বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকে দেশে ‘নষ্ট নির্বাচনী সংস্কৃতি’ শুরু হয়। জিয়াউর রহমান এবং হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ হ্যাঁ-না ভোট দিয়ে নিজেদের অবৈধভাবে দখল করা ক্ষমতা হালাল করার চেষ্টা করেছিলেন। সাধারণ মানুষ সেই হ্যাঁ-না ভোটে অংশ না নিলেও বাক্স ভরিয়ে তাদের দখলকৃত ক্ষমতা সিদ্ধ করার অপচেষ্টা হয়েছে। পরবর্তীতে সেসব সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন সর্বোচ্চ আদালত।
নির্বাচন কমিশন সরাসরি ভোটের মাধ্যমে গঠন করার রেওয়াজ কোন দেশে আছে বলে শুনিনি। সকল দেশেই রাষ্ট্রপতি অথবা পার্লামেন্ট নির্বাচন কমিশন গঠন করে থাকেন। তা হলে আমাদের এখানে নির্বাচন কমিশন গঠন করার সময় এলে তা নিয়ে প্রতিবার এত রাজনীতি হয় কেন? হয় একটা কারণে। আর সেটা হচ্ছে নির্বাচনের ফলাফলের উপর কমিশনের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করার একটা ব্যবস্থা রাখার জন্য।
৯০’র আন্দোলনের মাধ্যমে এরশাদকে হটিয়ে দেয়ার মাধ্যমে সে পর্বের সমাপন হবার প্রত্যাশা থাকলেও ৯১ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে বেগম জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি আবারো পুরনো সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনে মাগুরা উপ-নির্বাচনে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে মাগুরার উপ-নির্বাচন একটি কলঙ্কিত অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। বেগম জিয়া ১৯৯৫ সালে তাঁর সরকারের কার্যকাল শেষ হওয়ার পরে সাংবিধানিক পদ্ধতিতে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে টালবাহানা করেছেন , আওয়ামী লীগ যাতে ক্ষমতায় আসতে না পারে তার জন্য এমনকি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করেছেন বলে জনশ্রুতি আছে। এরপর তিনি ১৯৯৬ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারিতে একটি একদলীয় নির্বাচন দিয়ে নির্বাচনী ইতিহাসে আরেকটি ব্যর্থ অধ্যায় সংযোজন করেছেন। পরবর্তীতে সে নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদ ভেঙ্গে দিতে তিনি বাধ্য হন।
২০১০ সালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুসরণ করে সংবিধান থেকে বিতর্কিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করলে আবারও নির্বাচনী সংকট দেখা দেয়। একদিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং অন্যদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হওয়ায় জামায়াত-বিএনপি জোট রাজনৈতিক ক্ষমতা হারানোর ভয়ে এবং ইসলামী প্রজাতন্ত্র কায়েমের উদ্দেশ্যে ব্যপক সহিংসতার আশ্রয় নেয়। সে সহিংসতায় ভীত না হয়ে আওয়ামী লীগ নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় রেখে ১৪ সালের ৫ জানুয়ারী নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশনকে সর্বাত্বক সহায়তা প্রদান করে। নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করা বিএনপি এবং নির্বাচনে অযোগ্য জামায়াত একত্রিত হয়ে নির্বাচনে নিয়োজিত কর্মচারি ও কর্মকর্তাদের হত্যা করে; নির্বাচনী কেন্দ্র হিসেবে ঘোষিত পাঁচ শতাধিক স্কুল জ্বালিয়ে দিয়ে নির্বাচন বানচালের ব্যর্থ চেষ্টা করে। নির্বাচন বানচালে ব্যর্থ হয়ে রাজনীতির মাঠ থেকে ছিটকে পড়ে বিএনপি, জামায়াত। ২০০৯ সালে গঠিত আওয়ামী লীগ সরকার আমলে ৭,০০০ সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও, ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পরে অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদ এবং তারও পরে অনুষ্ঠিত পৌরসভা এবং ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি; সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য হয়নি। এরকম পরিস্থিতে আগামী জাতীয় নির্বাচন সর্বজন গ্রহণযোগ্য করার একটা তাগিদ লক্ষ্য করা যাচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মধ্যে। সর্বশেষ দলীয় সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী সে রকম কথাও বলেছেন। দুই বছর আগে থেকেই নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে বলেছেন দলীয় নেতা কর্মীদের।
একই তাগিদ রয়েছে বিএনপি’র। ১৩ থেকে ১৫ সাল সময়কালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বাধা দেওয়া, যুদ্ধাপরাধীদের রাজবন্দী হিসেবে প্রচার করা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করার জন্য জামায়াতের ধ্বংসাত্বক কর্মকাণ্ডে সমর্থন দেয়া, এবং সরকার পতনের ব্যর্থ আন্দোলন করতে গিয়ে ব্যপক সহিংস ঘটনাবলী, বিশেষ করে পেট্রোল বোমা মেরে মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করায় তাদের গ্রহণযোগ্যতা অনেক কমে গিয়েছে। এই সুযোগে বর্তমান সরকার তাদের সভা-সমাবেশের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার সুযোগ পেয়েছে; বিএনপি দুর্বল হয়ে পড়েছে।
রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত নির্বাচন কমিশনকে তারা বিতর্কিত করে আগামী নির্বাচনের সময়ে নির্বাচন কমিশনের উপর বাড়তি চাপ রাখার চেষ্টা শুরু করেছে। ইতোমধ্যে তারা নব নিযুক্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে শপথ না নেয়ার আহবান জানিয়েছে।
নির্বাচন কমিশনকে বিতর্কিত করে যদি তারই অধীনে নির্বাচনে অংশ নিতে হয় তাহলে বিএনপি’র একটা অজুহাত আগে থেকে তৈরী করা থাকল। যদি তারা নির্বাচনে হেরে যান তবে নির্বাচন কমিশনের উপর দায় চাপানোর সুযোগ পাবেন। বিএনপি’র এই কৌশল বুমেরাং হতে পারে যদি তারা নির্বাচনে জিতে যান। তখন অহেতুক নির্বাচন কমিশনকে দায়ী করার জন্য তাদের সমালোচনার মুখোমুখি হতে হবে। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বলা যায় যে আগামী জাতীয় নির্বাচনে তাদের জিতে আসার সম্ভাবনা কম। সে বিষয় বিবেচনায় রেখেই হয়ত তারা নির্বাচন কমিশনকে বিতর্কিত করে আগাম অজুহাত সৃষ্টির ব্যবস্থা করছেন। এই অজুহাত সৃষ্টির আরেকটি পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হচ্ছে ‘নষ্ট নির্বাচনী সংস্কৃতি’ থেকে বের হয়ে আসার সুযোগ কমে যাওয়া।
বাস্তবিক কারণেই এই দুই শিবিরের মধ্যে বর্তমান পরিস্থিতিতে আস্থার সম্পর্ক সৃষ্টি হতে পারে না। আস্থার সম্পর্ক সৃষ্টি করতে হলে বিবাদমান বিষয়গুলো দুর করতে হবে। বিবাদমান বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে যুদ্ধাপরাধী, মৌলবাদী, জঙ্গিবাদী জামায়াতে ইসলামী এবং বিএনপি’র শীর্ষ নেতৃত্ব। জামায়াতের উপর ভর করে রাজনীতি করা বেগম খালেদা জিয়া ও তাঁর জামায়াত আবৃত পুত্র তারেক রহমান (যিনি নিজে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে আদালতে যথেষ্ট প্রামাণাদী দাখিল করা হয়েছে) যতদিন বিএনপি’র নেতৃত্বে থাকবেন ততদিন আওয়ামী লীগের সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক সৃষ্টি হতে পারে না। আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব বদলালেও অনাস্থার সম্পর্কের সুরাহা হবার কোন লক্ষণ নেই।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)