গত ১৫ মার্চ চ্যানেল আই অনলাইনের মতামত বিভাগে জাহিদ রহমানের একটি লেখা পড়ার দুর্ভাগ্য আমার হয়েছিল। সেই লেখাটি আমার হৃদয়ে এতটাই কুঠারাঘাত করে যে, এই কয়েক দিনেও লেখাটি ভুলতে পারিনি। বাধ্য হয়ে কলম ধরলাম, কিছু কথা লিখে যদি ভেতরটা খানিক হালকা হয়!
১৫ মার্চ এর সেই লেখাটির শিরোনাম ছিলো, ‘বীর উত্তম কাদের সিদ্দিকী কেন অসত্য বিক্রি করেন?’। আগ্রহ নিয়েই পড়তে শুরু করেছিলাম। আর মনে মনে ভাবছিলাম, এবার বোধহয় কাদের সিদ্দিকীর কিছু প্রকৃত দোষের কথা জানবো। কিন্তু হায়! লেখাটি পড়ে আমি হতাশ হতে বাধ্য হলাম। মারাত্মক আক্রমণাত্মকভাবে, প্রচণ্ড বিষেদাগারে, মিথ্যাচার এবং অসংলগ্ন তথ্যে লেখক একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার চরিত্র হননে লিপ্ত হয়েছেন বলেই আমার মনে হয়েছে। লেখাটি ২য় এবং ৩য় বার মনযোগসহ পড়ার পর আমার সহসাই দুটি বিষয় মনে হতে লাগলো: প্রথমত, লেখক জাসদের ঘোরতর সমর্থক। দ্বিতীয়ত, লেখাটি একটি ফরমায়েশি বিষেদাগার বৈ আর কিছু নয়।
আমি প্রাণের তাগিদেই সেই লেখার অসঙ্গতিগুলো তুলে ধরছি।
সেই লেখাটির প্রথম স্তবকে লেখক লেখেন, “বঙ্গবীর খ্যাত কাদের সিদ্দিকী বরাবরই বিতর্কিত কথার তুফান তুলতে ভীষণ পছন্দ করেন। প্রায়শই তিনি এই কাজটি করে গণমাধ্যমের খোরাক হন। তার অনেক বক্তব্যেই যেমন সত্য-মিথ্যা কিছুই মেলে না, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনারও সঙ্গতি খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে তার বক্তব্যে বরাবরই ভীষণ রকম আত্মঅহমিকা, ঔদ্ধত্য দেখতে পাওয়া যায়। ভাবটাও এমনভাবে প্রদর্শন করেন যে তিনি যা বলছেন সেটাই সত্য ইতিহাস এবং সেটাই মেনে নিতে হবে।”
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, একজন বীর উত্তম সম্পর্কে করা এহেন মন্তব্যের পক্ষে লেখক কোন সূত্র বা যুক্তি প্রমাণ উপস্থাপন করেননি। লেখক কতটা অপেশাদার হলে বলেন যে, কাদের সিদ্দিকী গণমাধ্যমের খোরাক হওয়ার জন্য বিতর্কিত বক্তব্য দেন! তিনি হয়তো জানেন না যে, কাদের সিদ্দিকীর নতুন করে পরিচিতি পাবার কিছু নেই। নিজেদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মিডিয়ার কাভারেজ তো তারাই পেতে চায়, যাদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষ অজ্ঞ। কাদের সিদ্দিকীর পরিচয় দেশের ১৭ কোটি মানুষের কাছেই আছে। শুধু দেশেই নয়, কাদের সিদ্দিকীদের পরিচিতি রয়েছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও। জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় এসে কাদের সিদ্দিকী ‘মিডিয়া কাভারেজ পাবার জন্য বিতর্কিত বক্তব্য দিয়ে থাকেন’ এরকম অভিযোগ সেই লেখকের অদূরদর্শীতার প্রমাণ।
এই স্তবকে লেখকের আরেকটি হাস্যকর বক্তব্য হলো, ‘কাদের সিদ্দিকীর বক্তব্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গতি খুঁজে পাওয়া যায় না।’ বড্ড দুঃখ লাগে যখন কেউ কোন কিংবদন্তী মুক্তিযোদ্ধার বক্তব্যে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ খোঁজেন। কারণ শুধুমাত্র মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সর্বস্ব বক্তব্যে এই দেশ স্বাধীন হয়নি। দেশটা স্বাধীন করতে হাতের মুঠোয় জীবন নিয়ে যুদ্ধ করা লেগেছে। যুদ্ধের দিনগুলোতে অনেক চেতনাধারী নেতাকেও অস্ত্র হাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মুখোমুখি হতে দেখা যায়নি। আবার স্বাধীন বাংলাদেশে অনেক স্বাধীনতা বিরোধীকেও চেতনা উঁচিয়ে সর্বোচ্চ সুবিধাভোগী হতে দেখেছি। তাই একটা কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, চেতনাময় বক্তব্যের চাটুকারিতা নয় বরং দেশ ও জনগণের কল্যাণে নিঃস্বার্থ ভাবে কাজ করে যাওয়াটাই হলো মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা।
সেই লেখাটির ২য় স্তবকে লেখক বীর উত্তম কাদের সিদ্দিকীর একটি বক্তব্য বিকৃত করে উপস্থাপন করেছেন। সেখানে বঙ্গবীরের যে বক্তব্যের উদ্ধৃতি লেখক টেনেছেন, সেটি লেখকের একান্ত নিজস্ব। কোন পত্রিকা বা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সূত্র উল্লেখ নাই। প্রকৃতপক্ষে, গত ১০ মার্চ শনিবার বিকালে টাঙ্গাইল জেলার সখিপুরের নলুয়া বাছেদ খান উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে উপজেলার যাদবপুর ইউনিয়ন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ আয়োজিত জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতায় বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম বলেছিলেন- ‘স্বাধীনতার পর জাসদ প্রতিষ্ঠা করে গণবাহিনী বানিয়ে হাসানুল হক ইনু গং যতজন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেছেন, যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকিস্তানি হানাদাররাও এত অধিক সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করতে পারেনি।’
