মুন্সিগঞ্জের ৯ জন মানুষ এক সাথে লাশ হলো এক সড়ক দুর্ঘটনায়। বিয়ের উৎসবে শোকের মাতম উঠে। কিন্তু নির্বাক সমবেদনা জানানো ছাড়া সাধারণ মানুষের কিছুই করার নাই। বড় অসহায় জনগণ। সত্যিকারভাবে দেশের পরিবহন ব্যবস্থায় জনগণ বারবার পরাজিত হচ্ছে। তার প্রমাণ সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ পাশের পর বাস মালিক পরিবহন শ্রমিকের ধর্মঘট। এখানে পেশি শক্তির রাজনৈতিক প্রভাবের কাছে নতজানু হয় সরকার ও জনগণ। পরিবহন সেক্টরের সাথে জড়িত রয়েছে অনেকগুলো সংস্থা এবং রাজনৈতিক আধিপত্য। লক্ষণীয় হলো এ সেক্টরের নেতা কর্মীরা যে যে দলেরই হোক না কেন, নিজেদের স্বার্থে জনগণের বিপক্ষে দাঁড়ায় একযোগে।
এক বছর আগে ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে সড়ক পরিবহন আইন সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়। যার ফলশ্রুতিতে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ প্রণয়ন করা হয়। এ আইনে উল্লেখযোগ্য ধারাগুলো হলো
* সড়কে গাড়ি চালিয়ে উদ্দেশ্য প্রনোদিতভাবে হত্যা করলে ৩০২ অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
* সড়কে বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালালে বা প্রতিযোগিতা করার ফলে দুর্ঘটনা ঘটলে তিন বছরের কারাদণ্ড অথবা তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। আদালত অর্থদণ্ডের সম্পূর্ণ বা অংশবিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে দেয়ার নির্দেশ দিতে পারবে।
* মোটরযান দুর্ঘটনায় কোন ব্যক্তি গুরুতর আহত বা প্রাণহানি হলে চালকের শাস্তি দেয়া হয়েছে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের জেল ও সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা।
*ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া মোটরযান বা গণপরিবহন চালানোর দায়ে ছয় মাসের জেল বা ২৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দেয়া হয়েছে।
* নিবন্ধন ছাড়া মোটরযান চালালে ছয় মাসের কারাদণ্ড এবং পঞ্চাশ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রয়েছে।
* ভুয়া রেজিস্ট্রেশন নম্বর ব্যবহার এবং প্রদর্শন করলে ছয় মাস থেকে দুই বছরের কারাদণ্ড অথবা এক লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেয়া হয়েছে।
* ফিটনেসবিহীন ঝুঁকিপূর্ণ মোটরযান চালালে ছয় মাসের কারাদণ্ড বা ২৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দেয়া হয়েছে।
* ট্রাফিক সংকেত মেনে না চললে এক মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দণ্ডিত করা হবে
* সঠিক স্থানে মোটর যান পার্কিং না করলে বা নির্ধারিত স্থানে যাত্রী বা পণ্য ওঠানামা না করলে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে।
* গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোনে কথা বললে এক মাসের কারাদণ্ড এবং ২৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।
* একজন চালক প্রতিবার আইন অমান্য করলে তার পয়েন্ট বিয়োগ হবে এবং এক পর্যায়ে লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবে
* গণ পরিবহনে নির্ধারিত ভাড়ার চাইতে অতিরিক্ত ভাড়া, দাবী বা আদায় করলে এক মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দণ্ডিত করা হবে।
* আইন অনুযায়ী ড্রাইভিং লাইসেন্সে পেতে হলে চালককে অষ্টম শ্রেনি পাস এবং চালকের সহকারীকে পঞ্চম শ্রেণি পাস হতে হবে হবে। আগে শিক্ষাগত যোগ্যতার কোন প্রয়োজন ছিল না।
* গাড়ি চালানোর জন্য বয়স অন্তত ১৮ বছর হতে হবে। এই বিধান আগেও ছিল।
তার এই মানবিক বোধ দিয়ে যদি তিনি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত পরিবারদের কথা ভাবতেন তাহলে চালকদের মানুষ ঘাতক উপাধি দিত না। লিখিত বা প্রকাশ্যে চালক শ্রমিকদের ধর্মঘটকে সমর্থন না করেও অন্যভাবে ভূমিকা পালন করছে পরিবহন খাতের ক্ষমতাধররা তা অনুমেয়।
আর এ আইনের আওতায় চালক শ্রমিকদের জেল জরিমানার পরিমাণ কমানোসহ ৯ দফা দাবিকে শর্ত সাপেক্ষে মেনে নেয় সরকার। এতে করে ধর্মঘট প্রত্যাহার হলে ও এখন পর্যন্ত সচল হয়নি গন পরিবহন চলাচল। বলা হচ্ছে ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়ন না থাকায় ও জেল জরিমানার ভয়ে চালকরা কাজে আসছে না।
