চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

নিউইয়র্কে আকাইদ কাণ্ড: কী ভাবছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা?

‘কি ভয়ংকর কাজ করল ছেলেটি, ভাবতেই মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। দেশের নাম এই ভাবে খারাপ করতে পারলো! ২৮ বছর হয়ে গেছে বাংলাদেশে যাই না। কিন্তু দেশের নাম শুনলেই বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে,’ বলছিলেন ইঞ্জিনিয়ার সেলিম রোকনুদ্দিন।

‘আমি ভাবতেই পারি না কেউ দেশের নাম এভাবে কলংকিত করবে।’

গত বছরের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলায় ১৭ বিদেশীসহ ২২ জন মারা যান, তখনও কি এতোটা খারাপ লেগেছিল? জানতে চাইলে, তিনি বলেন: খারাপ তো লেগেছিল কিন্তু কাউকে তো আর জবাবদিহি করতে হয়নি। এই দেশে আছি ৪০ বছর, এই দেশ এখন পুরো আমার। এদেশের ক্ষতি করছে তাও সে আমার অরিজিন দেশের, খুবই লজ্জার ব্যাপার। বাংলাদেশে এখন রোজই কিছু না কিছু ঘটে চলেছে। বাংলাদেশের প্রতি ভালবাসা আছে কিন্তু আজ আমি এখান ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তাই এখানে কিছু হলে বেশি খারাপ লাগে।

নিউইয়র্কের টাইমস স্কয়ারের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের সব থেকে বড় বাস টার্মিনাল, পোর্ট অথরিটিতে হামলার অভিযোগে আটক ব্যক্তি বাংলাদেশি আকাইদ উল্লাহ। সে ব্রুকলিনের বাসিন্দা। ২৭ বছর বয়সী আকাইদ তথাকথিত ইসলামিক স্টেটের (আইএস) কথিত ‘আদর্শে’ অনুপ্রাণিত। গত সোমবার সকালে সাতটা ১৯ মিনিটে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে যাতে হামলাকারীসহ আরও তিনজন আহত হয়। হামলার পর থেকে আমেরিকা বিশেষ করে নিউইয়র্কের বাঙালিদের মধ্যে রাগ, ক্ষোভ ও হতাশার মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। আকাইদের হামলার পরবর্তী অবস্থা নিয়ে নিউইয়র্কে বসবাসরত কয়েকজন বাংলাদেশি-আমেরিকান ও অভিবাসীর সাথে কথা হয়।

বাচ্চাকে সকালে স্কুলে নামিয়ে ফেরার পথে দেখা হলো জ্যামাইকার সাটফিন বুল্ভারড থেকে আসা রাশেদ চৌধুরির সাথে। উনি একটি কোম্পানির হিউম্যান রিসোর্স ডিপার্টমেন্টে কাজ করেন। তাকে আকাইদের করা হামলা নিয়ে জিজ্ঞেসা করতেই বললেন: আরে ধূর! কে না কে কী করছে তা নিয়ে আমি মাথা ব্যথা করবো কেন? ও বাংলাদেশি কি সিরিয়ান তা আমার কাছে ইম্পরট্যান্ট না। ও একটা সন্ত্রাসী এটাই বড় কথা। আমেরিকাতে প্রায় ১০ লাখের মত বাংলাদেশি বসবাস করে। এদের অধিকাংশ আমেরিকান নাগরিক, কিছু পার্মানেন্ট রেসিডেন্টস, কিছু মেরিট ভিসায় এসে আছে, আছে ইল্লিগ্যাল, আছে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণকারী। এদের সবাই কি সম-মানসিকতার হবে? মোটেও না। তাহলে কে একজন বোমা মারল তা আমাকে ছোট করবে কেন বলেন!নিউইয়র্ক বিস্ফোরণ-আকাইদ

বিভিন্ন সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবার ভয় পাচ্ছেন কি?

‘আরে আপা, ৯/১১ এর পর কি আফগানিদের এইদেশে আসা বন্ধ হয়েছে? সামাজিক সুবিধা কি বন্ধ হয়েছে? হয়নি। তাহলে আকাইদের কারণে কেন হবে? আর নতুন সরকার এমনিতেই প্রশাসনে বদল আনবে তার দলের সুবিধানুযায়ী। হয়ত আকাইদের ঘটনা তা কিছুটা ত্বরান্বিত করবে। এই যা।’