ইতিহাসের নির্মম সত্য কথাটাই বঙ্গবীরের বক্তব্যে উচ্চারিত হয়েছে। গণবাহিনীর ইতিহাস সকলেরই জানা আছে। সেসব নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নাই। তারপরও যৌক্তিকতা প্রমাণে আমি কিছু ঘটনা ও সময়ের উল্লেখ করতে চাই।
১৯৬৯ সালে হাসানুল হক ইনু সাহেবকে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক বানানো হয়েছিলে। তারপর ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি রণাঙ্গনে হানাদার বাহিনীর মোকাবেলা করেননি। সেই সময় তিনি ভারতের ‘তান্দুয়াতে’ মুজিব বাহিনীর প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে ছিলেন। ১৯৭২ সালের মে মাসে বঙ্গবন্ধু এই হাসানুল হক ইনু সাহেবকে জাতীয় কৃষক লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক করেন। ইনু সাহেব সেই ’৭২ সালেরই ৩১ অক্টোবর অন্যদের সাথে জাসদ প্রতিষ্ঠা করে বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাসের সাথে বেঈমানি করেন। সেই থেকেই শুরু। যে সমাজতন্ত্র আর সাম্যবাদের ঝাণ্ডা উঁচিয়ে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির এই ভূখণ্ড স্বাধীন হয়েছিলো, সেই সমাজতন্ত্র থেকে বেরিয়ে গিয়ে ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’র নামে ইনু সাহেবদের প্রতিষ্ঠিত সেদিনকার জাসদ মূলত কী চেয়েছিলো সেটি আমাদের আজও বোধগম্য নয়। তবে সেই সময় ‘গণবাহিনী’ নামে একটি সশস্ত্র গ্রুপ তৈরি করে অগণিত মুক্তিযোদ্ধা এবং আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে হত্যার মাধ্যমে তারা যে ষড়যন্ত্রের পথ প্রশস্ত করেছিলেন, সেই পথ ধরেই এসেছিলো ১৯৭৫ এর ১৫ই আগস্ট। তাই জাসদ বা হাসানুল হক ইনু সাহেবদের অবশ্যই ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।
সেদিনের গণবাহিনী এমন অনেক ব্যক্তি ও পরিবারকে হত্যা করেছে যাদের কাফনের কাপড় কেনার টাকাও ছিলে না। এতটা নিরীহ মানুষকেও তারা রেহাই দেয়নি। মানুষগুলোর অপরাধ ছিল তারা আওয়ামী লীগ করেন, বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসেন। টাঙ্গাইলের বাসাইলের কলিমুর রহমান বাঙালীর কথা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। কলিমুর রহমান ছিলেন একজন শিক্ষক এবং মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার। বাসাইল শাখা আওয়ামী লীগের সেক্রটারি হওয়ার অপরাধে এই মুক্তি কমান্ডারকে হত্যা করে জাসদের গণবাহিনী। কালিহাতি আওয়ামী লীগের সেক্রেটারী হাকিম তালুকদারের কথা বলতে পারি, তিনিও মুক্তি কমান্ডার ছিলেন। এরকম হাজার হাজার নাম জানা না জানা মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেছিল জাসদের গণবাহিনী। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে সেদিনের সেই গং আজ আওয়ামী লীগেরই উচ্ছিষ্ট ভোগী!
যাই হোক, এরকম অসংখ্য মিথ্যাচার আর বিষোদাগারে ভরপুর সেই লেখাটি নিয়ে আর কথা বাড়াবো না। শুধু এতটুকু বলতে চাই- আজকাল অনেক বসন্তের কোকিল জন্মাতে পারে, ১৫ আগস্টের প্রেক্ষাপট সৃষ্টিকারীরা বঙ্গবন্ধু কন্যার আশেপাশে ঘুরঘুর করতে পারে, দলীয় পদ-পদবী বাগিয়ে নিয়ে বিশাল নেতা হতে পারে, সরকারের বড় বড় মন্ত্রী হতে পারে ঠিকই; কিন্তু বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম এর থেকে বড় বঙ্গবন্ধুপ্রেমিক কেউ হতে পারে না। কাদের সিদ্দিকীর থেকে বঙ্গবন্ধুর বড় কর্মী আর কেউ হতে পারে না। বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত একমাত্র বেসামরিক ব্যক্তিত্ব কেউ হতে পারে না। তার মতো এতটা নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতা আর কেউ হতে পারে না। তাই তার মতো একজন ভালোমানুষের চরিত্র হননের অপচেষ্টা করা উচিত নয়।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)