৩ জুলাই ভোর বেলা ডানপন্থী লেখক, দার্শনিক ফরহাদ মজহার নিখোঁজ হন বলে তার পরিবারের লোকেরা পুলিশকে জানিয়েছে। সেদিন সন্ধ্যার দিকে গণমাধ্যম জানাচ্ছিল যে খুলনা শহরে র্যাব-পুলিশ তাকে উদ্ধারের চেষ্টায় যৌথ অভিযান চালাচ্ছে। রাত ১১:৩০ মিনিটে তাকে যশোরের অভয়নগর থেকে চলন্ত বাস থামিয়ে উদ্ধার করে পুলিশ ও র্যাব। অপহরণের কিছুক্ষণ পর ভোর ৫:২৯ মিনিটে তিনি তার জীবনসঙ্গীকে ফোন করে অপহরণের কথা জানান। মুক্তিপণ দেবার জন্য তিনি স্ত্রীকে সকাল ৬:২১ মিনিটে মোবাইল ফোনে ৩০-৩৫ লক্ষ টাকা জোগাড় করতে বলেন। পরে টাকার অঙ্ক ২৫ লাখে নামিয়ে আনেন। সারাদিন তিনি ৬/৭ বার পরিবারের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন। সর্বশেষ ফোন করেছেন সন্ধ্যা ৭:৩০ মিনিটে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানতে পারার কিছু সময়ের মধ্যেই তাকে খুঁজে পেতে জোড় তৎপরতা শুরু করে। সারাদিন তার টেলিফোন ট্র্যাক করে পুলিশ জানতে পারে যে তাকে শ্যামলী থেকে গাবতলী-মানিকগঞ্জ-পাটুরিয়া-ফরিদপুর-যশোর হয়ে খুলনা নিয়ে গেছে অপহরণকারীরা। ফরহাদ মজহারের ফোন কিছু সময়ের জন্য বন্ধ আবার কিছু সময়ের জন্য খোলা পাওয়া যায়। রাতে তাকে উদ্ধার করা হলে পরের দিন তিনি ঢাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে জানান, চোখের সমস্যার জন্য ঔষধ কিনতে শ্যামলীর ২৪/৭ নামের একটি ওষুধের দোকানে যাওয়ার সময়ে তিনজন অপরিচিত লোক তাকে জোড় করে মাইক্রোবাসে তুলে ফেলে। সেখানে আরও ২/৩ জন আগে থেকেই বসা ছিল। অপহরণকারীরা তার চোখ বেঁধে ফেলে। এর পর থেকে তিনি আর কিছু জানেন না। সন্ধ্যায় ছেড়ে দেয়ার পর দেখেন তিনি খুলনায়। ফরহাদ মজহার আরও জানান, তার হাতে অপহরণকারীরা হানিফ এন্টারপ্রাইজের একটি বাসের টিকিট ধরিয়ে দেয়।টিকিটে ক্রেতার নাম ‘গফুর’ লেখা।তার সঙ্গে থাকা ব্যাগের ভেতরে ১৫ হাজার টাকাও তারা ধরেনি।
কেন, কারা এই অপহরণের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে -এমন প্রশ্নে ফরহাদ মজহার বলেন, সরকারকে বিব্রত অবস্থায় ফেলার জন্য কেউ বা কারা এ ঘটনায় জড়িত থাকতে পারে।কারণ অপহরণকারীরা টাকার জন্য তাকে অপহরণ করেনি।কোনো কিছু না নিয়ে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।মাইক্রোবাসে তার কাছে অপহরণকারীরা কোনো ব্যাপারে কিছু জানতে চায়নি।তিনি শুধু দ্রুত ছাড়া পেতে চেয়েছেন।আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর এক প্রশ্নে ফরহাদ মজহার বলেন, বাসা থেকে বের হওয়ার সময় অন্যান্য দিন যে ব্যাগ নিয়ে থাকেন একই ব্যাগ তার সঙ্গে ছিল।একই মোবাইল ফোনসেটও ছিল।
ফরহাদ মজহারকে কে বা কার তুলে নিয়ে গিয়েছিল না-কি তিনি নিজেই অপহরণ নাটক সাজিয়েছেন তা পরিষ্কার হচ্ছে না। বেশ কিছু পরস্পর বিরোধী বক্তব্য পাওয়া গেছে গণমাধ্যমে; বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। ফরহাদ মজহার কি নিজের বা পরিবারের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিজেই কেনেন? এরকম টুকটাক কাজের জন্য কি তার সহযোগী নেই? ভোর ৫টার সময়ে ঔষধ কেনা কি জরুরী ছিল? ঔষধ জরুরী হলেতো তা ফুরিয়ে যাবার আগে থেকেই আরেকটা ঘরে মজুদ রাখার কথা। ঔষুধ কেনার জন্য কি অত ভোরে ব্যাগ গুছিয়ে জামাকাপড়, মোবাইল ফোন, ফোনের চার্জার, টুকিটাকি জিনিসপত্র, নগদ পনের হাজার টাকা নিয়ে যাওয়ার দরকার ছিল?
