মারিয়া হেলেনা সেমেডো: ২১ মার্চ (রোববার) আন্তর্জাতিক বন দিবস ঘোষণা করা হয়েছে। ভূমির ৩ ভাগের একভাগ অঞ্চল দখল করে থাকা মহামূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ বনভূমি নিয়ে এভাবে বাড়তি মনোযোগ দেয়ার এর থেকে বড় উপলক্ষ্য আর কখনো ছিলো না।
বনের কাছে আমরা অনেক ঋণী। গত বছর থেকে তো বনই আমাদের করোনা মহামারীর মধ্যেও নিরাপদ ও সুস্থ রাখছে।
আমাদের অনেকেই কাগজ এবং কার্ডবোর্ড থেকে তৈরি প্রয়োজনীয় বনজ পণ্যের উপর নির্ভর করে, তার মধ্যে ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম এবং হোম ডেলিভারির জন্য প্যাকেজিংও রয়েছে। আর অন্যদের জন্য বন বাইরে ব্যায়ামের জায়গা করে দিয়েছে, ফলে আমাদের স্বাস্থ্য এবং প্রফুল্লতা বেড়েছে।
কিন্তু বিশ্বের ভঙ্গুর জনগোষ্ঠীর জন্য বন গুরুত্বপূর্ণ সুরক্ষা জাল হিসেবে কাজ করেছে। তাদেরকে খাবারের উৎস ও আয়ের সুযোগ করে দিয়েছে যখন সরবরাহের শৃঙ্খলা ব্যহত হয়েছে তখনও।
তা ছাড়া কিছু সুবিধাতো আমরা বরাবরই বনের কাছ থেকে পাই। যেমন: কার্বন শোষণ করা, পানি বিশুদ্ধ করা, এক বিলিয়নেরও বেশি লোকের জন্য খাদ্য, জ্বালানী এবং ঔষধি গাছ সরবরাহ করা এবং আরও কয়েক লক্ষ মানুষের জীবিকার ব্যবস্থা করা।
করোনাভাইরাস মহামারী আমাদের নতুন করে বুঝিয়েছে যে প্রাণী, মানুষ এবং পরিবেশের স্বাস্থ্য পরস্পরের সাথে সম্পর্কযুক্ত। আমাদের বুঝতে হবে বন উজাড় করা এবং বনভূমির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের ফলে প্রাণী থেকে মানুষে জীবাণুজনিত রোগের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়।
উদ্ভূত সংক্রামক রোগগুলির প্রায় ৭০ শতাংশ এবং সাম্প্রতিক প্রায় সবগুলো মহামারীর উদ্ভব প্রাণী থেকেই, বিশেষত বন্যজীবন থেকেই হয়েছিল।
যখন ফসলের জন্য জমি বা চারণভূমি সম্প্রসারণের জন্য বন কেটে ফেলা হয়, যখন বিলাসবহুল খাবার হিসাবে বন্য মাংসের চাহিদা বাড়িয়ে তোলার ফলে মানুষ, পশু এবং বন্যজীবনের মধ্যে শোষণ বৃদ্ধি পায় তখনই পরবর্তী বড় মহামারী ঝুঁকিও বেড়ে যায়।
তাই বার্তাটি খুবই পরিস্কার: সুস্থ বন মানেই সুস্থ মানুষ।
এখনও আমাদের বনভূমি অনেক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বিগত ৩০ বছরে আমরা বন উজার ও বনের অন্য ব্যবহারের মাধ্যমে ৪২০ মিলিয়ন হেক্টর বন হারিয়েছি। প্রাথমিকভাবে যা শুরু হয়েছিলো কৃষি সম্প্রসারণের মাধ্যমে।
এই ধ্বংসের মাধ্যমে ঝুঁকিতে পড়েছে বিশ্ব জনগণের স্বাস্থ্য, নির্গমণ হচ্ছে বিশ্ব উষ্ণায়নের গ্যাস, বিলুপ্তির হুমকিতে পড়ছে গাছ ও প্রাণী, আর যাদের জীবনযাপন বনের উপর নির্ভরশীল তারাও ঝুঁকিতে পড়ছে।
তাই বন রক্ষায় বা আমাদের সুস্থ রাখতে আমরা কী করতে পারি?
