Site icon চ্যানেল আই অনলাইন

নাম ও সালের ‘ইংরেজিয়ানা’ কি ছাড়বে না?

দিন কয়েক আগে আমি ফেসবুকে একটা তর্ক উসকে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম নামের ‘ইংরেজিকরণ’ নিয়ে। আমরা কি আদৌ ‘ইংরেজি’-তে নাম লিখি? আমার উত্তর সোজা। না, লিখি না।

একটা উদাহরণ দেই। অন্যের নাম নিলে পাছে বিতর্ক হয়, তাই আমি এখানে আমার নামটি পাঠকের কাছে ক্ষমা চেয়ে ব্যবহার করছি বোঝাপড়াটা সহজ করার স্বার্থে। আমার নাম সৌমিত জয়দ্বীপ। প্রতিষ্ঠান (যে কোন প্রতিষ্ঠান) আমাকে বলে আমার নাম ‘ইংরেজি’-তে লিখতে। এটা কেমনতর কথা?

আমার খাঁটি বাংলা নাম। তার আবার ইংরেজি কী! আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো এভাবে আমাদের ভুল শেখায় ও লেখায়। আদতে আমরা আমাদের প্রকৃত নামের ‘ইংরেজি’ লিখি না। আমরা আমাদের নামকে রোমান/লাতিন বর্ণমালায় প্রকাশ করি মাত্র। তাই, Sowmit Joydip আমার ‘ইংরেজি’ নাম নয়, আমার নামের রোমান-রূপ (রোমানাইজড)। আর বর্তমান ব্যবহৃত এই স্ক্রিপ্টটা এসেছে মূলত লাতিন থেকে বলে এটা লাতিন-রূপও (ল্যাটিনাইজড)।

এই নাম আমরা পৃথিবীর বিভিন্ন বর্ণ ও বর্ণমালা দিয়ে প্রকাশ করতে পারি। কিন্তু, মাঝখান থেকে অনুবাদের মতো করে ‘ইংরেজি’তে নাম লেখানোর ভ্রান্তিবিলাস কেন?

একেই বোধহয় বলে ‘ম্যাকওলে মরিয়াও প্রমাণ করিয়াছেন, তিনি মরেননি’! ম্যাকওলের চৌদ্দপুরুষ একদা লাতিন ভাষা বলতেন, যখন লাতিন ভারনাকুলার ছিল। সেই লাতিন থেকে পাওয়া কাঠামো ব্যবহার করেই ইংলিশরা মাত্র কয়েক শতক আগেই ইংরেজি ভাষা বলতে শুরু করে। সেই নতুন পাওয়া কাঠামো ব্যবহার করেই সাহেব থমাস ব্যাবিংটন ম্যাকওলে ভারতবর্ষে ইংরেজির প্রচলন করেন ১৮৩৫ সালে। সে ভিন্ন কথা।

নামের ‘ইংরেজিকরণ’ করতে গিয়ে ঠাকুরের নাম কী ভয়ঙ্করদর্শন ‘Tagore’ হয়ে গেল সেই আলাপের সঙ্গেও এই আলাপ প্রাসঙ্গিক না এখানে। আমাদের প্রসঙ্গ ও প্রশ্ন হলো, ‘আপনার নামের ইংরেজি লিখুন’ বা ‘Write your name in English’- এর মোড়কে যা এখানে প্রায় ২০০ বছর ধরে গেলানো হচ্ছে, সেটাকে কেন আমরা প্রশ্নহীন মেনে নিয়েছি?

