সামান্য বৃষ্টি হলেই তলিয়ে যায় ঢাকার রাস্তাঘাট। জলাবদ্ধতায় নাকাল হয় মানুষ। সাধারণের মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগ বাড়ে। নোংরা জল সরে গেলে বর্জ্যের দুর্গন্ধে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে। ঢাকার অধিকাংশ মানুষ বিশুদ্ধ খাবার জল পায় না। নদীগুলো হয়ে গেছে একেকটা ডোবা পুকুরের ন্যায়। গন্ধে নদী বা খালের আশেপাশে ভেড়া মুশকিল। রাস্তাঘাট চরম অব্যবস্থাপনায় পরিণত হয়েছে চলাচলের অযোগ্য। কর্মজীবী মানুষের কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। শহরের উন্নয়নের ধারাবহিকতায় শুষ্ক মৌসুমে ধূলিবালির জন্য নিঃশ্বাস নেয়া যায় না। ফুসফুসসহ নানা অঙ্গ প্রত্যঙ্গের অবিরাম ক্ষতির কারণ ঢাকার বাতাস। এ শহরে কয়েক কেটি মানুষ বাস করে। আসলে কী তারা বাস করে, না মৃত্যুর প্রতীক্ষা করে।
ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট’র এবারের জরিপে ঢাকা হয়ে উঠেছে চরম অবসবাস যোগ্য একটি নগরী। কেবল পরিত্যক্ত শব্দটি ব্যবহার করা বাকি আছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত এই তালিকায় দেখা যায়, শেষ দিক থেকে চার নম্বর স্থানে রয়েছে ঢাকা। বিভিন্ন দেশের শহরের ওপর জরিপ চালিয়ে ১৪০টি শহরের র্যাঙ্কিং প্রকাশিত হয়েছে। এ তালিকায় ১৩৭ নম্বরে রয়েছে ঢাকা।
নতুন এ জরিপ অনুযায়ী ২০২১ সালে বসবাসযোগ্য শহরের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে জাপানের ওসাকা। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেড। চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে নিউজিল্যান্ডের ওয়েলিংটন ও জাপানের টোকিও শহর। ষষ্ঠ অবস্থানে অস্ট্রেলিয়ার পার্থ। সপ্তম, অষ্টম, নবম ও দশম অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে সুইজারল্যানন্ডের জুরিখ, জেনেভা এবং অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন ও ব্রিসবেন।
রয়টার্স বলছে, করোনাভাইরাসের মহামারির কারণে বসবাসযোগ্য শহরের ক্রমে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা এ তালিকায় শীর্ষে ছিল ২০১৮ সাল থেকে। কিন্তু এবার শীর্ষ ১০ শহরের মধ্যে স্থান পায়নি ভিয়েনা। ২০১৯ সালে ভিয়েনার সঙ্গে একই পয়েন্টে নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থান ছিল অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন। সেই মেলবোর্ন এবার আট নম্বরে নেমে এসেছে। করোনার মোকাবিলায় কোন দেশ কেমন পদক্ষেপ নিয়েছে, তার প্রভাব পড়েছে বসবাসযোগ্য শহরের তালিকায়।
ইকোনমিস্ট গত বছর বসবাসযোগ্য শহরের যে র্যাঙ্কিং করেছিল, তা বাতিল করা হয়েছে। এ কারণে সর্বশেষ র্যাঙ্কিং প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে। সেই তালিকা অনুসারে বিশ্বের বসবাসের অযোগ্য শহরগুলোর তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে ছিল ঢাকা। বসবাসযোগ্যতার দিক দিয়ে ওই বছর ১৪০টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ছিল ১৩৮তম। সেই হিসেবে এক ধাপ অগ্রগতি হয়েছে ঢাকার। এবার বসবাসযোগ্য শহরের তালিকায় একেবারে তলানিতে রয়েছে সিরিয়ার দামেস্ক। ১৪০টি শহরের তালিকায় এর অবস্থান ১৪০তম। ১৩৯ তম অবস্থানে রয়েছে নাইজেরিয়ার লাগোস। ১৩৮ তম অবস্থানে পাপুয়া নিউগিনির পোর্ট মোরেসবি।
বসবাসের যোগ্যতার দিক থেকে শহরগুলোর মোট পাঁচটি বিষয়কে সূচকে আমলে নেওয়া হয়। এর জন্য মোট ১০০ নম্বর ঠিক করা হয়। এর মধ্যে ঢাকা পেয়েছে ৩৩ দশমিক ৫ নম্বর। এর মধ্যে শহরের স্থিতিশীলতার দিক থেকে ৫৫, স্বাস্থ্যসেবায় ১৬ দশমিক ৭, সংস্কৃতি ও পরিবেশে ৩০ দশমিক ৮, শিক্ষায় ৩৩ দশমিক ৩ এবং অবকাঠামোতে ২৬ দশমিক ৮ নম্বর পেয়েছে ঢাকা।
দেখা যাচ্ছে উন্নত দেশগুলোর শহরগুলো করোনার প্রভাবে র্যাঙ্কিয়ে হেরফের হয়েছে। কিন্তু ঢাকার ক্ষেত্রে এটি বিশেষ কোনো ভূমিকা রাখেনি। অর্থাৎ আমরা যুদ্ধ বিধ্বস্ত সিরিয়ার দামেস্ক শহরের তুলনায় সামান্য এগিয়ে আছি। এটা ভাবা যায় একটি যুদ্ধসংগ্রামে ক্ষতবিক্ষত শহরের মত নগরে আমরা বাস করি নিশ্চিতে। তবে এখানে মৃত্যু গ্রাস করছে আমাদের ধীরে ধীরে। কার্বণ নিঃসরণে এগিয়ে থাকা নোংরা জলাবদ্ধতায় এগিয়ে থাকা এই শহরে মানুষ থাকে কী করে। আসলে আমাদের উন্নয়নের মেগা স্ট্রাকচার একটি জাদুবাস্তবতা। এসব আরও স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে কঠিন করে তুলেছে। বিভিন্ন অসুখ বিসুখে মারা যাওয়া এই নগরের নাগরিকদের এই শহরকে একদিন পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হবে। আমাদের সরকার বা সিটি কর্পোরেশনগুলো এইসব সমস্যার সমাধান করতে পারবে? ৪০০ বছরের পুরনো শহরে গত ৫০ বছরে জমেছে অনেক জঞ্জাল। তা সরানো খুব কঠিনও নয় আবার। কিন্তু সেটা কে করবে?