ওই সমাজে বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হলে কাউকে জানানোর রেওয়াজ নেই। ওখানে ধর্ষণ এখনও উহ্য হয়ে আছে। শ্লীলতাহানী বলে কিছুই নেই। মেয়েরা ছেলেরা মিলে ডেটিং করে, পার্টি করে, ঘন্টার পর ঘন্টা সময় কাটায় অন্যরকমভাবে। বাবারা মায়েরাও এভাবেই সময় কাটায়। শুনেছি এই ঢাকা শহরে মাঝ বয়সী প্রতিষ্ঠিত নারীদেরও ক্লাব আছে। তারা তরুণ শিকার করে, টাকা পয়সা দেয়। আর পুরুষের তো ক্লাবের অভাব নেই। ধণাঢ্য পরিবারের ছেলেরা চাইলে নিজের ঘরেই মদ বা শিশা বার, ডিসকোসহ ভোগ বিলাসের যাবতীয় আয়োজন গড়ে তুলতে পারে। পশ্চিমা সংস্কৃতির এই ভোগ ও অন্ধ আরামের দিকগুলো এখন আমাদের সমাজেও সমানভাবে বর্তমান।
এখানে এক শ্রেনীর তরুণ ক্লান্তি দূর করে আরব শেখদের মতো ভোগ বিলাসিতায়। তাদের পৃথিবীর সব খোলামেলা সংস্কৃতি রপ্ত করা সারা। উন্নত দেশগুলোতে গিয়ে মোজ মাস্তি করে নিজের দেশেও তারা স্বর্গরাজ্য বানানোর স্বপ্ন নিয়ে আসে। জাতিগত নিজস্বতায় এরা বিশ্বাসী নয়। এরা চায় আমেরিকানদের মতো স্মার্ট হতে, ইউরোপিয়দের মতো উদার হতে, আরবদের মতো ভোগবাদী হতে, আফ্রিকানদের মতো হিংস্র আর বণ্য হতে। এরা নিজেদেরকে ভুলে গেছে এখন।
ইউরোপ আমেরিকায় বাল্যবেলাতেই যৌনশিক্ষা বাধ্যতামূলক আর বিপরীত লিঙ্গের বন্ধু প্রাথমিক শ্রেনী থেকেই মিলিয়ে দেয়া হয়। ভোগবাদিতার গুরুত্বই বংশানুক্রমিকভাবে বোঝানো হয়। এসব আমাদের নয় শুধু এই উপমহাদেশের মানুষের জন্যই স্বর্গীয় এক ব্যবস্থা। আমাদের বিত্তবানরা বিদেশে গিয়ে এই সমাজেরই নির্যাস নিয়ে আসে। এই সমাজের শিক্ষাই পরিবারে চালু করে। যে কারণে এই বাংলাদেশেও ঘরে ঘরে বিকৃত উদারতার চর্চা শুরু হয়েছে। এই উদারতার মধ্যে একটি ছেলে আর একটি মেয়ের যেকোন সম্পর্ককে পারিবারিকভাবে যেমন অতি অভিষিক্ত করা হয়। একইভাবে অতি তিরস্কারও করা হয়। কখনো কখনো তাদের সম্পর্কচ্ছেদটিও উদযাপন করা হয়। যাকে বলা হয় ‘ব্রেক আপ’। এই সংস্কৃতির এক জ্বালামুখ হচ্ছে আমাদের টেলিভিশন। পশ্চিমা আর ভারতীয় সংস্কৃতির মিশেলে এক ধরনের মিশ্রভাষার জীবন সংস্কৃতি তৈরি করা হয়েছে। যেখানে পার্টি কালচার, যৌনাচারসহ নানা ভোগ উপভোগের বিষয় উপস্থাপন করা হয় নৃত্য গীত সহযোগে। আমরা গা এলিয়ে দিয়ে এসবকে বরণ করছি উদযাপন করছি ও লালন করছি। এর মধ্য দিয়েই আমাদের সমাজ সত্যে পিছিয়ে যাচ্ছে। অবাধে ধর্ষণ ও যৌনাচার চলছে। অধিকাংশ ধর্ষণ হয়তো চাপাই থেকে যাচ্ছে। কারণ, সমাজের আইন প্রশাসনের কার্যক্রমের স্তর আর বিত্তের ভারে লাগামহীন ও বেসামাল পরিবারের জীবন সংস্কৃতির স্তর এক নয়, একইভাবে উন্নয়নের স্বপ্নে ও দাপটে পাল্টে যাওয়া প্রশাসনে নিম্ন মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত সংস্কৃতির রাখঢাক মার্কা মূল্যবোধের স্তরও ভিন্ন। এ কারণে একটি সমাজে শত অপরাধ মুখ বুজে সহ্য করার চর্চা যেমন চালু রয়েছে আরেকটি সমাজে শত অপরাধ অবাধে চালিয়ে যাওয়ার মতো বেপরোয়া গতিও রয়েছে। এর মাঝে রয়েছে প্রশাসন। তারা চাইলেই বেপরোয়া স্তরকে নীচে নামিয়ে আইনের কব্জায় আনতে যেমন পারে না, একইভাবে পারে না মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তের গোপন যন্ত্রণাগুলোকে সামনে এনে কোনো ব্যবস্থা নিতে।
