Site icon চ্যানেল আই অনলাইন

নাবীল অনুসূর্যের ‘পৌরাণিক বাগধারা’

নাবীল অনুসূর্য গত চার বইমেলায় তিনটি বই প্রকাশ করেছেন। তিনি শুরু করেছিলেন শিশুদের জন্য লেখালেখি দিয়ে- “তের নম্বর রাজডিম” ও “কোরিয়ান রূপকথা: ব্যাঙ ডাকে ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ”। এরপর ছোট ছোট প্রেমের কবিতার ছোট বই- “পরির প্রতি পত্রাদি”। আর এবার বেশ বড়সড়, গবেষণাধর্মী একটি বই লিখেছেন তিনি “পৌরাণিক বাগধারা”। প্রকাশিত হয়েছে অবসর প্রকাশনী থেকে।

নাবীলের কাজের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, যে বিষয়টি নিয়ে লিখতে ভালো লাগে তার, ঠিক তাই নিয়ে তিনি লেখেন। সেজন্যে লেখাগুলো খুব সৎ। ভালোবাসার। আনন্দের। যেমন, রূপকথার অনুবাদ করতে গিয়ে তিনি অন্য সবার মতো “রাশিয়ান রূপকথা” লিখে বিপ্লবী লেখকদের তালিকায় নাম লেখাতে চায়নি। কিংবা চীনা উপকথা লিখে নৃতাত্ত্বিক ছাপ রাখারও চেষ্টা করেনি। কোরিয়ান চলচ্চিত্র তাকে টানে, কোরিয়ান মানুষের জীবনাচরণ তার ভালো লাগে। তাই অন্য সব লোভ সামলে সেই ভালো লাগার প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছে নাবীল, খুঁজে বের করতে চেয়েছে তাদের গল্প, তাদের রূপকথা।

আর এই বইটি, পৌরাণিক বাগধারা, সর্বার্থে বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্করণ। ব্যাকরণ বই আর ভর্তি পরীক্ষা বা বিসিএসের নোটের বাইরেও বাগধারা যে একটি ভাষার কত সমৃদ্ধ সম্পদ, বইটি তা উপলব্ধি করাতে পারবে নতুন পাঠকদের। ব্যাকরণের বাগধারার অংশ কোনোভাবেই বোকার মত মুখস্থ করার বিষয় নয়। সে অভ্যাসকে ভীষণভাবে নিরুৎসাহিত করা উচিত। বাগধারার পেছনে যে দারুণ গল্পগুলো আছে, তা জানলেই বাগধারা মনে রাখা ভীষণ সহজ। আর বাগধারার পেছনের গল্পগুলোও চিরায়ত। আর তেমনি কিছু গল্পের সন্ধান পাওয়া যাবে নাবীলের এই বইয়ে। সে গল্পগুলো নতুনেরা নতুন করে জানতে পারবেন, পুরনোরা আবার পড়তে পারবেন। ইম্পলিসিট লার্নিং বলে শেখার যে ধরণ আমাদের ঋদ্ধ করে, তার সাথে নাবীলের এই বইটি পাঠকদের যোগাযোগ করিয়ে দেবে।

বইটির বাগধারার সংকলন করতে গিয়ে নাবীল কেবল রামায়ণ আর মহাভারতেই আটকে থাকেননি, গ্রিক পুরাণ থেকেও নিয়ে এসেছেন গাঁথা। গবেষণার স্যাম্পল বা নমুনা বাছাইয়ে মনোযোগ দিয়েছেন। ঝরঝরে লেখা, যথাসম্ভব সহজ করে লেখা। কোথাও অযথা পাণ্ডিত্য নেই। তথ্যনির্ভর, পৌরাণিক শ্লোকও এসেছে প্রাসঙ্গিক হয়ে। একেবারেই বিরক্ত করবে না, দাঁতভাঙা মনে হবে না। যারা পৌরাণিক গল্পের বই খুঁজছেন, তাদের চাহিদাও মিটবে। কেবল খেলাধুলার বস্তুই যাতে সার না হয় সেজন্যে মুখবন্ধেই বলা হয়েছে রূপতত্ত্বের কথা।

নাবীল কেবল সহজ ভাষায়ই লিখেন না, জ্ঞান সংরক্ষণের বিরুদ্ধে যে আন্দোলনের প্রয়োজন আমাদের দেশে, এর সাথে সে সরাসরি যুক্ত হয়ে কাজ করেছেন বাংলাদেশের প্রথম অনলাইন শিক্ষাদাননির্ভর ফ্রি ওয়েবসাইট এডুকেশনপিডিয়া অব বাংলাদেশের (ইডিপিডিবিডি ডট কম) মতো ওয়েবসাইটে। সুতরাং এটাও প্রমাণ সাপেক্ষে বলা যায়, পৌরাণিক বাগধারা কিন্তু বাংলা বিভাগের একজন ছাত্রের মনোগ্রাফ বা থিসিসজাতীয় প্রকাশনা নয়, দীর্ঘদিন ধরে পড়াশোনার নীরস ম্যাটেরিয়ালসকে আনন্দঘন করে তুলতে কাজ করা পরিশ্রমী গবেষকের কাজ।

বইটিতে অনেক লুপ্তপ্রায়, অপ্রচলিত কিন্তু সমৃদ্ধ বাগধারা ও প্রবাদ-প্রবচন সংযোজিত হয়েছে। সম্ভবত শিট মুখস্থ করা জনগোষ্ঠীদের অনেকেই সেসব জানেন না। অথচ, কী যে শ্রুতিমধুর এই রত্নসম বাগধারা আর প্রবাদ-প্রবচনগুলো! বইটা পড়তে গিয়ে সত্যিই আফসোস হয়েছে যারা এখনো বঞ্চিত রয়েছেন তাদের জন্য। এই ধরনের বই আশা করি ইন্টারনেট-নির্ভর বইবিমুখী মানুষদের ফিরিয়ে আনবে হার্ডকপিতে।

একজন লেখক যখন তার সবচাইতে পছন্দের বিষয়টি নিয়ে লেখেন, তাতে যদি ব্যাকরণ বা তত্ত্বের মতো খটোমটো বিষয়টিও আনন্দের হয়ে যায়, কিশোরদের-তাত্ত্বিকদের-ব্যাকরণবিদদের-গবেষকদের উপকারে আসে, এরচেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে?

Exit mobile version