তখন মানুষ বলত, ‘এত বড় বড় এতগুলা গাছ দেয়া লাগে নাকি? এখানকার মাটি পাথরের মত শক্ত! ঐখানের অমুক সাহেব ৫ তলা বাড়ি বানাইছে, কিছুই তো লাগেনাই! সব ইঞ্জিনিয়ারদের টাকা খাওয়ার ধান্ধা।’ এরপরে যখন ফাউন্ডেশনের কাজ শেষ করে ছাদ ঢালাইয়ের কাজ চলছিল, তখন কিছু মানুষ এসে বলত, ‘এত মোটা মোটা রড দেয়া লাগে স্যার! আপনি কি দশতলা বিল্ডিং বানাবেন নাকি! পাশের বিল্ডিং যখন বানাইছে তখন তো অনেক চিকন চিকন সুতার মত রড দিয়া বানাইছে, ১০ বছর তো হইয়া গেছে কিছুই হয় নাই। এগুলা আসলে বুঝলেন ঐ ইঞ্জিনিয়াররা রড সিমেন্টের দোকান দিয়া টাকা খায়।’ এরপরে যখন বাড়ির কাজ ৪ তলা পর্যন্ত শেষ হল (বাড়ির ফাউন্ডেশন ছিল ৪ তলার), তখন কিছু মানুষ বুদ্ধি দিল যে ৪ তলার বিল্ডিং এ ৫ তলা তো চোখ বন্ধ করে করা যায়, আর ৬ তলার সামনের সাইড বাদ দিয়া পেছনের সাইডের অর্ধেক কইরেন, তাইলে আর কোন সমস্যা নাই। এই হচ্ছে আমাদের দেশের আম জনতার ইঞ্জিনিয়ারিং জ্ঞানের স্তর। আমাদের এই বোধটুকুই নেই যে একটা বিল্ডিং করতে গেলে সেখানে মাটি পরীক্ষা করে কি পরিমাণ ফাউন্ডেশন লাগবে সেটা নির্ধারণ করা হয়, সেই সাথে বিল্ডিং এর আকৃতি প্রকৃতি ডিজাইনের ওপর নির্ভর করে তাতে কি পরিমাণ এবং কি ধরনের রড, সিমেন্ট, ইট, পাথর লাগবে সেটা ঠিক করা হয়। অনেক মানুষ তো আছে শুধুমাত্র রাজমিস্ত্রীদের উপদেশের ওপর নির্ভর করে বাড়ি বানিয়ে ফেলেন। আর দেশে এই উদাহরণ তো ভুরি ভুরি যে ৬ তলার অনুমতি নিয়ে ৮/১০ তলা বানিয়ে ফেলা। এভাবে আন্দাজে হিসাব ছাড়া ইঞ্জিনিয়ারিং এর কাজ করলে সেখানে প্রয়োজনের অতিরিক্ত রড সিমেন্ট পাইলিং ব্যবহার করা হতে পারে এবং টাকার শ্রাদ্ধ হয়। কিন্তু যখন উল্টাটা হয়? অর্থাৎ প্রয়োজনের চেয়ে কম পাইলিং, রড, সিমেন্ট দিয়ে এভাবে দালান-কোঠা বানানো হয় (বিল্ডিং এ রডের বদলে বাঁশ দেয়ার কথা নাহয় বাদ ই দিলাম), তার ফলাফলে কখনো দেখা যায় দালান ভেঙ্গে পড়ছে, আবার কখনো বা ফাটল ধরছে। আর বাকি যেগুলা দাঁড়িয়ে আছে, সেগুলা আপাতত ঠিক আছে, কিন্তু এর ভয়ংকরতম ফলাফল কখন দেখবেন জানেন? যদি দেশে একটা বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়। তখন দেখবেন কতগুলা বিল্ডিং দাঁড়িয়ে থাকে আর কতগুলা মাটির সাথে মিশে যায়! আমরা কেউই চাই না এরকম হোক, কিন্তু বাংলাদেশের আশেপাশে একটা অনেক বড় ভূমিকম্প যে কোন সময় হতে পারে, পরিসংখ্যান তাই বলে। আর এরকম যদি হয়েই যায়, তখন কিন্তু কান্না কাটি করেও কোন লাভ হবে না!