প্রথমত, আমাদের বনকে কৃষিতে পরিণত করার অনুশীলন বন্ধ করতে হবে। সেই সঙ্গে স্বীকার করতে হবে যে বন কাটা ছাড়াই বর্ধমান বিশ্ব জনসংখ্যাকে খাওয়ানো সম্ভব।
দ্বিতীয়ত, আমাদের অবশ্যই অবৈধ বন্যজীবন বাণিজ্যের বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। বন্য প্রাণীরা লক্ষ লক্ষ আদিবাসী এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের খাদ্য ও আয়ের এক অপরিহার্য উত্স সেটাকে সম্মান করতে হবে।
তৃতীয়ত, স্বাস্থ্যকর বাস্তুসংস্থান পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করতে আমাদের বিশ্বের বন এবং ল্যান্ডস্কেপ পুনরুদ্ধারে বিনিয়োগ করতে হবে। যা এই বছরের আন্তর্জাতিক বন দিবসের কেন্দ্রবিন্দু।
বর্তমানে প্রায় ২ বিলিয়ন হেক্টর যেটা চীনের আকারের প্রায় দ্বিগুণ অধ:পতিত হয়ে আছে বাড়তি ব্যবহার, খরা এবং অস্থিতিশীল অরণ্য এবং জমি ব্যবস্থাপনার অভ্যাসের কারণে। তবে সুখবরটা হচ্ছে আমরা চাইলে এসব অধ:পতিত জমিকে বৃহত্তরভাবে আবার পুনরুদ্ধার করতে পারি।
আফ্রিকান ইউনিয়নের নেতৃত্বে দি গ্রেট গ্রিন ওয়াল ফর দি সাহারা এবং সাহেল ইনিশিয়েটিভ তার একটি উদাহরণ। ২০৩০ সালের মধ্যে তারা আফ্রিকার শুকনো অঞ্চল জুড়ে ১০০ মিলিয়ন হেক্টর পুনরুদ্ধার করার লক্ষ্যে স্থানীয় গাছের প্রজাতি এবং গাছপালা, সবুজ ল্যান্ডস্কেপ করার পরিকল্পনা নিয়েছে। সেখানে ২৫০ মিলিয়ন টন কার্বন আলাদা করা হবে এবং ১০ মিলিয়ন সবুজ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হবে।
আর বিশ্বব্যাপী উচ্চাকাঙ্খার লক্ষ্যও নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে ৩৫০ মিলিয়ন হেক্টর পুনরুদ্ধারের আহ্বান জানিয়েছে বন চ্যালেঞ্জ।
এরই মধ্যে ৬০ টি দেশ ও প্রতিষ্ঠান ভারতের আকারে তিনভাগের ২ ভাগ ২১০ মিলিয়ন হেক্টর অধ:পতিত ভূমি পুনরুদ্ধারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। লক্ষ্যগুলি পূরণের জন্য এবং প্রতিশ্রুতি কার্যকর করার জন্য আমাদের গতি বাড়ানো দরকার।
‘বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধারে জাতিসংঘের এক দশক’ শুরু হচ্ছে এ বছরই। এটি কয়েক মিলিয়ন হেক্টর জুড়ে বন পুনরুদ্ধারের উপযোগী সুযোগ, সেই সঙ্গে অধ:পতিত জমি নিরাময়ের জন্যও। এটি করোনাভাইরাস মহামারী থেকে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে সহায়তা করার পাশাপাশি সবুজ কাজ এবং আয়-উত্পাদনের সম্ভাবনাগুলি পুন:স্থাপনে অনেক সুযোগও তৈরি করেছে।
আমাদেরও মনে রাখা উচিত যে প্রতিটি গাছই বিশেষ। ছোট আকারের রোপণ এবং পুনরুদ্ধার প্রকল্পগুলি মানব স্বাস্থ্যের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। শহুরে সবুজতা নির্মল বাতাস তৈরি করে, ছায়া সরবরাহ করে এবং সেসবই শহরের মানুষের মানসিক ও শারীরিক সুস্থতার জন্য উপকারী। আমাদের প্রত্যেকের বাড়ির উঠোন থেকে কমিউনিটি বাগানে ক্ষুদ্র স্তরে হলেও পার্থক্য আনার সুযোগ রয়েছে।
চলুন এই আন্তর্জাতিক বন দিবসেই আমাদের বন পুনরুদ্ধারের এবং আমাদের সকলের জন্য একটি স্বাস্থ্যকর বিশ্ব তৈরির জন্য একটি নতুন শুরুর সূচনা করি।
লেখক: জাতিসংঘের ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশনের(এফএও) ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল।