মেয়ের জন্মের পর চৈতী কেমন যেন বদলে যেতে থাকে। তার স্বামী সন্তান পরিবার কিছুই ভালো লাগে না। শারীরিক মানসিকভাবে এক ধরনের অসুস্থতাবোধ করে। কিন্তু কাউকে বলতে পারছে না কিছু। চৈতীর মত এ সমস্যা অনেক মায়েরই হয়ে সন্তান জন্মের পরপর।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক তথ্য থেকে জানা যায়, ১০% নারী গর্ভাবস্থায় এবং ১৩% নারী সন্তানের জন্মের পর বিষণ্ণতায় ভোগেন।
সাধারণত সন্তান প্রসবের পর প্রসূতি মায়ের প্রাত্যহিক জীবনে আসে পরিবর্তন। যা মানিয়ে নিতে টালমাটাল হয়ে পড়ে অনেকে। এতে করে প্রসূতি মা বিষণ্ণতায় ভুগে। চিকিৎসকদের মতে, শিশুর জন্মের পরে শরীরে এস্ট্রোজেন আর প্রজেস্টেরন এ দুই হরমোনের মাত্রা অনেকটা কমে যায় বলে ডিপ্রেশন দেখা দেয়। তা ছাড়া বাচ্চার দেখাশোনা করতে গিয়ে ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া, ঘুম বা নিজের প্রতি যত্ন না নেয়া ও ডিপ্রেশনের কারণ।
মনোবিজ্ঞানী ক্যারেন ক্লেইমেন (MSW, LCSW, প্রসব পরবর্তী স্ট্রেস সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা এবং কার্যনির্বাহী পরিচালক, LLC)প্রসব পরবর্তীকালে মায়ের বিষণ্ণতা এবং হতাশার উপর বিভিন্ন গবেষণা করেন। তার গবেষণায় দেখা যায়, নতুন মায়েরা সবাই কম-বেশি হতাশায় ভোগেন। আর হতাশার কারণ হলো- সন্তানের দায়িত্ব নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে সারাক্ষণ মনে করে কিছু ভুল করছে কি। এক ধরনের অস্থিরতাতে ভুগে। আবার নিজের সমস্যা কারো সাথে শেয়ার করে না হীনমন্যতার কারণে। নিজেকে গুটিয়ে রাখে সব কিছু থেকে। প্রাথমিকভাবে পরিবারের সহযোগিতায় এ। সমস্যার সমাধান করা যায় । কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদি হলে মনোরোগের চিকিৎসা করতে হয়।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে, শিশুর জন্মের পর পরই প্রসূতি মায়ের ৫ রকমের মানসিক ব্যাধি হতে পারে।
১. বেবি ব্লু (Baby Blue)
সন্তান জন্মের পর প্রায় ৮০% মা বেবি ব্লু তে ভুগে ৷ এ ক্ষেত্রে সন্তান প্রসবের তিন-চার দিন পর প্রসূতি মায়ের যে লক্ষণ দেখা যায় তা হলও,মন খারাপ থাকা কিংবা অনবরত কান্নাকাটি করা। রাতে ঘুম হয় না৷ নিজের সন্তানটি পেটের ভেতরে না থাকায় শূন্যতা বোধ করা এবং সন্তানের প্রতি অমনোযোগী হওয়া ।
বেবি ব্লু’য়ের জন্য চিকিৎসার তেমন প্রয়োজন নেই। সন্তান জন্মের পর মোটামুটি দু’ সপ্তাহের মধ্যে প্রসূতি মা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে নিজে থেকেই ।
২. পোস্টপার্টাম সাইকোসিস (Postpartum Psychosis)-
শিশু জন্মের পর এক হাজার মায়ের মধ্যে ১-২ জন এ রোগে ভুগেন। প্রসবের পরবর্তী প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহে এ রোগের লক্ষণ দেখা যায়। অনিদ্রা , বিরক্তি ভাব, খিটখিটে মেজাজ, উদাসীনতা, অসংলগ্ন কথা বলা ,বাইরে চলে যাওয়ার প্রবনতা ,অযথা ভয়ে শঙ্কিত হওয়া , সন্তানকে নিয়ে অমূলক চিন্তা, অযত্ন পোস্টপার্টাম সাইকোসিসের লক্ষণ।