২.
নাম থেকে নেমে আসি সালে। নতুন বছরে পদার্পণ উপলক্ষে এই ভুলটা বেশি চোখে পড়ে সব সময়ই। এখন এটা আসলে ভুল নাকি অজ্ঞতা নাকি সচেতন প্রয়োগ, তা বলা মুশকিল।

প্রথমত, আমরা যে ‘যাহা ১৯ তাহাই ২০’ বলে আনন্দ করছি সেই ২০১৯ কি ২০২০ বা এদের পরে আরও যত সাল আসবে, সেগুলো মোটেও ‘ইংরেজি সাল’ নয়। ফলে, আমাদের প্রথম দায়িত্ব হলো সালকেও ‘ইংরেজি’র প্রভাবমুক্ত করা এবং ‘ইংরেজি নববর্ষের শুভেচ্ছা’ বলা/লেখা বন্ধ কর।

এটা ‘মূলত’ ‘খ্রিস্টীয়’ সাল মানা হয়। তাই, খেয়াল করবেন, লেখা হয় ‘খ্রিস্টাব্দ’। সম্ভবত, হাইপোথিসিস বলে, এই ‘সাম্প্রদায়িক’ সাল গণনাকে নাকচ করার জন্যই আমাদের তল্লাটে আমরা খুব কায়দা করে একে ‘ইংরেজি সাল’ বানিয়ে একটা ‘সেক্যুলার’ তকমা দেওয়ার চেষ্টা করে ম্যাকওলে সাহেবকে অন্যভাবে বাঁচিয়ে রেখেছি!

এই ক্যালেন্ডার বা বর্ষপঞ্জিটাকে বলা হয় ‘গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার’। সে হিসেবে এটা গ্রেগরিয়ান সাল। ঘটনা চক্রে গ্রেগরি নিজে একজন খ্রিস্টান পোপ ছিলেন। পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি।

এর আগে ছিল জুলিয়াস সিজার প্রবর্তিত জুলিয়ান বর্ষপঞ্জি। তারও আগে ছিল রোমান বর্ষপঞ্জি; এই বর্ষপঞ্জি বানিয়েছিলেন গ্রিক গনিতবিদ ও জ্যােতির্বিদেরা। মানে আমরা আজ যে ক্যালেন্ডার ব্যবহার করি, এটার একটা রূপরেখা দাঁড় করে গিয়েছিলেন রোমান ও গ্রিকরাই। কিন্তু, সূর্যবর্ষের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এই সাল গণনাকে সবচেয়ে নির্ভুল প্রমাণ ও মূল্যায়ন করা হয়েছিল গ্রেগরির সময়ে। পৃথিবীর সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে আবার নিজের ঘরে ফিরে আসতে ৩৬৫ দিনের যে একটু বেশি সময় লাগে সেটা সঠিকভাবে বলেছিলেন গ্রেগরিয়ান সময়ের গবেষকরাই। তাই, জুলিয়ানকে হটানো গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জি আজও অব্দি টিকে আছে।

১৫৮২ সালে গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জি আসার বহু আগে থেকেই অবশ্য ইউরোপের চার্চগুলো জুলিয়ানকে অনুসরণ করত। সম্ভবত চার্চের বহুল ব্যবহারের কারণে, এর গায়ে ‘খ্রিস্টাব্দ’ কথাটা সেঁটে গিয়েছে। অথচ, যখন এই সাল গণনা শুরু হয়, তখন খ্রিস্টের আবির্ভাবই ঘটেনি!

গ্রেগরির ধর্মীয় পরিচয় পরে এই কালপঞ্জিকে ‘খ্রিস্টীয়’ পরিচয়ে আরও বেশি শক্তপোক্ত করেছে বলে মনে হয়। তাছাড়া, গ্রেগরির সময়েই খ্রিস্টানদের ইস্টার পালনের সময়টিকে সুচিহ্নিতভাবে সঠিক সময়ে নির্দিষ্ট করা সম্ভব হয়। জুলিয়ান পঞ্জিতে যেটার তারতম্য হচ্ছিল। হয়তো এটাও খ্রিস্টীয় পরিচয়টির মূল কারণ হতে পারে। যদিও, গ্রেগরির আবির্ভাবের অনেক আগেই, এই সাল গণনা পদ্ধতি চালুর একটা লম্বা সময় পরে শুরু হয়ে যায় এই বর্ষপঞ্জিকে খ্রিস্টীয় বানানোর আসল পালা। তখন জুলিয়ানের ক্যালেন্ডারই ছিল। BC (Before Christ) এবং AD (Anno Domini nostri Jesu Christi লাতিনে বা The year of our Lord Jesus Christ ইংরেজিতে) লিখে, যাবতীয় সব সালকে ‘খ্রিস্টীয়’ হিসাবে লিপিবদ্ধ করে ফেলা হয়। AD প্রবর্তিত হয় ৫২৫ সালে। প্রবর্তক স্কাইথিয়া মাইনরের সাধু ডায়োনিসিয়াস এক্সিগাস। BC প্রবর্তিত হয় আরও দু’ শতক পরে, ৭৩১ সালে। নর্থআম্ব্রিয়ার সাধু ভেনেরাবেল বেদে তাঁর “Ecclesiastical History of the English People” গ্রন্থে এর প্রকাশ ঘটান। মানে যিশুকে একদম ‘প্রমিনেন্ট’ করে তোলা হয় সাল গণনার ক্ষেত্রে। তাই, সেখান থেকে আজও চলছে খ্রিস্টপূর্বাব্দ (BC) ও খ্রিস্টাব্দ (AD)।