আমরা জাতিগত ভাবে যতটা না ইঞ্জিনিয়ার, তারচেয়েও বড় ডাক্তার! আমরা পেট ব্যাথা মাথা ব্যাথা হাঁচি কাশি থেকে শুরু করে পারলে ক্যান্সার পর্যন্ত সবকিছুর ঔষধ খাই নিজের বুদ্ধিমত অথবা ফার্মেসীর মানুষটাকে জিজ্ঞেস করে। সামান্য ছোটখাটো অসুখেও আমরা শুরু করি অত্যন্ত শক্তিশালী এন্টিবায়োটিক খেয়ে, আর তারচেয়েও ভয়ংকর কথা আমরা এন্টিবায়োটিকের পুরো কোর্স শেষ না করেই যখন শরীর একটু ভাল লাগে তখন ঔষধ খাওয়া বন্ধ করে দেই। জাতিগত ভাবে আমাদের মধ্যে এই ধারণাই নেই যে এভাবে নিজের ইচ্ছামত যেনতেন ঔষধ খাওয়া যায় না, বিশেষ করে এন্টিবায়োটিক এর মত শক্তিশালী ঔষধ তো নয়ই। একেকটা এন্টিবায়োটিক একেক ধরনের ব্যাকটেরিয়ার ওপর কাজ করে, প্রত্যেকটা এন্টিবায়োটিকের একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ খেতে হয়। এটা অত্যন্ত জটিল বলেই ডাক্তাররা ৫/১০ বছর পড়াশুনা করে তারপরে বুঝতে পারেন যে কখন কি অবস্থায় আপনাকে কোন এন্টিবায়োটিক খেতে হবে, কি পরিমাণ খাবেন, ৬ ঘণ্টা পরে খাবেন নাকি ১২ ঘণ্টা পরে খাবেন, খাওয়ার আগে খাবেন নাকি পরে খাবেন, ৩ দিন খাবেন নাকি ৭ দিন খাবেন। আর কোনকিছু না বুঝে নিজের ইচ্ছামত এসব ঔষধ খেয়ে শুধু যে নিজের ক্ষতি করছি আমরা, তাই নয়, পুরো মানব জাতির ক্ষতি করছি আমরা! আমরা যখন এন্টিবায়োটিক খাই, তখন সেটা আমাদের শরীরের মধ্যের ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, তাদের মেরে ফেলে অথবা খুব দুর্বল করে ফেলে। যদি আমি যতগুলা খাওয়ার কথা ততগুলা না খেয়ে মাঝপথে ঔষধ খাওয়া ছেড়ে দেই, তাহলে ঐ ব্যাকটেরিয়াগুলা আস্তে আস্তে ঐ এন্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার কিছু কিছু কৌশল শিখে ফেলে। এভাবে যখন একটা বড় জনগোষ্ঠী এই কাজ বারবার করতে থাকে, তখন আস্তে আস্তে একটা পর্যায়ে ঐ ব্যাকটেরিয়াগুলো এতটাই শক্তিশালী হয়ে যায় যে প্রচলিত কোন এন্টিবায়োটিক ই আর তার ওপর কাজ করে না। যেমন আমাদের দেশের অনেক মানুষের ওপরই প্রচলিত অনেক এন্টিবায়োটিক এখন আর কাজ করে না, আর বিশ্বে আজকাল বিভিন্ন জায়গায় মাঝে মাঝে কিছু সুপারবাগ (সুপারম্যান এর মত, কল্পনাতীত শক্তিশালী) দেখা যায় যেগুলার ওপর বেশিরভাগ ঔষধ কাজ করে না। এভাবে চলতে থাকলে তার পরিণতি খুবই ভয়ংকর, এখন যে সব রোগ কোন ঔষধ ছাড়াই ভাল হয়ে যায়, সেসব রোগ তখন ভাল করার জন্য হাজার হাজার টাকার ঔষধ খেতে হবে। আর এখন যেসব রোগ ভাল করার জন্য হাজার টাকার ঔষধ খান, তখন সেগুলিতে বাঁচবেন কিনা সেটা নিয়ে সন্দেহ!
