মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের বিজয়ের ৪৫ বছর পূর্ণ হয়ে ৪৬ বছরে পা রাখতে যাচ্ছে। এ উপলক্ষে উন্নয়ন ও গণমাধ্যমকর্মী মোহাম্মদ গোলাম নবী আগামী ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্জন-ব্যর্থতা ও করণীয় বিষয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখছেন চ্যানেল আই অনলাইন পাঠকদের জন্য। পর্ব-৩ (ডিসেম্বর ৩, ২০১৬)
“আমার ছেলেমেয়ে ছিল ৬ জন, এখন বেঁচে আছে মাত্র ২ জন। পানির অভাবে অসুস্থ হয়ে তারা একে একে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। আমি কী করতে পারতাম? তাদের পানি না খাইয়ে রাখতে পারতাম। আমরা প্রায়ই অসুস্থতায় ভুগি। আমাদের জ্বর হয়, পেট কামড়ায় কিংবা ডায়রিয়া হয়। এই গ্রামের অনেকেই মারা গিয়েছে শুধু পানির কারণে।”- কথাগুলো কোন বাংলাদেশির নয়। পশ্চিম আফ্রিকার দেশ বুরকিনা ফাসোর ৪৫ বছর বয়সী এক নারী মিজ সেগুয়েতার। তার বাড়ির কাছে একসময় একটা নদী ছিল। সেই নদীতে এখন পানি নেই। সেখানে গ্রামের নারী ও শিশুরা মাটি খুঁড়ে পানি বের করে। সেগুয়েতা বলেন, “আমরা রাতে ঘুমাতে যাই পরেরদিন পানি পাব কি পাব না সেকথা ভেবে। পানির সন্ধানে শুকনো নদীতে আমরা মেয়েরা সবাই যাই। ছেলেমেয়েরাও স্কুলে যাওয়া বাদ দিয়ে পানির জন্য মাটি খুড়ে। আমি জানি ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করা উচিৎ। কিন্তু আগে তো বাঁচতে হবে, তারপর না লেখাপড়া। এদিকে পুরুষরা তো সবাই কাজের সন্ধানে পাশের দেশ আইভরি কোস্টে থাকে।”
বুরকিনা ফাসোর অবস্থা বাংলাদেশেও হতে পারে। আমাদেরও নদীর পানি কমে যাচ্ছে। যেগুলো আছে সেগুলোও তীব্র দূষণের শিকার। এদিকে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনবরত নিচের দিকে নামছে। উত্তরাঞ্চলে কমবেশি প্রতিবছর খরা দেখা দেয়। শুনলে অবাক লাগবে কিন্তু সত্যিটি হলো নদ-নদীতে ভরা দক্ষিণাঞ্চলের মানুষও পানির সমস্যায় পড়তে শুরু করেছে। পানিতে লবণের তীব্রতা বাড়ছে। আর সারাদেশেই টিউবওয়েলের পানিতে আর্সেনিকের “আক্রমণ” তো আছেই। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে একসময় বাংলাদেশ যদি বুরকিনো ফাসো হয় তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এখনই কেউ যদি খুলনার মংলা কিংবা কক্সবাজারের টেকনাফের গ্রামগুলোতে যান দেখবেন মানুষের পানির কি কষ্ট সেখানে। বিশেষ করে খাবার পানির। বাড়ির চারদিকে পানি অথচ খাবার পানি নেই। এটি গিয়ে নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করানো যাবে না। নদীমাতৃক এই দেশে ৪৫ বছর পরেও পানির সঙ্কট থাকাটা বিরাট লজ্জার বিষয়। তার থেকেও ভয়ের বিষয় হলো বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা করার চ্যালেঞ্জ দেশের বয়স বাড়ার সাথে সাথে বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো দেশের মানুষের কাছে নিরাপদ খাবার পানি সাশ্রয়ী মূল্যে পৌঁছানো। খোদ রাজধানী ঢাকা শহরে মানুষের খাবার পানির কষ্ট কি কম?
