চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

দেখার দৃষ্টি: কে মুনিব কে ভৃত্য

ঢাকার কমলাপুর রেল স্টেশন। সকাল ৭টা। যাত্রীদের প্রবেশপথ। টিকিট চেকার বা টিটি এবং আনসাররা যারা প্রবেশ করছে তাদের টিকিট চেক করছে। একজন টেলিভিশন সাংবাদিক তার ক্যামেরা মাইক্রোফোন ও কার্ড গলায় না ঝুলিয়ে একজন সাধারণ যাত্রীর মতো জিজ্ঞাসা করলেন, ভাই সকালে কোন ট্রেন কয়টায় আসার টাইম? বেশ রাগী চেহারা নিয়ে বললেন, কেমনে বলবো? ডিসপ্লেতে দেখেন গা?
আরে ভাই, ডিসপ্লেতে আসার তথ্য নেই তো তাই জানতে চাচ্ছি?
আরো রাগী চেহারা করে, আমি কি জানি, ওখানে যা আছে তাই?
সাংবাদিকের একটু মন খারাপ হলো। সে তখন একটু সিরিয়াস হলো?
ভাই, আপনার কোন সমস্যা, আপনি এত রাগ দেখাচ্ছেন কেনো? একটু হাসি হাসি মুখে কথা বলেন?
এবার চূড়ান্ত ক্ষমতা দেখালেন টিটি? অই মিয়া তুমি কে, তোমাকে এত কথা বলতে হবে?
সাংবাদিক বললেন, আমি সাধারণ যাত্রী, তোমার আমাকেই বলতে হবে।
নিজ সহকর্মীর সাথে একজনের এই বাতচিতে সহযোগী হয়ে আসলো দীর্ঘদেহী আরেকজন টিটি। তার ফ্যাশনকাট দাড়ি আছে। তিনিসহ আনসাররা বললো তুমি কে?
সাংবাদিক বললেন, পরিচয় দিলে তোমাদের সমস্যা হবে, পরিচয় জানতে চেয়ো না?
টিটি সমাজ এবার চুড়ান্ত ক্ষমতা দেখাতে চাইলো। সঙ্গে সঙ্গে ঐ সাংবাদিক তার কার্ডটি বের করে তাদের সামনে ঝুলিয়ে ধরলো।

দীর্ঘদেহী টিটি কার্ড ধরে টান মারতে চাইলো। সাংবাদিক বুঝতে পারলো দশ চক্রে তাকে ভূত বানিয়ে ছেড়ে দিতে পারে টিটি ও আনসার সমাজ। সে ইতিউতি তাকিয়ে দেখে হঠাৎ করে স্টেশন ম্যানেজার আমিনুল ও সহকারী কর্মাশিয়াল অফিসার সীতাংশু আসছেন। তার কাছে গিয়ে পুরো ঘটনা বললেন।

এখানেও এক টিটি বুঝাতে চেষ্টা করলেন সেই সাংবাদিকই ভুল করেছে। এবার সাংবাদিকের মেজাজ সপ্তমে চড়লো। সীতাংশু ও আমিনুল এই সাংবাদিককে চেনেন গত এগার বছর ধরে। কখনো এতটা রাগ করতে দেখেননি তাকে। সাত বছর পূর্বে এই সাংবাদিক আনসার বেশে টিকিট কালো বাজারী ধরতে গিয়ে উল্টো কালোবাজারি সিন্ডিকেটের খপ্পরে পড়েছিলেন। সেবার পত্রিকায় ঐ ছবি বড় হেড লাইন হয়েছিলো। সাংবাদিক পরে ভাবলেন, কেনো একজন টিটি এমন আচরণ করলেন। চিন্তার কোন স্থানের শুন্যতা টিটির মতো একজন কর্মচারীর নাগরিকের সাথে রুঢ় আচরন করে।

বাংলাদেশের রেলওয়ে স্টেশনসহ ট্রেনগুলোতে লেখা থাকে রেল দেশের সম্পদ এটি রক্ষা করার দায়িত্বও জনগণের। এ কথাটি যদি সত্য ধরে নেই তাহলে এই রেলের মালিকও জনগণ। জনগণের মালিকানায় থাকা সেক্টরে যারা কাজ করেন তারাও জনগণের কর্মচারী। অথচ কি অদ্ভূত? যার কর্মচারী তার সাথে বাজে ব্যবহার করি।