এই যখন অবস্থা তখন একমাস পরে হলেও বনানী ধর্ষনের ঘটনায় ধর্ষিত বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীর দৃঢ় মনোভাব ও আইনী লড়াইয়ে অংশগ্রহণ একটি দৃষ্টান্তমূলক ঘটনা। এটি একটি আশাবাদ ও সাহসের নজির। এই দৃষ্টান্ত আমাদের সমাজের সব মেয়েদের জন্য যেমনি একটি প্রেরণা ও সাহসের সূত্রমুখ, একইভাবে উপরতলার মানুষ, যারা লুট করা অর্থের ভারে ধরাকে সরা জ্ঞান করতে শিখেছে তাদের জন্য সতর্ক সংকেত।
বলা বাহুল্য, আমাদের সমাজে বহুমুখি ধর্ষণ চালু রয়েছে। রাজনীতিতে রয়েছে, গণমাধ্যমে রয়েছে, অফিস সংস্কৃতিতে রয়েছে। এটি অনেকটাই সবার জানা বিষয়। তথ্য প্রমাণের কথা বললেও খোঁজ পাওয়া যাবে। কিন্তু বিষয়গুলোকে এড়িয়ে যাওয়া হয়। চাকরির প্রলোভনে র্ধষণ, চাকরি জীবনে অবস্থান উন্নতির শর্তে ধর্ষণ থেকে শুরু করে শুধু মনিবের দৈহিক মনোরঞ্জনের চাকরি করেন এমনও মেয়েও রয়েছেন। তারা একথা কাউকে বলেন না। তারা চেপে যান। গুমরে গুমরে এগুলো সহ্য করেন। এর ভেতরেই সম্পর্ক করেন, বিয়ের স্বপ্ন দেখেন, বিয়েও করেন। তখন তারাই এসবকে জীবনের বাস্তবতা হিসেবে গ্রহণ করেন। পাপ পূণ্যের বিচারে গিয়ে হয়তো মনে করেন রোজগারের জন্য যা করতে বাধ্য হতে হয়েছে তা তো পাপ নয়। অবশ্য এটি অন্য বিতর্ক। প্রশ্ন হচ্ছে গুমরে সহ্য করার বিষয়।
সকল ক্ষেত্রেই নারীদেরকে অশুভ প্রস্তাবের বা ইশারার শিকার প্রতিদিনই হতে হয় সে কথা তো বলাই বাহুল্য। এই তো সেদিন এক পুলিশ কনস্টেবল আত্মহত্যা করলেন একজন সাব ইন্সপেক্টর দ্বারা ধর্ষিত হয়ে। ওই পুলিশ কনস্টেবল একজন আইন শৃংখলা রক্ষাকারী। তিনি জানতেন, অপরাধের বিচার চাইতে হয়। কিন্তু তিনি যখন একজন পুরুষের অসৎ লালসার শিকার হয়েছেন, তখন তিনি হয়ে পড়েছেন অসহায় এক নারী। যেখানে দাঁড়িয়ে তার বারবারই হয়তো মনে হয়েছে, কোনো কোনো বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে। বিচার চাওয়া মানে সমাজের কাছে নিজের কলঙ্কিত চেহারাটি উন্মোচন করা । তার চেয়ে এই নিষ্ঠুর ও নষ্ট পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়াই ভালো। এই বুঝে হয়তো আত্মহত্যার পথটিই তার কাছে সহজ ও সরল মনে হয়েছে। কিন্তু তিনি তো চলে গেছেন, তিনি কি অন্য নারী পুলিশ কনস্টেবলকে এমন ধর্ষণের হাত থেকে রক্ষা করে যেতে পারলেন? তিনি কি একা এমন ধর্ষণের শিকার ? সারাদেশের কতজন নারী পুলিশ কনস্টেবল তার উর্ধ্বতন পুরুষের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারছেন, কতজন ধর্ষিত হয়ে মেনে নিচ্ছেন সহজ সূত্রের মতো, এই হিসাব কি কারো কাছে আছে?