এতক্ষণ যা বললাম সেগুলোর পরিণতি বোঝার জন্য হয়ত কিছুটা পড়াশুনার দরকার আছে, কিছুটা চিন্তা ভাবনা করতে হয়, কিন্তু আমরা প্রাত্যহিক জীবনে এমন অনেক বিপজ্জনক কাজ করি যেগুলোর ফলাফল প্রায় সাথে সাথেই দেখা যায়। আমাদের দেশে বেশিরভাগ মানুষ মোটরসাইকেল চালানোর সময় হেলমেট পড়ে শুধুমাত্র ট্রাফিক সার্জেন্টের ভয়ে। আবার পড়লেও শুধু চালক পড়ে, সাথে থাকা যাত্রী পড়েন না। আবার কখনো কখনো হেলমেট ব্যাগে রেখে দেয়, পুলিশ ধরলে বলে, আমার সাথে তো আছে! অথচ মোটরসাইকেল এক্সিডেন্টে বেশিরভাগ মৃত্যু হয় মাথায় আঘাত পেয়ে। অন্যান্য যায়গায় আঘাত পেলে হয়ত গুরুতর আহত হবেন, কিন্তু প্রাণে বেঁচে থাকবেন। আর মাথায় গুরুতর আঘাত পেলে মৃত্যুর সম্ভাবনা অনেক বেশি। এই সামান্য ব্যাপারটুকু আমরা বুঝেও বুঝতে চাইনা, হেলমেট নিয়ে পুলিশের সাথে চোর পুলিশ খেলি! পুলিশের ২০০ টাকা জরিমানা খুব ভয় পাই, কিন্তু হেলমেট না পড়ার কারণে যে নিজের জীবন চলে যেতে পারে সেটার কোন খবর নাই! কি অদ্ভুত আমাদের চিন্তা ভাবনা, কি অদ্ভুত এক জাতি আমরা!
যেই আমরা বিজ্ঞানের ক,খ টাইপের বিষয়ে এরকম আচরণ করি নিজেদের অজ্ঞতার জন্য, সেই আমরা অদৃশ্য করোনা ভাইরাসের ভয়ে লকডাউন বলামাত্র সবাই বাসার ভেতরে যেয়ে বসে থাকব, মাস্ক পড়তে বললে সঠিকভাবে মাস্ক পরে বাইরে বের হব, বাইরে গেলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখব, নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে এই ভাইরাস এক্সপোনেনশিয়াল (সূচকীয়) হারে ছড়ায়, এইসব জটিল বিষয় হঠাৎ করে বুঝে ফেলব সেটা কেবলমাত্র দুরাশা বইকি! এই জটিল বিষয়গুলা যদি একটু সহজ ভাবে আমরা বুঝতে পারি তাহলে হয়ত আমাদের অনেক কাজ করতে সুবিধা হবে।
করোনা ভাইরাস দেখতে অনেকটা ফুটবলের মত, কিন্তু সাইজে অনেক অনেক ছোট। একটা ভাইরাসের ব্যাস মানুষের চুলের প্রস্থের মাত্র ৫০০ ভাগের এক ভাগ, অর্থাৎ ৫০০ টা ভাইরাস পাশাপাশি রাখলে আপনার চুলের প্রস্থের সমান হবে! এই ভাইরাস এতটা ছোট হওয়ার কারণে অতি সহজেই বেশ কিছুক্ষণ বাতাসে ভেসে বেড়াতে পারে। যখন আক্রান্ত ব্যক্তি হাঁচি কাশি দেয়, তখন লাখে লাখে ভাইরাস তার আশেপাশে ভেসে বেড়ায়, অথবা সে যখন স্বাভাবিক শ্বাস প্রশ্বাস নেয় বা কথা বলে তখনও অনেক ভাইরাস বাইরে বের হয়ে আসে। গবেষণায় দেখা গেছে আক্রান্ত ব্যক্তির মোটামুটি ৫/৬ ফিটের মধ্যে এই ভাইরাস বিপজ্জনক মাত্রায় থাকতে পারে। আপনি যখন বাইরে যান তখন কিন্তু জানেন না আপনার আশেপাশে কে আক্রান্ত আর কে আক্রান্ত নয়, এমনকি আপনি নিজেও হয়ত আক্রান্ত হতে পারেন যেটা আপনি জানেন না। যখন আমরা মাস্ক পরি তখন বাইরে থেকে এই ভাইরাস গুলো আমাদের নাকে মুখে সরাসরি ঢুকতে বাঁধা পায়, আবার আমরা আক্রান্ত হলে আমাদের নাক মুখ থেকে বাইরে যেতেও বাঁধা