ফরহাদ মজহার স্বেচ্ছায় ঘর থেকে বেড়িয়েছেন। কেউ তাকে জোড় করে ঘর থেকে বের করেনি। তার বাড়ির সিসিটিভি ক্যামেরায় তা ধরা পড়েছে। তার পরিবার-পরিজনেরা বলেছেন, তিনি সকাল ৮/১০টার আগে ঘর থেকে বেড় হন না। অথচ ঐদিন তিনি ভোর ৫:০৫ মিনিটে বেড় হয়েছেন। ঔষধ কিনতে কেউ জামাকাপড়, মোবাইল ফোনের চার্জার নিয়ে বেড় হয় না; তিনি বেড়িয়েছেন। চোখের একটা ঔষধ কিনতে ১৫ হাজার টাকা লাগার কথা নয়; তিনি সঙ্গে ১৫ হাজার টাকা নিয়েছেন। এসবের মানে এই দাঁড়ায় যে তিনি কারো সঙ্গে পূর্বযোগাযোগ অনুসারে ঘর থেকে বেড় হয়েছেন। তিনি যার ডাকে বেড়িয়েছেন তিনি নিশ্চয়ই তার আস্থাভাজন ব্যাক্তি। আস্থাভাজন না হলে তিনি অপরিচিত কারো ডাকে কেন ঘর থেকে বেড় হবেন?
ফরহাদ মজহারের জবানবন্ধি অনুসারে, দিনের বেলা তাকে চোখ বেঁধে মাইক্রোবাসে করে ঢাকা থেকে খুলনা নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মাইক্রোবাসে স্বচ্ছ গ্লাস থাকে। দীর্ঘ পথে, ফেরীতে চোখ বেঁধে কাউকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দেখলে জনগণ হৈ চৈ বাঁধিয়ে দিত। নিদেনপক্ষে কেউ না কেউ নিকটস্থ থানায় জানাত। এর কোনটি ঘটেনি। এত বড় ঝুঁকি কোন ধরনের অপহরণকারী নেবে না। তার মানে দাঁড়ায়, তিনি অপহরণকারীদের সঙ্গে বোঝাপড়া করেই খুলনা গিয়েছেন; চোখ বাঁধা অবস্থায় নয়, চোখ খোলা অবস্থায় দীর্ঘ যাত্রা করেছেন; তাকে কোথায় কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তা তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন; যারা তাকে অপহরণ করেছে তাদেরকে তিনি দীর্ঘক্ষণ দেখেছেন; আবার দেখলে চিনতে পারবেন। তিনি কার সঙ্গে বা কি কারণে অপহরণকারীর সঙ্গে বোঝাপড়া করবেন?
বিএনপি নেতা রিজভী আহমেদের বক্তব্য অনুযায়ী যদি তাকে সরকারী কোন বাহিনীর লোকেরা নিয়ে গিয়ে থাকেন তাহলে কেন তিনি স্বেচ্ছায় নিজ বাসা থেকে সুবহে সাদেকের সময় স্বেচ্ছায় বেড় হলেন? তিনি ঘর থেকে স্বেচ্ছায় বেড় না হলে সরকারী বাহিনী কিংবা অন্যকোন অপহরণকারী তাকে জোড় করে ঘর থেকে বেড় করে নিয়ে আসতে হত। একেবারে ছিচকে টাইপের অপহরণকারী না হলে এটা তাদের জানা থাকার কথা যে তিনি যে বাড়িতে থাকেন সেখানে সিসিটিভি লাগানো আছে। তার অপহরণের আগে কেউ সিসিটিভি বিকল করার চেষ্টাও করেনি। নিজের প্রয়োজন না থাকলে তিনি কারো ডাকে সাড়া দিয়ে এত ভোরে ঘর থেকে বেড় হতেন না। এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে তাকে জোড় করে মাইক্রোবাসে তোলার দরকার হয়নি। তিনি স্বেচ্ছায় ঘর ছেড়েছেন, নিজে গিয়ে মাইক্রোবাসে উঠেছেন। তাকে জোড় করে মাইক্রোবাসে তোলা হয়েছে – এটা মিথ্যা কথা।
তিনি আরও একটি মিথ্যা কথা বলেছেন। ঢাকায় ফেরার জন্য হানিফ পরিবহনের বাসের টিকেট অন্য কেউ কিনে তার হাতে দেয় নি। তিনি নিজে ‘গফুর’ নামে কিনেছেন, একথা জানিয়েছেন বাসের টিকেট কাউন্টারের ম্যানেজার যিনি নিজে বিকেল ৪ টার সময় টিকেটটা ‘গফুর’ নামে বিক্রয় করেছেন। বিকেল চারটার পর তার উপস্থিতি পাওয়া যায় রাত ৮টার দিকে রেস্টুরেন্টে যেখানে তিনি রাতের খাবার খেয়েছেন। হোটেল মালিক এ কথা নিশ্চিত করেছেন গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে। খাবার পর তিনি আবার বাস কাউন্টারে গিয়েছেন মোবাইল ফোন চার্জ করার জন্য। কাউন্টার ম্যানেজার তদন্তকারী কর্মকর্তাকে জানিয়েছে যে তিনি ১০ মিনিটের মত সময় সেখানে মোবাইল চার্জ করে বাসে উঠেছেন। বিকেল ৪টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত তিনি কোথায় ছিলেন? এ প্রশ্নের উত্তর তিনি জবানবন্দিতে দেননি বা পুলিশকে বলেননি।