এক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শে ওষুধ কাউন্সিলিং বা থেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা হলে কয়েক মাসের মধ্যেই অধিকাংশ রোগী সুস্থ হয়ে যায়।
৩. পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন (Postpartum Depression)
গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী প্রায় ৩০% নারী গর্ভকালীন সময়ে বিষণ্ণতায় ভুগে। তখন এদের চিকিৎসা না হলে প্রায় ৫০% নারী প্রসবোত্তর বিষণ্ণতার শিকার হয় । যার মধ্যে ১০-১৫% পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হয়। প্রসবের দুই সপ্তাহ পর পোস্টপার্টাম সাইকোসিসের লক্ষণগুলোর সাথে ক্লান্তিবোধ, অহেতুক দুশ্চিন্তা করা, বিষাদগ্রস্ত থাকা,খাবারে অরুচি,পরিবার ও বন্ধুদের এড়িয়ে চলা, সদ্যজাত সন্তানের কোনো শারীরিক বা মানসিক খুঁত আছে, সন্তানটি তিনি মানুষ করতে পারবেন না, অতএব একে মেরে ফেলাই ভালো। এধরণের অলীক চিন্তায় ডুবে থাকে। এমনকি নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করতে পারে।
৪.পোস্টপার্টাম এনক্সাআইটি (Postpartum Anxiety)
কোন কারণ ছাড়াই চরম অস্বস্তিবোধ, উদ্বেগে থাকা, শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট,বুকে ব্যথা বা অস্বস্তি, মাথা ঘোরা, নির্জীব থাকা শরীরে অতিরিক্ত ঘাম হওয়া, নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলা, পাগল হয়ে যাওয়ার ভয় বা মৃত্যু ভয়ে আতঙ্কিত হওয়া পোস্টপার্টাম এনক্সাআইটি রোগের লক্ষণ। ১০% মা এ রোগে ভুগে চিকিৎসকদের মতে।
এ ধরনের মানসিক রোগে আক্রান্ত মায়ের থেকে শিশুকে কিছু দিনের জন্য একটু দূরে রাখা উত্তম। আর এ রোগীকে দ্রুত সুস্থ করার জন্য, কোন সুন্দর স্বাস্থ্যকর স্থানে কয়েকদিন বেড়াতে নেবার পরামর্শ দিয়ে থাকে চিকিৎসকরা।
৫. পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (Post-Traumatic Stress Disorder)
অপরিকল্পিত সিজারিয়ান, সন্তান প্রসবের সময় হঠাৎ মায়ের জটিল কোন সমস্যা হলে বা বেশি মাত্রায় শারীরিক কষ্ট পেলে, জন্মের পর সন্তানকে আইসিউতে রাখাসহ নানাবিধ কারণে ১-৬% প্রসূতি মা পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত হয়ে থাকে।
এ রোগের ক্ষেত্রে সন্তান জন্মের মুহূর্তগুলোকে দুঃস্বপ্ন মনে হয় প্রতিনিয়ত। এর সাথে অতীতে কোন দুর্ঘটনার স্মৃতি মনে পড়ে যায়। আর তাতে ভয়ে কুঁকড়ে পড়ে। এ লক্ষণের সাথে বিষণ্ণতা, অনিদ্রা, উদ্বেগ এবং হঠাৎ কোন কারণ ছাড়াই আতঙ্কিত হয়ে পড়া, বাস্তবতা এবং জীবন থেকে নিজেকে দূর সরিয়ে রাখার প্রবণতা থাকে।
এ ধরনের মানসিক রোগের চিকিৎসায় মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেয়া খুব প্রয়োজন।
সর্বোপরি প্রসূতি মায়ের যে কোন ধরনের বিষণ্ণতা রোগের চিকিৎসার পাশাপাশি পারিবারিক সহযোগিতা থাকতে হবে। বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে দাম্পত্য কলহ মুক্ত পরিবেশ সন্তান ও মায়ের জীবনে খুবই জরুরি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)