পায়। তাই সবাই যদি বাইরে যাওয়ার সময় মাস্ক পরি, তাহলে একজন মানুষ থেকে আরেকজন মানুষের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কমে যায়। সাধারণ মানুষ হিসেবে আপনার কিন্তু এন৯৫ মাস্ক পরার দরকার নাই, সাধারণ সার্জিক্যাল মাস্ক (নীল রঙের যে মাস্ক গুলা) অথবা বাসায় নরম কাপড় দিয়ে বানানো মাস্ক পড়াই যথেষ্ট। এন৯৫ মাস্ক একটা বিশেষ ধরনের মাস্ক যেটা এমনভাবে বানানো যে এই অতি সূক্ষ্ম ভাইরাসেরও ৯৫ শতাংশের বেশি আটকাতে সক্ষম, এটা পড়বে শুধুমাত্র স্বাস্থ্যকর্মীরা যেমন ডাক্তার, নার্স বা অন্য কেউ যারা সরাসরি রোগীর সংস্পর্শে যাচ্ছেন এবং অনেক সময় কাটাচ্ছেন। তবে মনে রাখতে হবে, যদি একবার ব্যবহার্য মাস্ক পড়েন তাহলে ব্যবহার করার পর সেটা এমন জায়গায় ফেলতে হবে যেন তা থেকে আবার ভাইরাস না ছড়াতে পারে, আর বারবার ব্যবহার্য মাস্ক পড়লে সেটা নিয়মিত ভাল করে সাবান পানি দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। আরেকটা অতি গুরুত্বপূর্ণ কথা, এই ভাইরাস মানুষের শরীরে ঢোকে বা বের হয় নাক, মুখ এবং চোখ দিয়ে। সুতরাং যতক্ষণ পারা যায় কোন ভাবেই আপনার হাত দিয়ে চোখ, নাক, মুখ স্পর্শ করা যাবে না। কারণ বিভিন্ন ভাবে আপনার হাতে এই ভাইরাস আসতে পারে, হয়ত বাজারে গেলেন সেখানে ফলমূল সবজি ধরেছেন, অথবা মুদির দোকান থেকে কোন একটা জিনিস কিনেছেন, অথবা সিঁড়ির হাতলে হাত দিয়ে নেমেছেন, অথবা অফিসের দরজা খুলেছেন, এভাবে অসংখ্য উপায়ে ভাইরাস আপনার হাতে আসতে পারে। এরপরে যদি আপনি সেই হাত দিয়ে নিজের চোখ, নাক বা মুখে হাত দেন, তাহলেই কাজ হয়ে গেল! আবার এর উল্টাটাও হতে পারে, আপনি হয়ত আক্রান্ত কিন্তু জানেন না, আর আপনি নিজের নাকে মুখে হাত দিয়ে তারপর বাইরে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে বিভিন্ন জিনিস স্পর্শ করলেন আর সব জায়গায় ভাইরাস ছড়িয়ে দিয়ে আসলেন। মোদ্দা কথা, মাস্ক পড়তে হবে, নাক মুখ চোখে হাত দেয়া যাবে না, হাঁচি কাশি দেয়ার সময় হাতের তালু মুখের সামনে না এনে হাতের বাহু মুখের সামনে এনে নাক মুখ ঢাকতে হবে, বাইরে থেকে এসে অবশ্যই সাবান দিয়ে ভাল করে হাত ধুয়ে ফেলতে হবে।
গ্লাভস পরলে হাতের ওপরে একটা আবরণের মত থাকে যাতে ভাইরাস আমাদের হাতে সরাসরি লাগতে না পারে। যেমন ডাক্তার যখন একজন আক্রান্ত ব্যক্তির কাছে যাবেন, তার পরীক্ষা করবেন, তখন অবশ্যই গ্লাভস পরে যাবেন। ঐ রোগীর পরীক্ষা করা শেষ হলে পরের রোগীর কাছে যাওয়ার আগে গ্লাভস আবার বদলে নেবেন। তাতে এক রোগী থেকে আরেক রোগীর মধ্যে সংক্রমণের সম্ভাবনা কমে গেল। অথবা যখন সব রোগী দেখা শেষ হয়ে গেল তখন তিনি গ্লাভস টা ফেলে দেবেন যাতে তার নিজের মধ্যে সংক্রমণ না হয়। কিন্তু সাধারণ মানুষ হিসেবে যদি আপনি গ্লাভস ব্যবহার করতে চান, তাহলে গ্লাভস