আমাদের কথোপকথন শুনে লিটন নামের বাংলাদেশি আরেক অভিবাসী দাঁড়িয়ে যান। তিনি বলেন: এইটা কী বলেন? আগামী বছর আমার নাগরিকত্ব ডিউ হবে, এই ঘটনায় তো আমার সিটিজেনশিপের এপ্লিকেশন ছুড়ে ফেলে দিবে। ঘাড় ধরে না বের করে দেয়! আর বইলেন না, লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছি না। আমার কাজের জায়গায় পাকিস্তানিরা কাজ করে, শা…রা মিটিমিটি হাসে আর বলে কিয়া হোগা তেঁরা ইয়ার। ভাই কিছু কইতে পারি না সইতে পারি না। আকাইদ লজ্জায় ডুবাই দিল।

কসকোর রেজিস্ট্রারে কাজ করা লিটন লজ্জিত হলেও আকাইদ কাণ্ডে মোটেও লজ্জিত নন জেট ব্লু এয়ারে হিউম্যান রিসোর্সের ভায়লা সালিনা। তিনি বলেন: আকাইদ, নিন্দিত বাঙালি টেররিস্ট। চারদিকে তাকে নিয়ে ছিঃ ছিঃ নিন্দা, আর প্রতিবাদ চলছে। বাংলাদেশিরা তাকে বাঙালি বলতেও ঘৃণা করছে। এই ছেলেটিকে নিয়ে বাঙালিরা সবাই লজ্জিত হলেও আমি লজ্জিত নই। বরং আমি জানতে চাই এর পেছনে কারণটা কী? কে বা কারা কেন তাকে সন্ত্রাসী হতে উস্কে দিয়েছে? এর মূল হোতা কে? বিচারকালে এসব যেন খুঁটিয়ে দেখা হয় সেই ইচ্ছা রাখছি।

‘সাত বছর আগে বাংলাদেশ ত্যাগ করে পরিবারের মাধ্যমে এদেশে ইমিগ্রান্ট হয়ে আসা সদ্যোজাত বাচ্চার বাবা আকাইদের হঠাৎ এই লো গ্রেড টেক বোম্ব বহন করার কারণ কি বিষয়টা অবশ্যই জানতে চাই। সে যা করেছে তা সকলের জন্যই অস্বস্তিকর। আজীবন সেলের চার দেয়ালে ২০১২ সালের আরেক টেররিস্ট নাফিসের মত কাটিয়ে দিতে হবে। কিন্তু একজন আকাইদকে সন্ত্রাসী হবার জন্য ঘৃণা করা বা তাকে নিয়ে নিন্দা করার মতো কোনো কারণ পুরো বাঙালিবাসী খুঁজে পেলেও সরি টু সে আমি খুঁজে পাইনি। নাফিস কিংবা আকাইদ এরা আসলেই টেররিস্ট নাকি হেইট ক্রাইমের শিকার নাকি কোন সাজানো নাটকের শিকার সেটাও জানতে হবে।’নিউইয়র্ক বিস্ফোরণ-আকাইদ

তবে, নিউইয়র্কের বাংলা কমিউনিটির জনপ্রিয় ব্যক্তি সাংবাদিক আকবর হায়দার কিরণ বলেন: আকাইদ উল্লাহ নামের একজন অসভ্য এবং বর্বর বাংলাদেশির কারণে পুরো বাংলাদেশের মাথা হেট হয়ে গেলো। মার্কিন মুলুকে বসে কেউ যদি আজ থেকে একশ’ বছর পরেও সন্ত্রাসবাদ নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে অনলাইনে সার্চ করে তাহলে উঠে আসবে এই বজ্জাতের নাম, বাংলাদেশের নাম। ১১ ডিসেম্বর সকাল থেকে এই বর্বরতার কলংক নিয়ে মর্মবেদনায় জ্বলে পুড়ে মরছি, মরছে দেশে বিদেশে প্রতিটি বিবেকবান বাংলাদেশি। মহান বিজয় দিবসে ঠিক আগের মুহূর্তে কেউই হয়তো দুঃস্বপ্নেও এমন কিছু ভাবেনি। জ্যাকসন হাইটস যখন আমাদের পরম গর্বের বিজয় দিবসকে নিয়ে নানান অনুষ্ঠান নিয়ে ব্যতিব্যস্ত, এই আকাইদ নামের এই জঙ্গি আমাদের কি যে ক্ষতি করে দিলো।

এক আকাইদ কি এতো বছরের এতো বাঙালির আমেরিকার উন্নয়নে অবদান মিথ্যে করে দিতে পারে?

