‘নস্টালজিয়া ফেটিসিজম’ নোংরা বদঅভ্যাস। যেমন ‘আহাহা, আমাদের ছোটবেলা… … কী যে ছিল! এখন কি আর সে’সব…’, ‘কালচারাল রোম্যান্টিসিজম’ আরো খারাপ। যেমন ‘হাজার বছরের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য…ব্লা ব্লা ব্লা’! ‘কালচারাল কমোডিফিকেশন’ অশ্লীলতম। যেমন হঠাৎ টাকা হওয়া হঠাৎ জাতে উঠা কেউ চিত্রপ্রদর্শনীতে গিয়ে ‘আহাহা কী দুর্দান্তই না এঁকেছে’ বলে কয়েক লাখ টাকায় কয়েকটি পেইন্টিংসও কিনলেন, কিন্তু মনে মনে বললেন ‘কি ছাতামাতা গু-মুত আঁকছে কয় কিনা অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট!’ বাংলা নববর্ষ উদযাপন পুরোটাই চলে গেছে এই তিন ধরণের সাংস্কৃতিক অতীতগামী, ভাববিলাসী, এবং বেনিয়ার কব্জায়। নৃবিজ্ঞানীরা লোক-উৎসবের যে দু’টি অবধারিত বৈশিষ্ট্যের কথা বলেন— রেজিস্ট্যান্স ও রেসিপ্রসিটি— প্রতিরোধশক্তি ও পারস্পরিকতা— দুইটির একটিও এখন আমাদের লোক-উৎসবের ধারেকাছে নাই।
“স্যাটার্ণালিয়া”বা বিশ্বখ্যাত ‘রোমান হলিডে’ ছিল প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যজুড়ে শস্য-বর্ষবরণ উৎসব। ‘স্যাটার্ণ’ বা শনিদেবতাকে তুষ্ট করলে শস্য ও ধনসম্পদ বাড়বে–শাসকদের এই ধর্মচিন্তাটি ছিল বটে। কিন্তু শনিদেবতা-তুষ্টির চাইতেও খেটে খাওয়া কৃষক-শ্রমিক দাসদের বহুগুণ বেশি তুষ্ট করা; তাদের পরিশ্রমকে সম্মান, শ্রদ্ধা ও স্বীকৃতি দান করা ইত্যাদিই ছিল আসল উদ্দেশ্য। সপ্তাহ জুড়ে দাসেরা মুক্ত থাকত। মনিবদের সঙ্গে অভিন্ন খাবার-পানীয় গ্রহণ করত। নাচ-গান করত। শ্রমজীবীরাও ‘রোমান হলিডে’র দিনগুলো হতে যথাসাধ্য আনন্দ নিংড়ে নিত। ভুলে যেত চাষাবাদকালের রক্ত-ঘাম-কষ্টে ভারপুর পেছনের দিনগুলো। খ্রিস্টীয় ১ম শতক হতে এটি রাজ-রাজড়াদের খবরদারি মুক্ত হয়ে কৃষিজীবীদের উৎসবে পরিণত হয়। শ্রমজীবী কি করল না করল তাদের ব্যাপার, সম্রাট খবরদারি ছেড়ে দিল, কিন্তু আয়োজন-সহায়তা, অর্থকড়ির যোগান দেয়ায় মুক্তহস্ত হয়েছিল। পরবর্তী চারশত বছরে স্যাটার্ণালিয়া আদলের উৎসব পারস্য, ব্যবিলন এবং মিশরেও ছড়িয়ে পড়ে। চীনে এবং ভারতে আরো আগে হতেই ছিল।
উৎসবগুলোতে কৃষি-শ্রমজীবীরা সংহতি বাড়াত; অগ্রিম সতর্ক চোখ রাখত জীবন-জীবিকায় কি কি বাধা আসছে বা আসতে পারে; প্রতিরোধ-উদ্দীপনামূলক গান-বাজনা-নাটক বাঁধত (রেজিস্ট্যান্স)। নিয়মবদ্ধ হল ‘দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে’ সামাজিক বিনিময় (রেসিপ্রসিটি)। ছড়াছড়ি চলত উপহার-উপঢৌকনের। নিয়মবদ্ধ হল উপহার হবে ক্ষেতে-গাছে-ফলানো সবজি-ফলমূল। পকুর-বিলের মাছ। হাতে বানানো কুটিরশিল্প। টাকায় কেনা যাবেনা কিছু। তেলা মাথায় তেল দেয়া যাবেনা। যার ঘরে মাছ নাই মাছওয়ালা তাকে মাছ দেবে। মাছওয়ালার ঘরে লাউ নাই তো লাউওয়ালা তাকে লাউ দিবে। টাকাওয়ালা মেলা-যাত্রাপালা আয়োজন করবে, শিশুদের মাঝে চকোলেট-হাওয়াই মিঠাই বিলাবে, সমাজিদের জন্য মুফতে খাবার যোগাবে আরো কত কি! নৃবিজ্ঞানীরা আরো দেখিয়েছেন সারা বিশ্বে সব সংস্কৃতিতেই ফসলি নববর্ষের চরিত্র মোটামুটি একই রকমের। এক, উৎসবের কেন্দ্র নগর নয়, গ্রামসমাজ-কৃষিসমাজ। দুই, উৎপাদকগণ ও প্রান্তজনই চালিকাশক্তি। তিন, বাজারি লাভ-লোকসান পয়সা কামানোর ধান্দা সর্বৈব পরিত্যাজ্য।