ফরহাদ মজহার অতীতে বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্কিত কাজ করেছেন, বক্তব্য রেখেছেন, লিখেছেন। একবার আমাদের সময় পত্রিকা তার বক্তব্যকে হেড লাইন করেছিল। প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে তিনি একসঙ্গে ৬৩ জেলায় বোমা হামলা সম্পর্কে বলেছেন, “বোমা হামলাকারীরা সন্ত্রাসী হলে মুক্তিযোদ্ধারাও সন্ত্রাসী”। আরেকবার এক টেলিভিশন টকশোতে বলেছেন,“৭১ টিভির মত চ্যানেলগুলোতে আরও বেশী বেশী বোমা মারা উচিত”। তিনি ১৯৯৪ সালে আনসার বিদ্রোহে উস্কানী এবং ২০০১ সালে রৌমারীতে সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ অভিযোগে তৎকালীন বিএনপি সরকার তাকে গ্রেফতার করেছিল। তিনি মন্দিরে হামলাকারীদের বিপ্লবী বলে সমর্থন করেছেন; ২০১৩ সালের গণজাগরণকে ভিন্ন পথে প্রবাহিত করে জামায়াতের নেতাদের রক্ষা করার জন্য বিএনপি নেতা মাহমুদুর রহমানের সঙ্গে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিলেন। তখন থেকে তাকে হেফাজতে ইসলাম, জামায়াত-শিবির এবং বিএনপি নেতা তারেক রহমানের পরামর্শদাতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৯৭২ সালে কবি হুমায়ুন কবিরের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ আছে। সে সময়ে গোয়েন্দা সংস্থা তাকে গ্রেফতার করেছিল। প্রয়াত কবি আলী আহসান তাকে ছাড়িয়ে আনলে তিনি আমেরিকা পালিয়ে যান।
তার ব্যক্তি জীবনও বিতর্কিত। কখনো প্যান্ট বা পাজামা না পড়ে তিনি সবসময় লুঙ্গি পড়েন। একারণে বর্তমান প্রজন্ম তাকে ‘লুঙ্গি মজহার’ নামে ডাকে। তাকে ‘লুঙ্গি মজহার’ নামে ডাকায় ফেসবুকে উষ্মা প্রকাশ করেছেন তার সমসাময়িক কালের মানুষেরা যারা তাকে ‘ফ্রড মজহার’ নামে ডাকতেন। ফরহাদ মজহারের অন্তর্ধানের পর গণমাধ্যম তার জীবনসঙ্গী সম্পর্কে স্ত্রী শব্দটি ব্যবহার করছে। জনশ্রুতি হচ্ছেঃ ফরহাদ মজহার এবং ফরিদা আখতার বিবাহ নামক বন্ধনে বিশ্বাসী নন। তারা মনে করেন বিবাহ মানুষকে বন্দি করে ফেলে। তাই তারা সামাজিক এবং আইনানুগ বিবাহ না করেও একই সঙ্গে বসবাস করছেন। তাদের এক কণ্যা সন্তান রয়েছে। গণমাধ্যম ফরিদা আখতারকে ‘স্ত্রী’ বলে উল্লেখ করতে পারে কি-না তা নিয়ে আলোচনা চলছে ফেসবুকে; চায়ের আড্ডায়।
উদ্ধার করার পর পুলিশ ও র্যাবের কাছে দেয়া বক্তব্যে এবং ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে ফরহাদ মজহার বেশ কয়েকটি মিথ্যে কথা বলেছেন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত এসব বক্তব্যের অনেক কিছু সংগতিহীন। যে সকল তথ্য গণমাধ্যমে পাওয়া গিয়েছে তা থেকে নিশ্চিতভাবে ধরে নেয়া যায় যে তিনি স্বেচ্ছায় পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ঘর থেক বের হয়েছেন। কাদের সঙ্গে কি পরিকল্পনা করে তিনি ঘর থেকে বেড় হয়েছেন তা এখনো জানা যায়নি। আদৌ জানা যাবে এমন সম্ভাবনা ক্ষীণ। তিনি ইসলামের সঙ্গে কমিউনিজম মিলিয়ে এক ধরণের সশস্ত্র বিপ্লবের কথা বলেন, লেখেন। ইসলামী চরমপন্থিদের পক্ষে তিনি গণমাধ্যমে কথা বলেন। বিভিন্ন জঙ্গি গ্রুপের সঙ্গে তার যোগাযোগ থাকাটা স্বাভাবিক। এরকম কোন গ্রুপের সঙ্গে কোন বিষয়ে লেনদেনে বনিবনা হওয়া বা না হওয়ার কারণে তার একদিনের অন্তর্ধানের রহস্য লুকিয়ে আছে-এ রকম কিছু শুনলে অবাক হবো না।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)