এখানেই বনানী ধর্ষণের শিকার ছাত্রীটি বা ছাত্রীরা আলাদা। তারাই এই সমাজের অন্ধকারে একটি আলোর কুপি ধরেছেন। এবার সমাজের পতঙ্গ খুঁজে বের করার দায়িত্ব আমাদের।
উদাহরণের তো অভাব নেই। স্কুলে শিক্ষক দ্বারা ছাত্রী ধর্ষণ হচ্ছে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণ হচ্ছে, হাসপাতালে ধর্ষন হচ্ছে, ডাক্তার ধর্ষিত হচ্ছে, নার্স ধর্ষিত হচ্ছে, বিনোদন কেন্দ্রে ধর্ষণ হচ্ছে, বাসে ধর্ষণ হচ্ছে। কোনো কোনো ঘটনা নানাভাবে জানাজানি হচ্ছে। বেশিরভাগই থাকছে অজানা। সাতপাঁচ ভেবে এমন অন্যায়কে চেপে যাচ্ছে ধর্ষিত ও তার পরিবার । তথাকথিত উপরতলা বা বিত্তশালীদের মধ্যে এগুলো গায়ে না মাখার রীতি রয়েছে কিংবা প্রতিশোধের জন্য টাকা, অস্ত্র, ভাড়াটে সন্ত্রাসীর ব্যবহারের রেওয়াজ রয়েছে। কিন্তু ধর্ষকের স্বরূপ উন্মোচনের কোনো ব্যবস্থা নেই। একজন নারীকে প্রতারণার জালে ফেলে কুপোকাত করে সে অবলীলায় শুধু পারই পেয়ে যাচ্ছে না এ সমাজকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তার অপরাধ সম্প্রসারিত করে চলেছে। এর পেছনে আইন প্রশাসনেরও বড় এক দায় রয়েছে। বিচার না পেতে পেতে মানুষ যেমন সবকিছুর প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলছে, একইভাবে মামলা ও অভিযোগ গ্রহণের প্রক্রিয়াগুলো প্রাচীন হওয়ার কারণে ভুক্তভোগী বা পুলিশ কারো জন্যই ব্যাপারটি সাবলীল নয়। যেমন বনানীর ধর্ষণের ঘটনার ক্ষেত্রেও দেখা গেছে পুলিশ মামলা গ্রহণ করতে চায়নি, সহযোগিতা দূরের কথা অসহযোগিতা করেছে। পূর্বাপর আরো কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনাতেও পুলিশের এমন অসহযোগিতাসুলভ নিস্পৃহ ও আইনবিরোধী ভূমিকা দেখা গেছে। সাধারণত এমন ঘটনাই ঘটে।
ভুক্তভোগীদের পক্ষে আইনী সহায়তা আদায় করা বেশ কঠিন। এতে ভুক্তভোগীর পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে যায়। সে যখন নিজের জীবন, ভবিষ্যৎ, সম্ভ্রম এসব চিন্তাকে তু্চ্ছ করে মানুষ হিসেবে বিচারের প্রার্থনার জন্য গিয়ে এভাবে উপেক্ষিত হয়, তখন তার তার সামনে কোনো দরজাই খোলা থাকে না। তাহলে সে কি আত্মহত্যার পথকেই বেছে নেবে? এক্ষেত্রে আত্মহত্যা মানে অন্যায়কে মেনে নেয়া আর বিচারের পথকে রুদ্ধ করে দেয়া। তাই যে জীবনের ব্যাপকতা বুঝে এমন একটি অন্যায়ের বিচারের জন্য শেষ দিন পর্যন্ত লড়ে যাবার চিন্তা করবে, সে এই সমাজের আলোকবর্তিকা। তার কাছে সমাজের অনেক আশা অনেক আস্থা জমা হচ্ছে। সে আজ পৃথিবীর প্রতারিত ও ধর্ষিত নারী সমাজের প্রতিনিধি, যারা বিচার চাইতে পারেনি, বিচার পায়নি বা আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে।