জিজ্ঞেস করলে উত্তরে কিরণ জানান, একটা খারাপ ভাবমূর্তি হয়ে গেলো, বিশেষ করে ট্রাম্প শয়তানের আমল বলে বেশি ক্ষতি হলো।

ইউনিসেফের, এডুকেশন ক্যান নট ওয়েট’র প্রোগ্রাম অফিসার কথা রহমানও বলেন: এটা আমাদের বাংলাদেশিদের জন্য লজ্জাজনক একটা ঘটনা। আমি মনে করি কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমেরিকার সরকারের জন্যেও অসম্মানজনক। মেধা ও শিক্ষা কন্সিডার না করেই একদল মানুষকে এই দেশে বসবাসের অনুমতি দিয়েছে, এই মানুষগুলি নিজেরা তেমন কিছু করতে পারে না, দিনে দিনে হতাশায় নিমজ্জিত হয়, দেশে সব কিছু ফেলে আমেরিকাতে এসে মানসম্মত কিছু করতে না পারার কষ্ট তাদের তাড়িত করে। এরকম অবস্থায় যে কোন ভুল পথে পা বাড়ানো কঠিন কিছু না।নিউইয়র্ক বিস্ফোরণ-আকাইদ

তিনি ইউএস সরকারের বর্তমান চেইন মাইগ্রেশন রিভিউকে যুক্তিসম্মত মনে করেন।

কলেজ থেকে ফেরার পথে দেখা হয় জ্যাকসন হাইটসের রেস্টুরেন্টে কাজ করা মনসুর সরকারের সাথে। হেসে এগিয়ে আসে। তাকে আকাইদের বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে উত্তেজিত হয়ে মনসুর বলেন: আপা, ওরে গরম ডিম থেরাপি ননস্টপ দিতে হবে। এখন যদি পুলিশ ধরপাকর শুরু করে তাইলে তো বিপদে পড়ে যাব। আমার কাগজপত্র নেই। মেক্সিকো হয়ে অনেক টাকা খরচ করে, অনেক দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে এই দেশে এসেছি। বছর খানেক হইলো, এই চাকরিটা পাইছি। খুব একটা বেতন না হলেও চলে যাচ্ছে। এখন যদি ট্র্যাম্প খেপে তাইলে কি আর বাঁচবো? আমার মতো এমন অনেকেই টেনশনে আছে। আপা ওই হার্মাদ ইসরায়েলে যাইতো, প্যালেস্টাইনে যাইয়া হামলা করতো, এখানে করে কী পাইলো? নিজের পরিবার আর আমাদের শেষ করে দিয়ে গেল।

ব্রুকলিনের এক মসজিদের ছোট ইমাম, আল্লামা আরসাদ হোসাইন বলেন, আকাইদ সহি ইসলাম পালন করেনি। ইসলাম শান্তির ধর্ম। আমরা শান্তিকামী। আকাইদকে আল্লাহ্‌তালা আমেরিকার সরকারের মাধ্যমে কঠোর শাস্তি প্রদান করবেন।

নিউইয়র্কের জনপ্রিয় সাপ্তাহিক বাঙ্গালী’র সম্পাদক কৌশিক আহমেদ বলেন: আকাইদের হামলাটি অপরাধের মাপকাঠিতে মোটেও ছোট নয়। কিন্তু এমনও না যে, এতো বছরের, এতো বাঙ্গালীর অবদান মিথ্যে হয়ে যাবে এক লহমায়। তবে এটা ঠিক এই হামলা আমাদের সবাইকে অস্বস্তির মধ্যে ফেলেছে। সরকার আমাদের কমিউনিটিকে দায়ী করেনি বটে কিন্তু হোয়াইট হাউজে কোন কোন সাংবাদিক বাংলাদেশকে ট্রাভেল ব্যানের মধ্যে ফেলা হবে কিনা জানতে চাইছে। উস্কানিমূলক প্রশ্ন অনেক সময় সমস্যার কারণ হয়ে ওঠে। প্রশাসন আশা করি এ বিষয়টির দিকে গুরুত্ব দেবে।

তিনি বলেন: যদিও সন্ত্রাসী ও জঙ্গী হামলা শুধু জাতীয় সমস্যা নয়, এটা আন্তর্জাতিক সমস্যা। আমাদের সবারই পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে। আমাদের পরিবারের সদস্যদের আচরণ ও গতিবিধির প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। পরিবারে কোয়ালিটি টাইম ও বন্ডিং বাড়াতে হবে। পরিবারের পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা অনেকাংশে পরিবারের সদস্যদের বিপথগামী হতে বাধা দেবে।

বাংলাদেশি কম্যুনিটির বিভিন্ন সংগঠন এই হামলার প্রতিবাদে বিবৃতি দিচ্ছে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করছে। তবুও আশংকা বাসা বাঁধছে, চেইন ইমিগ্রেশনে কি কোন ধরনের রদবদল আসবে বা বাংলাদেশিদের ভিসা জটিল করা হবে কিনা অথবা ট্র্যাভেল ব্যানে বাংলাদেশের নাম অন্তর্ভুক্ত হবে কিনা, এসব চিন্তা আছে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)