পরার প্রকৃত উদ্দেশ্য ঠিক রেখে সঠিকভাবে গ্লাভস ব্যবহার করা প্রায় অসম্ভব। যেমন কেউ বাজার করতে গেলেন গ্লাভস পরে, যেয়ে ফলমূল শাকসবজি ধরলেন, মাছ মাংস কিনলেন, চালের প্যাকেট ধরলেন, ৪/৫ বার মানিব্যাগ বের করে টাকা দিলেন, মধ্যে কয়েকবার চশমা আর মাস্ক ঠিক করলেন, রিক্সা ভাড়া দিলেন, তারপর বাসায় আসার আগে গ্লাভস টি খুলে ডাস্টবিনে ফেলে বাসায় ঢুকলেন। এই বর্ণনার মাঝে কোন সমস্যা দেখতে পেয়েছেন? খেয়াল করে দেখেন ভাইরাস আপনার হাতে লাগল না, কিন্তু গ্লাভস এ লাগল এবং সেই গ্লাভস দিয়ে আপনি মানিব্যাগ ধরেছেন, টাকা ধরেছেন, বাজারের প্যাকেট ধরেছেন, সেই সাথে চশমা এবং মাস্ক ও ধরেছেন। এই চশমা, মাস্ক, মানিব্যাগ, টাকা সবজায়গায় কিন্তু ভাইরাস লেগে আছে। আপনি যদি সত্যি সত্যিই কার্যকর ভাবে গ্লাভস পরে দৈনন্দিন কাজ করতে চান, তাহলে আপনাকে একটু পরপর গ্লাভস বদলাতে হবে, যেটা আসলে সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব না! সুতরাং আপনার আসলে গ্লাভস পরার দরকার নেই, যখনই সুযোগ পাবেন হাত ধুয়ে ফেলবেন, আর কোনভাবেই নাক মুখ চোখে হাত দিবেন না, বাইরে থেকে এসে তো অবশ্যই সাবান দিয়ে ভাল করে হাত ধুয়ে ফেলতে হবে। এটাই আপনার জন্য সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি।
ঘরবন্দী কেন থাকব? অন্য মানুষের সাথে ৬ ফিট দূরত্ব কেন রাখব?
করোনা ভাইরাস অসম্ভব রকম ছোঁয়াচে এবং কই মাছের প্রাণ। এই ভাইরাস দরজার হাতলে কয়েকদিন বেঁচে থাকতে পারে, টাকায় বেঁচে থাকতে পারে, বাজারের ফলমূল শাকসবজি বা প্যাকেটের গায়ে বেঁচে থাকতে পারে, অফিসের টেবিলের ওপর বেঁচে থাকতে পারে, বাতাসে ভেসে ভেসে বেড়াতে পারে, অর্থাৎ এই ভাইরাস যে কোথায় আছে আর কোথায় নাই সেটা বোঝা একদমই অসম্ভব। তাই যদি একান্ত প্রয়োজন না হয়, তাহলে দয়া করে বাসার মধ্যে থাকুন, ঘরবন্দী থাকুন। আর যদি খুব প্রয়োজনে বাইরে বের হতেই হয়, তাহলে যেখানেই যান না কেন, অফিসে, বাজারে, মসজিদে, আশেপাশের মানুষের থেকে ৫/৬ ফিট দূরত্ব বজায় রাখুন। তাহলে আপনার আশেপাশে অন্য কেউ আক্রান্ত থাকলেও আপনার আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কমে যায়।
১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইন (স্বেচ্ছা নির্বাসন) কেন?
কোন সুস্থ ব্যক্তির যখন কোন করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার সম্ভাবনা থাকে, সেটা হতে পারে সরাসরি সংস্পর্শে আসা অথবা এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাওয়া অথবা অন্য কোন ভাবে, তখন বিশ্বব্যাপী একটা স্বীকৃত ব্যবস্থা হচ্ছে ১৪ দিনের জন্য অন্য সবার সংস্পর্শ এড়ানোর জন্য স্বেচ্ছা নির্বাসনে যাওয়া। কিন্তু কেন ১৪ দিন? কেন ১০ দিন না বা ১৫ দিন না? এটা কি শুধু এমনি এমনি বানানো হইছে?