সামগ্রিক ভাবে এ ঘটনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, দেশে নিরাপদ সড়ক জীবন পাবার আশা ক্ষীণ। কারণ সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় এ সেক্টরকে নিয়ন্ত্রণ করা জন্য মানসিকতার অভাব রয়েছে সবার।
এ দেশে দেখা যায়, একটি দুর্ঘটনার পর দাবী উঠে নিরাপদ সড়কের আর সে দাবির মুখে সরকার নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে। আর সাময়িকভাবে কঠোর হয় প্রশাসন। কিন্তু এর কোন স্থায়ী সমাধান হয় না। তাই বছরের পর বছর যা চলে আসছে তা জনগণ বা পরিবহন খাতের ব্যক্তিদের আন্দোলন দিয়ে সমাধান করা যাবে না।
আবার কেবল আইন দিয়েও নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করা যাবে না। বরং নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে আইনের পাশাপাশি রাস্তায় চলাচলকারী যানবাহন আর মানুষের মানসিক ও নৈতিক পরিবর্তন দরকার সবার আগে ।
সড়ক যানবাহনে যে অনিয়ম দুর্নীতি রয়েছে তার সাথে জড়িত আছে প্রশাসন সহ পুলিশের বেশ কটি সেক্টর। যা দিয়ে পার পেয়ে যায় ফিটনেসবিহীন যানবাহন আর লাইন্সেস ছাড়া ড্রাইভার। ট্রাফিক সপ্তাহে হলে দেখা যায় মামলার ভয়ে গাড়ি আর ড্রাইভাররা রাস্তায় বের হয় না। কারণ তারা জানে ট্রাফিক সপ্তাহ শেষ হলে আবার সব কিছু ম্যানেজ করে তারা গাড়ি চালাতে পারবে। ড্রাইভারদের কথা হলো কথায় কথায় কাগজ পত্র চেক করে ঠিক থাকলেও তাদের মামলার হয়রানির শিকার হতে হয়।আর না হয় দিতে হয় ঘুষ।তাহলে কাগজ পত্র নবায়ন করে কি লাভ। এ অবস্থায় নতুন আইনের কঠোর নির্দেশ পালন করতে চালক শ্রমিকদের হয়রানি করার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে। পজিটিভ চিন্তায় মানুষের অনেক ভয় শঙ্কা কাটিয়ে দেয় এটা মনে রাখতে হবে সকলকে।
এসব সমস্যার পাশাপাশি যে বিষয়টা সমাধান অযোগ্য তা হল, পথচারী সহ যানবাহনের ট্রাফিক আইন অমান্য করা।যার ফলে দুর্ঘটনাতে পরিবার হারায় আপন জনকে। একজন চালককে বা পথচারীকে জীবনের মূল্যটা অনুধাবন করতে হবে নিজেকে দিয়ে। যাত্রীকে নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে দেয়া চালকের দায়িত্ব। আর বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে নিজের দায়িত্ব অবহেলা করে কারো জীবন কেড়ে নেয়া অন্যায়। এ বোধটা জাগ্রত হলে মানবিকতার নামে সড়ক রাজনীতি বন্ধ হবে আপনাআপনি।
মহা সড়কে যাত্রী বোঝাই গাড়ী আর মালামালে বহনকারী ট্রাক যে ভাবে পাল্লা দিয়ে চলে। তা দেখে মনে হয় মানুষের জান মালের কোন তোয়াক্কা তারা করে না। দুর্ঘটনায় হাজারো জীবন অকালে চলে যাবার পরেও মন মানসিকতার কিঞ্চিত পরিবর্তন হয়নি মানুষের। সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হলো, এই মানুষগুলো যখন দেশের কোন সেনানিবাসের রাস্তায় চলাচল করে তখন তাদের বলে দিতে হয় না কিছু। কথায় আছে ‘ডাণ্ডার ভয় সবাই পায়’। যে কাজটা সেনানিবাসে সহজে হয় সেটা সাধারণ ভাবে কেন হবে না। এর উত্তর একটাই – বুঝে শুনে ভুল বা অন্যায় করা এ দেশের মানুষের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাসা বেধেছে। দুর্নীতি, অন্যায় আর আইন না মানার জন্য ঘুষ দিয়ে পার পাবার পথ বন্ধ না হলে কিছুর পরির্বতন হবে না।
ভারী যানবাহনের পাশাপাশি প্রাইভেট গাড়ী রিকসার চাপে শহরে যানজটের দুর্ভোগ অসহনীয়। ফুটওভার ব্রীজগুলো হয় খালি না হয় ব্যবসায়ীদের দখলে। তার উপরে মানুষের ধারনা রাস্তা পারাপারে ফুট ওভার ব্রিজে ব্যবহার করতে গেলে সিঁড়ি বেয়ে সময় নষ্ট হবে। বরং গাড়ির গতিরোধ করে বা ডিভাইডারের ফাঁকে দিয়ে কসরত করে বেরিয়ে যেতে পারলে হয়।
কথায় আছে – ‘কয়লা ধুইলে ময়লা যায় না,স্বভাব যায় না মলে’।’। এ দেশের মানুষের কাছে আইন নিয়ম সবই তুচ্ছ স্বভাবের কাছে। সুতরাং এ অবস্থায় যদি দেশের শতকরা ৫০ ভাগ মানুষও নিজেদের মানসিকতা বদলাতে পারে তবেই আশার আলোর প্রদীপ জ্বলবে নিরাপদ সড়ক জীবনে । আর তখনই চালক শ্রমিকরা আইনের বিরোধিতা না করে নিজেরাই নিজেদের সচেতন করতে পারবে আইনের অপব্যবহার রোধে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)