প্রস্তাবিত ‘স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা আইন ২০১৮’ এর খসড়াকে অনৈতিক আইন বলে দাবি করেছেন চিকিৎসকরা। এই আইনকে চিকিৎসকদের জন্য প্রহসনমূলক বা নিবর্তনমূলক বলেও আখ্যা দিয়েছেন তারা।
তাদের মতে, মূলত চিকিৎসকদের কল্যাণের কথা চিন্তা না করে হাসপাতাল, ক্লিনিক ও চিকিৎসকদের বিষয়বস্তুকে একসঙ্গে করে একটি অনৈতিক আইনের খসড়া করা হয়েছে।
শনিবার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে ‘ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি অ্যান্ড রাইটস (এফডিএসআর)’। প্রস্তাবিত ‘স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা আইন ২০১৮’ এর কয়েকটি ধারা পরিবর্তন, সংযোজন, বিয়োজন এবং অবিলম্বে ‘চিকিৎসা সুরক্ষা আইন’ প্রণয়নের দাবিতে এ সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এসময় বক্তারা এসব কথা বলেন।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, প্রস্তাবিত আইন অনুসারে চিকিৎসকদের ‘চেম্বার প্র্যাকটিস ও বেসরকারী ক্লিনিক ও ল্যাবরেটরী অধ্যাদেশ ১৯৮২’ অনেকটা জোর করে চিকিৎসকদের উপর চাপিয়ে দিয়েছিলেন তৎকালিন সামরিক স্বৈর শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। সেই অযৌক্তিকতার কিছু ছাপ বর্তমানের প্রস্তাবিত আইনেও রয়ে গেছে।
এই আইনে চিকিৎসক এবং হাসপাতাল ও ক্লিনিকের ব্যবস্থাপনা একসঙ্গে মিলিয়ে এক অগ্রহণযোগ্য পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে উল্লেখ করে বক্তারা বলেন, প্রস্তাবিত আইনের বেশ কয়েকটি ধারা বিভ্রান্তিকর বা অসম্পূর্ণ। যার ফলে পরবর্তীতে এই আইনের ব্যাখ্যায় সংশয়ের সৃষ্টি হতে পারে। তাছাড়া নির্ধারিত অফিস সময়ে বা পালাক্রমিক দাপ্তরিক দায়িত্ব পালনের সময়ে অন্য কোন হাসপাতালে বা ব্যক্তিগত চেম্বারে চিকিৎসা প্রদান করা প্রচলিত চাকরি বিধির সুস্পষ্ট লংঘন এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এক্ষেত্রে নতুন করে এটা বর্তমান প্রস্তাবিত আইনে অন্তর্ভুক্ত করার কী প্রয়োজন? এই ধারা ১০(১) লংঘন করলে অনধিক এক লাখ টাকা জরিমানার বিষয়টিও এখানে অপ্রয়োজনীয়।
প্রস্তাবিত আইনের ১০(২) ধারায় ছুটির দিনে স্ব-স্ব কর্মস্থলের জেলার বাইরে বেসরকারী হাসপাতালে বা ব্যক্তিগত চেম্বারে ফিস গ্রহণপূর্বক সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমোদন প্রয়োজনের কথা বলা হয়েছে। আমরা মনে করি, এর ফলে বিভিন্ন জেলার সাধারণ রোগীরা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসার অভাবে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বর্তমানে বাংলাদেশের অধিকাংশ জেলায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় কম। পাশাপাশি সীমিত আয়ের অনেক রোগীর পক্ষেই নিজ এলাকার বাইরে গিয়ে চিকিৎসা নেওয়া ব্যয়বহুল ও কষ্টসাধ্য। সেক্ষেত্রে সপ্তাহান্তে মফস্বলের রোগীরা নিজ এলাকায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছ থেকে সরাসরি চিকিৎসা পেয়ে উপকৃতই হচ্ছেন।
সংবাদ সম্মেলনে আরো বলা হয়, ধারা ১১ অনুসারে সরকারী ও বেসরকারী হাসপাতালসমূহে প্রদত্ত সেবা এবং রোগ পরীক্ষা-নিরীক্ষার চার্জ বা মূল্য বা ফি’র তালিকা প্রদর্শন করা যেতে পারে। ল্যাবরেটরীতে সম্পাদিত রোগ পরীক্ষা নিরীক্ষার মান এবং পরীক্ষার রিপোর্ট একজন চিকিৎসকই কেবল করতে পারবে সেটা স্পষ্টভাবে আইন দ্বারা নির্ধারিত হতে পারতো। সেইসাথে, সংশ্লিষ্ট সরকারী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক চিকিৎসকদের ফি নির্ধারণের প্রস্তাবটি সমর্থনযোগ্য নয়। এর কারণ দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও এলাকার ভিত্তিতে চিকিৎসকদের ফি ভিন্ন ভিন্ন হওয়াও স্বাভাবিক। তাছাড়া, অন্যান্য পেশাজীবীদের ক্ষেত্রে ফি নির্ধারণের ব্যবস্থা না থাকলেও কেবলমাত্র চিকিৎসকদের ক্ষেত্রে রোগী দেখার ফি নির্ধারণের এই প্রস্তাবটি গ্রহণযোগ্য নয়।