মানুষের শরীরে যখন কোন ভাইরাস প্রবেশ করে, তখন প্রাথমিক ভাবে কিছু সংখ্যক ভাইরাস থাকে। এরপর সেই ভাইরাস গুলা পরজীবীর মত মানুষের শরীরে বংশবৃদ্ধি করা শুরু করে, এই বংশবৃদ্ধিতে একেক ভাইরাসের একেক রকম সময় লাগে। করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে যে, কারো শরীরে করোনা ভাইরাস ঢুকলে মোটামুটি ১১/১২ দিনের মধ্যে ৯৭% মানুষের মধ্যে লক্ষণ প্রকাশ পায়, আর ১৪ দিনের মধ্যে ৯৯% মানুষের মধ্যে লক্ষণ দেখা দেয়। এখানে লক্ষণীয় যে, ভাইরাস কারো শরীরে প্রবেশ করলেই যে লক্ষণ দেখা দেবে, এমন নয়। বেশিরভাগ মানুষের মধ্যেই (প্রায় ৮০ ভাগ) কোন লক্ষণ দেখা দেয় না বা খুবই মৃদু লক্ষণ থাকে যেটা হয়ত সে বুঝতেও পারে না। কারণ তার শরীরের যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আছে সেটা ঐ ভাইরাসের কার্যকারিতা নিষ্ক্রিয় করে ফেলছে। তাই এই ১৪ দিনের হিসাব হচ্ছে যাদের শরীরে লক্ষণ প্রকাশ পায়, অথবা যারা অসুস্থ হয়ে পড়েন তাদের জন্য।
এ ধরনের ক্ষেত্রে ১০০ ভাগ নিশ্চিত হওয়া খুবই কষ্টকর, তাই ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইন এর মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয় যে যদি এর মধ্যে আপনার শরীরের কোন লক্ষণ দেখা না দেয় তাহলে ৯৯% নিশ্চয়তা দিয়ে বলা যার আপনার মধ্যে আর লক্ষণ দেখা যাবে না।
এই ভাইরাস নাকি এক্সপোনেনশিয়াল (সূচকীয়) হারে ছড়ায়, এর মানে কি?
এক্সপোনেনশিয়াল হারে বৃদ্ধি পাওয়া, বা সূচকীয় বৃদ্ধি পাওয়া ব্যাপারটা মানুষের জন্য কল্পনা করা একটু কঠিন। তাই একটা গল্প দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করি। অনেকদিন আগে এক রাজা ছিল, তার দাবা খেলার খুব শখ। একদিন তিনি দাবা খেলায় তার রাজ্যের এক বুদ্ধিমান লোকের কাছে হেরে গেলেন। তিনি তাকে পুরস্কার দিতে চাইলেন। বললেন, ‘বল তুমি কি চাও? যা চাইবে তাই পাবে তুমি আমার কাছ থেকে’। লোকটি কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, ‘যেহেতু দাবা খেলায় ৬৪টা ঘর, তাই আজকে থেকে আগামী ৬৪ দিন আপনি আমাকে প্রতিদিন ধান দিবেন। শুধু একটা শর্ত আছে, প্রথম দিন ১টা ধান দিয়ে শুরু হবে, কিন্তু এরপর প্রতিদিন আগের দিনের দ্বিগুণ পরিমাণ দিতে হবে।’ রাজা তো এই সামান্য চাওয়া শুনে খুবই অবাক! বললেন, ‘এই সামান্য চাওয়া! তুমি তো আমার কাছে অনেক ধন সম্পদ চাইতে পারতে। তা না করে তুমি এই সামান্য কটা ধান চাচ্ছ? আচ্ছা যাইহোক, তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হবে’। তো এরপর প্রথম দিন ঐ লোক রাজার কাছ থেকে ১টা ধান নিল, দ্বিতীয় দিন নিল ২টা, তৃতীয় দিন ৪ টা…এভাবে কিছুদিন চলার পরে রাজার তো মাথায় হাত! এত ধান কই পাবেন? কেন জানেন?? আপনি অনুমান করতে পারেন ১ মাস পরে রাজার কতগুলা ধান দেয়ার কথা?? ৫৩ কোটির বেশি ধান যা প্রায় ১০ টন ধানের সমান!! ৩১ তম দিনে ২০ টন ধান এবং এভাবে প্রতিদিন দ্বিগুণ হারে!! কল্পনা করতে পারতেছেন ব্যাপারটা?এই একই ঘটনা ঘটে করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে। ইউরোপের বেশিরভাগ দেশে দেখা গেছে এই ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ৩ বা ৪ দিনের মধ্যে ২ গুণ হয়। প্রথম দিকে ১ জন, ২ জন, ৪ জন করে বাড়ে, কিন্তু যখন মোট আক্রান্ত ১ লাখ হয় তখন কি হয়? ৩ দিন পরে ২ লাখ, ৬ দিন পরে ৪ লাখ, ৯ দিন পরে ৮ লাখ, আর ৩০ দিন পরে ১০ কোটির বেশি!!! আর ১০ কোটি মানুষের মধ্যে যদি দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ ও মারা যায়, সেটা প্রায় ৪ লাখ মানুষ! আপনি কি ভয়াবহতা টা বুঝতে পারছেন??
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)