ব্যুঁউদ্যূ আলজেরিয়ার কাবাইল কৃষক সমাজে ঘরে ঘরে রাখা লোকপঞ্জিকা-দিনলিপির পুংখানুপুংখ ব্যবচ্ছেদ করেছেন। দেখিয়েছেন সাংস্কৃতিক রাজনীতির বিকাশ ও বিনাশ। ফরাসি উপনিবেশকালে শুধু শস্যবর্ষ উদযাপনই নয়, কাবাইল কৃষিজীবী-শ্রমজীবীগণ সারা বছর জুড়েই আত্মপরিচয়গর্বী এবং শোষণবিরোধী উদ্দীপনামূলক নাটক-গান-নাচ উদ্ভাবন করত। শহুরে বুদ্ধিবৃত্তি ও মধ্যবিত্ত সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ কৃষিসমাজে যতই বাড়তে শুরু করল, লোকপঞ্জিকা ততই ছোট হতে লাগল। পুঁজিবাদী দুষ্টচক্রের বাজারদখল, বড় লগ্নি, দাদন, ফড়িয়াগিরি যতই পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগল—লোকপঞ্জিকা হতে নিত্যনৈমিত্তিক সামাজিকতা, আড্ডা, দেখাদেখি, আচার-আর্চ্চা হাসি-ক্রীড়াকৌতুক দ্রুত উধাও হতে থাকল। দ্রুতই অনেক ঘর হতে পঞ্জিকাই উধাও হতে শুরু করল।
এরিক উলফ, এমারসন, এস্কোবার, মৌজলি এবং অন্যান্য নৃবিজ্ঞানীরা লাতিন আমেরিকার কৃষিসমাজ গবেষণায় দেখলেন সমাজটি যতো দ্রুত বাজারি সংস্কৃতির ফাঁদে পড়তে শুরু করল, তারচে’ বহুগুন দ্রুততায় রেজিস্ট্যান্স-রেসিপ্রসিটি হারাতে থাকল। লোক-উৎসবগুলোকে যখনই বাজারি-পুঁজি মুনাফা গিলে ফেলতে থাকল, উপহার পয়সায় কিনতে পারা গেল— কৃষিসমাজগুলো সংহতি, পারস্পরিকতা, লোকসমাজ পরিচিতি (ফোক আইডেন্টিটি) ইত্যাদি হারাতে থাকল। হয়ে উঠতে লাগল থাকল প্রান্তিক বর্গ— অসংগঠিত, দরিদ্র, শোষিত, পরাধীন, শক্তিহীন ও প্রতিরোধক্ষমতাহীন ক্লান্তিন্যুব্জ মূক-বধির-ভাষাহীন মানুষের দল।
চার-পাঁচ দশক আগেও বাংলাদেশের গ্রামসমাজে ঘরঘর লোকপঞ্জিকা ও দিনপঞ্জির ব্যবহার ছিল। সে’সব চর্চা এখন বিলুপ্তপ্রায়। হালখাতা উৎসবও বিলুপ্তির পথে। স্বল্প পরিসরে কোথাও থাকলেও প্রাণহীন, রং-বর্ণহীন হয়ে উঠছে দ্রুতই। একই দশা নৌকা বাইচ, কুস্তি-কাবাডি-বলিখেলা ঘুড়ি উৎসবের। মেলাগুলোতে শহুরে মধ্যবিত্তের দাপট এবং টাকাকড়ির ঝনঝনানি বাড়ছে। দেখতে বাণিজ্য মেলার মত এইসব কর্পোরেট নববর্ষ মেলাগুলোতে কৃষক পরিবারের এবং কৃষিসমাজের অংশগ্রহণ এখন শুন্যের কোঠায়। সাংস্কৃতিক ঠগবাজি (কালচারাল এক্সপ্লয়টেশন) এবং সাংস্কৃতিক তস্করতার (কালচারাল অ্যাপ্রোপ্রিয়েশন) মাধ্যমে নববর্ষ উৎসবকে মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্তের ফাঁপা সাংস্কৃতিক ভাবালুতা প্রদর্শনের মাধ্যম করে তোলার মধ্যে লোকসংস্কৃতির বিকৃতকরণ আছে, সুকৃতিকরণ নাই।
পরিবর্তনের হাওয়া ঠেকানোর কথা হচ্ছেনা। ক্লাসিক্যাল গ্রামসমাজই এখন আর নাই— এই সত্যটিও অস্বীকার করার নয়। কৃষকের হাতের মোবাইল ফোন, টিভি-ফ্রিজ কেনার ক্রয়ক্ষমতা কেড়ে নিতেও বলা হচ্ছেনা। ভাবতে বলা হচ্ছে গ্রামসমাজে, কৃষিজীবী সমাজে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যের মাধ্যমে বিশেষ অর্থায়নে ঐতিহ্যের স্মারক হালখাতা, নৌকাবাইচ, কুস্তি-কাবাডি-বলিখেলা, পাঁচন রান্না, পিঠাপুলি উৎসব, ঘুড়ি উৎসবসহ অন্যান্য রীতি-আর্চ্চাকে পূণরুজ্জীবিত করার অত্যাবশ্যক চেষ্টাটি না করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজন সাংস্কৃতিক ঠগবাজির চূড়ান্ত মাত্র! এই নিরর্থক নির্দেশ যদি আগামী বছর আরেকটি নিরর্থক নির্দেশের জন্ম দেয়— যেমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পান্তা-পোড়ামরিচের ব্যবস্থা রাখতে হবে—অবাক হওয়ার কিছু থাকবে কি? নববর্ষ আসলে কী— নতুন প্রজন্মকে তা শেখানো পড়ানোর বদলে শোভাযাত্রা এবং পান্তা-মরিচ ধরণের সংকীর্ণতাবাদী সরু সুড়ঙ্গে ঢুকিয়ে দেয়াকে ‘সংস্কৃতিচর্চা’ বলার বেনিয়া ‘কালচারাল রোম্যান্টিসিজম’ ধ্বংস হোক, নিপাত যাক।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)