শুধু রেল নয় বাংলাদেশের প্রতিটি সরকারি অফিস আদালতে সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত, নিপীড়িত, নিস্পেষিত সাধারণ মানুষ। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৭ম অনুচ্ছেদে রয়েছে, এই রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ। জনগণের পক্ষে এই ক্ষমতার প্রয়োগ হবে।
শুধু তাই নয় যারা এই রাষ্ট্রের কষ্টের টাকায় প্রতিপালিত হবেন তারা রাষ্ট্রের তথা জনগণের কর্মচারি হিসেবে কাজ করবেন।

ত্রিশ লক্ষ শহিদ, অসংখ্য মা-বোনের সম্ভ্রমহানি আর নাম না জানা মুক্তিযোদ্ধার আত্মত্যাগে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্র জন্মের প্রয়োজন হয়েছিলো কারণ সে সময় মাত্র ২২ টি পরিবার পুরো বাংলাদেশের সম্পত্তি ব্যবসা বাণিজ্য কব্জা করে রেখেছিলো। পুঁজিপতি বুর্জোয়া রাজত্ব কায়েমে পূর্ণ সহযোগি ছিলো তৎকালিন আমলা শ্রেণি। তারা যত না জনগণের পক্ষে কাজ করতো তার চেয়ে বেশি ঐ ২২ পরিবারের পক্ষে কাজ করতো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ প্রগতিশীল রাজনীতিবিদরা ঐ বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন।
ব্যক্তিভিত্তিক রাষ্ট্র নয়, সামষ্টিক কল্যাণ রাষ্ট্রের লক্ষ্যে যাত্রা শুরু করেছিলো বাংলাদেশ।

কিন্তু কি নির্মম পরিণতি। ট্রেনে একজন টিকিট চেকারও রাষ্ট্রের মালিকের পিণ্ডি চটকাতে চান। সরকার জনগণকে কর দিতে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন। জনগণও সেই উৎসাহে সাড়া দিচ্ছেন। সেই করের টাকায় সরকার সরকারি কর্মচারিদের সুবিধার সর্বোচ্চটুকু দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন। লক্ষ্য তারা যেনো উৎকোচসহ কোনো ধরণের হয়রানি ছাড়াই জনগণকে সেবা দিয়ে যান।

বাংলাদেশের বতর্মান আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় কর্মবন্টন ব্যবস্থার উৎগাতা ছিলো ব্রিটিশরাজ। তারা তাদের নীতি ও উদ্দেশ্যে বাস্তবায়ন এবং বঙ্গ থেকে তাদের সর্বোচ্চ সম্পদ আহরণই ছিলো লক্ষ্য। এখন সেই ব্রিটিশ নেই কিন্তু ব্রিটিশ চাকুরির মুনিব-ভৃত্য মডেলের শিকার সাধারণ জনগণ এখনো।

বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মার্গারেট থেচার। রাষ্ট্রজনোচিত নীতি পরিবর্তনের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন। একজন বিখ্যাত নারী প্রধানমন্ত্রী। তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আমলাতন্ত্রকে ছুড়ে ফেলে দিতে চাইলেন। তিনি আমলাদের ডাক বা হাস ডাকতেন। কেনো?
থেচার বলতেন, ব্যুরোক্রেসি ইজ এ ডাক সিস্টেম। অ্যা ডাক কেন ওয়াক বাট কান্ট ওয়াক ওয়েল, অ্যা ডাক কেন সুইম বাট কান্ট সুইম ওয়েল, অ্যা ডাক কেন ফ্লাই বাট কান্ট ফ্লাই ওয়েল।
আই সুড ফ্রি ফরম দিস ডাক। তিনি তাই হয়েছিলেন। এ কারনে মার্গারেট থেচার রাষ্ট্র পরিচালনায় আয়রন লেডির খেতাব পান।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)