প্রস্তাবিত আইনটিতে অপ্রয়োজনীয় ধারা সম্পর্কে বক্তারা বলেন, ধারা ১২ (১) এবং ১২(২) সেবা গ্রহীতার বসার জায়গা না থাকলে ৫০০০০ টাকা জরিমানার প্রস্তাবিত দণ্ডটিও সঙ্গত কারণে গ্রহণযোগ্য নয়। ধারা ১২ (৩) এবং ১২ (৪) বর্ণিত বিষয় দুটো ইতিমধ্যে বাংলাদেশ মেডিক্যাল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিলে (বিএমডিসি) সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে। এটি নতুন করে প্রস্তাবিত এই আইনে অন্তর্ভুক্ত করা আমাদের কাছে যৌক্তিক মনে হয়নি। ধারা ১২ (৩) ও ১২ (৪) ও বিএমডিসি আইন ও মেডিক্যাল এথিকস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, এর জন্যও আলাদা আইনের প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি না। ধারা ১৩ তে উল্লেখিত ‘রোগী বা রোগীর অনুসঙ্গীকে চিকিৎসা সম্পর্কে অবহিতকরণ ও তথ্য প্রদানের’ ব্যাপারটি বিএমডিসি কর্তৃক নির্ধারিত ‘কোড অব কনডাক্টের’ আওতাধীন, একজন নিবন্ধিত চিকিৎসক যা মানতে বাধ্য। এই বিষয়টিকে আলাদা করে প্রস্তাবিত আইনে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি না।
বক্তারা আরও বলেন, প্রস্তাবিত ধারা ১৪ (১) আমাদের কাছে বাস্তবসম্মত মনে হয়নি। আইন শৃংখলা রক্ষায় তথ্য প্রদানের নিমিত্তে ধারা ১৮ তো বিদ্যমান প্রচলিত আইনেই আছে। যে কোন সন্দেহজনক মৃত্যু বা দূর্ঘটনার ক্ষেত্রে চিকিৎসক বা সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে নিকটস্থ থানায় অবহিত করা হয়, এটাই প্রচলিত নিয়ম। এটি প্রচলিত ফৌজদারী আইনেরই একটি অংশ, এর জন্য তো নতুন করে আইন করার প্রয়োজন নাই। তাছাড়া চিকিৎসকদের রোগী দেখার সময় নির্ধারণ করে দেওয়ার বিষয়টি একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।
প্রস্তাবিত আইনের বিদেশী স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারী ব্যক্তি কর্তৃক সেবা প্রদান এবং বিদেশী হাসপাতাল স্থাপনের অনুমতি প্রদান সংক্রান্ত ধারা ২০ এবং ২১ এর পরিপ্রেক্ষিতে বক্তারা বলেন, বিদেশী চিকিৎসক বাংলাদেশে প্র্যাকটিসের সুযোগ পাওয়ায় আমাদের বেসরকারি পর্যায়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা নিরুৎসাহিত হচ্ছে। কেবলমাত্র যে সকল বিষয়ে যোগ্যতা সম্পন্ন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আমাদের নাই , সেসব বিষয়ে বিদেশী চিকিৎসকরা অনুমতি পেতে পারে। একইসাথে যে সকল দেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আমাদের দেশে অনুমতি পাবে , সে সকল দেশেও আমাদের চিকিৎসকদের চিকিৎসা প্রদানের অনুমতি থাকতে হবে। তাদেরকে সরকারী হাসপাতালে বিদেশী চিকিৎসকদের কেবলমাত্র প্রশিক্ষণ প্রদানের উদ্দেশ্যেই কাজ করার সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। খসড়া আইনে এসকল প্রস্তাব থকা প্রয়োজন ছিল।
তাছাড়া বিদেশী পুঁজিপতিদের চেইন হাসপাতাল বাংলাদেশে স্থাপনের অনুমতি প্রদানের ক্ষেত্রে সরকারকে দায়িত্বশীল হতে হবে। প্রস্তাবিত আইনের ২১ নম্বর ধারায় নির্ধারিত পেশাগত দায়িত্ব পালনে স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারী ব্যক্তি বা হাসপাতাল কর্তৃক অবহেলার বিষয়টি সংশোধন করে নজরে আনতে হবে। তাছাড়া চিকিৎসক, প্রতিষ্ঠান ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করবে এমন কিছু খসড়া আইনে কোন প্রস্তাব রাখা হয়নি। কোম্পানী কর্তৃক অপরাধ সংঘটনের কথা বলা হলেও সরকারী হাসপাতালসমূহের ক্ষেত্রে এই আইনটি প্রযোজ্য হবে কি না তা স্পষ্ট নয়। চিকিৎসা-কালীন রোগীর মৃত্যু হলে বাংলাদেশ পুলিশ এই ৮৮ ধারা অগ্রাহ্য করে চিকিৎসককে ৩০৪ ধারায় গ্রেপ্তার করে থানা হাজতে প্রেরণ করে। বিষয়টি রাষ্ট্রের জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও অত্যন্ত সুকৌশলে স্বাস্থ্য সেবা সুরক্ষা আইন- ২০১৮ খসড়ায় এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
এফডিএসআরের মহাসচিব ডা. শেখ আব্দুল্লাহ আল মামুনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের উপদেষ্টা ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ডা. আব্দুন নূর তুষার, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ইশতিয়াক রেজা, সংগঠনটির কোষাধক্ষ্য ডা. ফরহাদ মঞ্জুর, সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. জাহিদুর রহমান, আইন বিষয়ক সম্পাদক ডা. নোমান চৌধুরী, মিডিয়া এবং পাবলিকেশন বিষয়ক সম্পাদক ডা. শাহেদ ইমরান।