ওই মেয়েটির প্রতিবাদী তৎপরতার কারলেই একটি ধর্ষণের সামনে পেছনের অপরাধ ও অপরাধী তৎপরতা সম্পর্কেও দেশবাসীর ধারণা হচ্ছে। এখানে ক্ষমতার কাছাকাছি বিপুল অংকের টাকাও সক্রিয় রয়েছে। একটি ধর্ষণের পেছনে সুদীর্ঘ এক অপরাধের পথ রয়েছে। রয়েছে কালো টাকা, রাষ্ট্রের কর ফাঁকি, লুটতরাজ, ক্ষমতার ব্যবহার অপব্যবহারের অজস্র দৃষ্টান্ত। রয়েছে একটি চক্র, সিন্ডিকেট তথা একটি বেপরোয়া সমাজের উত্থানের উপাখ্যানও। যে বেপরোয়া সমাজ থেকেই দিলদারের মতো বাবা আর সাফাতের মতো সন্তানের জন্ম হয়। যে সমাজের আশ্রয় প্রশ্রয়ে নাঈম আশরাফের মতো বদমাশ নানা ছদ্মবেশে বড়ে উঠছে। এদের সংখ্যা এখন কত তা আমরা জানি না। তবে এদের সঙ্গে সরকারের এমপি মন্ত্রী থেকে শুরু করে প্রশাসনের যোগাযোগ ও মাখামাখি রয়েছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। ক্ষমতার কাছাকাছি না থাকলে বিপুল পরিমাণ সম্পদের পাহাড় যেমন গড়া যায় না একইভাবে মানবতা ও সামাজিক শৃংখলাকে এভাবে উপেক্ষা করা যায় না।
বনানীর ধর্ষনের ঘটনা হয়ে উঠুক একটি মাইলফলক। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই শুরু হোক সমাজের তথাকথিত উঁচু তোলার কেঁচো খোড়ার কাজ। তাহলে স্বাধীনতার পয়তাল্লিশ বছরে যত বিষধর সাপ তৈরি হয়েছে তার যেমন সন্ধান মিলবে একইভাবে আমাদের মিলবে অনেক অজানা অন্ধকার পথের সন্ধান। সে সঙ্গে এই ঘ্টনাটি থেকে একটি সাহসের জন্ম হোক সর্বত্র। কোন মেয়েই যেমন তার সঙ্গে কারোর অশোভন আচরণ, যৌন হয়রানি বা ধর্ষণের ঘটনায় আইনের আশ্রয় নিতে দ্বিধান্বিত, শংকিত বা সংশয়গ্রস্থ না হন। একটি সমাজের বিকাশের পথে এসব অপরাধ চাপা থাকা বড় অকল্যাণ। চাপা অপরাধই সমাজকে নরক বানিয়ে রেখেছে। এক্ষেত্রে পুলিশ প্রশাসনেও আন্তরিকতা যেমন দরকার দরকার অবকাঠামোগত ও প্রযুক্তিগত সুবিধা বাড়ানো। দেশের নারী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোকেও এক্ষেত্রে আরো সক্রিয়, সংঘবদ্ধ ও শক্তিশালী হওয়া দরকার।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)