‘এখন হচ্ছে ছবির রাজনীতি, বলতে পারেন পোস্টারের রাজনীতি। কে কত বেশি পোস্টার আর ব্যানারে নিজ দলের নেতা-নেত্রীদের সাথে নিজের ছবি দিতে পারল সেই হিসেবে নেতার যোগ্যতা পরিমাপ করা হয়।’
কথাগুলো চায়ের দোকানে বসে বলছিলেন মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক। আর তাকাচ্ছিলেন চারপাশে। খানিকটা দূরেই ছিল এলাকার সাংসদের একটা বড় ব্যানার। সাংসদের নিচে চার-পাঁচজন নেতা-পাতিনেতার ছবি। একদম ওপরে সেই দলের মৃত নেতার ছবি, পাশে দলের প্রধানের ছবি, দলীয় প্রধানের ছবির পাশে তার ছেলের ছবি।
এ রকম ছবি ঢাকাসহ সারা দেশে দেখা যাচ্ছে। কারণ এখনকার রাজনীতি মানে পোস্টার-ব্যানারে ছবি আর ছবি। রাজনীতি সম্পর্কে নুন্যতম জ্ঞান থাকার দরকার নেই। আর পড়াশোনা? নিজের নাম লেখতে পারলেই হলো। তা হলেই যথেষ্ট। শুধু দরকার দাপট আর তেল মারার মতো যোগ্যতা।
যেকোনো উপায়ে নেতার গুণগান করা জানতে হবে। এলাকার ফুটপাতের দোকান থেকে চাঁদাবাজি আর খালি জায়গা পেলে বসতি গড়ে ভাড়া দেয়া। মাস শেষে নেতার কাছে টাকার অর্ধেকের বেশি দিয়ে আসা। কারণ ওই নেতাই সমস্ত বিপদ আপদ এলে ঠেকাবে। তাই চাঁদাবাজি করে কে কত বড় পোস্টার বা ব্যানার করে নেতার বড় ছবি সাঁটাতে পারে সেই প্রতিযোগিতা চলছে। সেই ব্যানারে দলের প্রধানের ছবি কতটুকু গেল সেটা দেখার দরকার নেই। স্থানীয় নেতার ছবি বড় করে থাকলেই যথেষ্ট। তা হলেই মুশকিল আসান হবে।
এ ব্যাপারে প্রধান বড় দুই দলের নেতৃস্থানীয়দের কোনো মাথা ব্যথা নেই। কোথায় কি হচ্ছে? কে কার মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাচ্ছে। কে নিজের ছবি এলাকার সাংসদের বা জনপ্রতিনিধির সাথে বসিয়ে স্বার্থ হাসিল করছে বা একসময় অন্য দল করে বিপদে ছিল, বর্তমানে ডিগবাজি খেয়ে সরকারি দলে ঢুকে নিজেকে বিপদমুক্ত ভাবছে, তার ব্যাপারে কোনো খোঁজ খবর নেয়া হয় না কেন্দ্র থেকে। এই সুযোগে দেশের বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠছে সরকারদলীয় ভুঁইফোড় সংগঠন। যার কোনো অস্তিত্ত্ব নেই কেন্দ্রে। কিন্তু স্থানীয়ভাবে থানা-পুলিশ এসব ভুঁইফোড় সংগঠনের নেতাদের বেশ মূল্যায়ন করে থাকে।
আরেকটি বিষয় দেখা যায়, প্রতিটি এলাকায় থানা ও প্রশাসনিক কার্যালয়ের সামনে এসব পোস্টার ব্যানার বেশি বেশি লাগানো হয়। এর অনেক ফজিলত আছে। স্থানীয় থানার ওসি থেকে শুরু করে দারোগা-কনস্টেবলসহ থানার প্রতিটি মানুষ ওই ব্যানারের ছবির মানুষকে একটু মূল্যায়ন করে। আর এই মূল্যায়নের কারণে এলাকার ছোটখাটো ঝগড়াঝাটি থেকে শুরু করে সন্ত্রাসী ঘটনার সুরাহার জন্য ওই সমস্ত পাতি নেতাদের বেশ কদর।তারা পুলিশের সাথে হাত মিলিয়ে দুই পক্ষের কাছ থেকে টাকা কড়ি নিয়ে ঘটনার মিটমাটি করে ফেলে। কাউকে ধরে থানায় আনা হলে ওইসব নেতা থানায় গিয়ে তদবিরে মেতে ওঠে।
এসব পোস্টার-ব্যানার কেন্দ্রীক রাজনীতির জন্য আজ সাধারণ মানুষের কাছে রাজনীতি বিষয়টি খুবই তুচ্ছতাচ্ছিল্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। যাদের নেই কোনো পড়াশোনা, যাদের রাজনীতি করছে তাদের আদর্শ সম্পর্কে কিছুই না জেনে শুধু টাকা কামানোর জন্য মাঠে নেমে স্লোগান দিতে পারলেই হল আর কি। এদের নিয়ে দলভারি করা গেলেও দিনশেষে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হওয়া ছাড়া আর কিছু লাভ হয় না।
এ ব্যাপারে আমাদের সব দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সচেতনতা দরকার। তা না হলে সারাদেশ আপনাদের দলের অঙ্গ সংগঠনে ভরে যাবে। আপনাদের অস্তিত্ত্ব নিয়ে সন্দেহ দেখা দিবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)