তবে, একে আবারও ‘সেক্যুলার’ করা হয়েছে। এখন BC-র জায়গায় BCE (Before Common/Current Era) এবং AD-র জায়গায় CE (Common/Current Era) লেখা হয়। আমাদের ভাষাগুলোতে আমরা না লিখলে, এটা কার দোষ!

গ্রেগরিয়ান এ বর্ষপঞ্জি এখন পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় ও ব্যবহৃত ‘সিভিল ক্যালেন্ডার’ (CC) বা ‘নাগরিক কালপঞ্জি’, যার প্রয়োজন সর্বত্র বিরাজমান – ব্যক্তিক, রাষ্ট্রিক, নৈর্ব্যক্তিক, প্রশাসনিক, প্রাতিষ্ঠানিক সবখানে অস্তিত্বশীল এ কালপঞ্জি। এর সঙ্গে টক্কর দিয়ে ‘জাতীয়তাবাদী’ সাজতে গেলে দুনিয়ার সঙ্গে তাল মেলানোই অসম্ভব হয়ে যাবে।

কিন্তু, একে ভুল তকমা দিয়ে ব্যবহার করার ভ্রান্তিও ছাড়তে হবে। এটা ইংলিশদের ক্যালেন্ডার না, তাই একে ‘ইংরেজি সাল’ বলাই যাবে না। ব্রিটেনে এই ক্যালেন্ডার চালুই হয়েছে অষ্টাদশ শতকে। অন্যদিকে, এটা খ্রিস্টানরাও আর নিজেদের করে রাখেনি। তাছাড়া, গোড়ায় ফিরে তাকালে দেখি এটা আসলে সেই অর্থে ‘খ্রিস্টাব্দ’-ও নয়।

সবচেয়ে সহজ হতো একে ‘সূর্যাব্দ’ বা ‘solar year’ বলতে পারলে। কিন্তু, বঙ্গাব্দ নিজেই ‘সূর্যবর্ষ’ অনুসারী। এমন আরও ‘সূর্যাব্দ’ আছে দুনিয়ায়। ফলে, এতে বিড়ম্বনা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা আছে। আবার ‘সিভিল ক্যালেন্ডার’-ও প্রচুর পৃথিবীতে। কিন্তু ‘কমন সিভিল ক্যালেন্ডার’ (CCC) এই একটাই।

সাহেব ম্যাকওলের ভূত আসলেই মরেনি এখনও। সব ক্ষেত্রে হয়তো মরবেও না। কিন্তু, কিছু বিষয়ে আমরা সচেতনভাবে ভাষার প্রয়োগ করলে এবং প্রশ্নহীনভাবে আনুগত্য প্রকাশ না করলে ম্যাকওলের ‘ইংরেজিয়ানা’র প্রভাব উতরানো খুব কঠিন কিছু না।

HAPPY NEW YEAR 2020 CCC!

প্রাথমিক তথ্যসূত্র:
Robert Coolman (2014); Keeping Time: The Origin of B.C. & A.D., https://www.livescience.com/45510-anno-domini.html

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

Exit mobile version