নিরাপদ খাবার পানি একটি মানবাধিকার এবং সুস্বাস্থ্যের জন্য একটি মৌলিক চাহিদা। খাবার পানি জীবাণু দ্বারা দূষিত হলে সেখান থেকে সিগেলোসিস ও কলেরাসহ ডায়রিয়া রোগ হতে পারে। এছাড়াও খাবার পানি থেকে হেপাটাইসিস, টাইফয়েড এবং পোলিও রোগ হতে পারে। শিশুদের বেটে হওয়ার সঙ্গেও খাবার পানির দূষণের সম্পর্ক আছে। আমাদের দেশে খাবার পানি কল-কারখানার রাসায়নিক পদার্থ দ্বারা দূষিত হয়ে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর হতে হচ্ছে। প্রাকৃতিকভাবে পানিতে যে রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রিত হয় বিশেষ করে আর্সেনিক ও ফ্লোরাইড অনেক মানুষের জন্য সম্ভাব্য ক্ষতির কারণ হচ্ছে। সব মিলিয়ে পানি থেকে বিপদ হতে পারে যেকোনো সময়। একারণে সরকারের অন্যতম দায়িত্ব হলো মানুষের কাছে নিরাপদ খাবার পানি পৌঁছানো।
দেশের মানুষকে পানির আওতায় আনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ একটি গরিব ও ১৯৭১ সালে যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি দেশে ৯৮ ভাগ মানুষের কাছে পানি পৌঁছানো চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু সেই পানির বেশিরভাগই মানুষের পানের জন্য নিরাপদ নয়। দেশের মাত্র ৩৫ শতাংশ মানুষ নিরাপদ খাবার পানি পাচ্ছে, এই তথ্যটি নিশ্চয়ই সুখকর কোন সংবাদ নয়। এই তথ্য জানা যায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো কর্তৃক ২০১২-২০১৩ সালে প্রকাশিত মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভের সর্বশেষ রিপোর্ট থেকে। ওই রিপোর্ট থেকে আরো জানা যায় যে, বাংলাদেশে পানির মতো জীবনরক্ষাকারী সম্পদেও বিরাট বৈষম্য রয়েছে। পাইপের মাধ্যমে পানি পাওয়ার ক্ষেত্রে এই বৈষম্য অচিন্তনীয়। দেশের ধনীদের কাছে পাইপের মাধ্যমে পানি সরবরাহের পরিমাণ হতদরিদ্রদের চেয়ে ৪৬ গুণ বেশি।
১৯৭১ সালে দেশ যখন স্বাধীন হয়েছিল পানিবাহিত রোগ ডায়রিয়া কলেরার প্রাদুর্ভাবে প্রতিবছর বহু মানুষ মারা যেতো। সেসময়ে দেশের বেশিরভাগ মানুষ পুকুরের পানি খেতো। ব্রিটিশ আমলে প্রতিটি গ্রামে একটি করে সরকারি রিজার্ভ পুকুর তৈরি করা হয়েছিল। গ্রামের মানুষ সংরক্ষিত সেই পুকুরের পানি খেতো। এই পুকুরে কেউ গোসল করত না কিংবা কাপড় চোপড় ধুতো না। এখনো অনেক গ্রামে সেই পুকুর আছে। কিন্তু সেই পুকুর আর আগের মতো ব্যবহার করা হয় না। এদিকে দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে থেকেই বিভাগীয় ও জেলা শহরে রাস্তার পাশে কল লাগিয়ে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। মানুষ কলসি ভরে সেই পানি সংগ্রহ করত। থানাগুলোতে এবং ইউনিয়নে সীমিত আকারে সুবিধাজনক স্থানে গভীর নলকূপ বসানো ছিল, সেখান থেকে মানুষ তাদের প্রয়োজনীয় পানি সংগ্রহ করত। গোসল করা, থালাবাসন ধোওয়া কিংবা কাপড়-চোপড় ধোওয়ার কাজ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুকুরেই সারা হতো। যা এখনো কম-বেশি গ্রামের বেশিরভাগ জায়গায় হয়ে থাকে। একটু অবস্থাসম্পন্ন পরিবারগুলোতে নিজেদের পুকুর থাকে, আর যাদের পুকুর নেই তাদের পানি পুকুর থেকে ভাড়ওয়ালা দিয়ে আনিয়ে নেয়। এরপর ধীরে ধীরে বাংলাদেশের বয়স বাড়তে লাগল বাংলাদেশের গ্রামের মানুষের পাশাপাশি উপজেলা ও শহরতলির বাসিন্দাদের কাছে পানি পৌঁছানোর জন্য নলকূপ প্রযুক্তিকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এসময়টায় বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে সরকার ও এনজিওরা সারাদেশে ব্যাপকভাবে নলকূপ বসিয়েছে সঠিক পরিকল্পনা ছাড়াই কিংবা যে যার ইচ্ছেমতো। এতে দেশের ৯১ ভাগ এলাকা নলকূপের পানির আওতায় আনা সম্ভব হলেও ভূগর্ভস্থ পানিতে চাপ বেড়েছে। আর অন্য যে ভয়াবহ বিপদটি ঘটেছে সেটি হলো পানিতে আর্সেনিক দূষণ। ফলে এখন আবার ভূপৃষ্ঠের পানি ব্যবহারের উপর জোর দিয়ে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের এই ধরনের হুজুগে কর্মকাণ্ড এবং সুদূরপ্রসারী দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনাহীন উন্নয়নের কারণেও গরিব দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের চাপ তৈরি হচ্ছে।
আর্সেনিক হলো মানবদেহের জন্য ক্যান্সারস্বরূপ। বাংলাদেশে নব্বইয়ের দশকে ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিক পাওয়া যায়। আর্সেনিক দূষণযুক্ত নলকূপে লাল রং এবং নিরাপদ নলকূপে সবুজ রং করার মাধ্যমে জনগণকে নিরাপদ পানি পৌঁছানোর চেষ্টা খুব একটা সাফল্য দেখাতে পারছে না। ২০০৯ সালে আর্সেনিক দূষণের শিকার জনসংখ্যা ছিল ১৩.৪ শতাংশ। যা ২০১৩ সালে হয়েছে ১২.৪ শতাংশ। অর্থাৎ ৫ বছরে মাত্র ১ শতাংশ কমেছে। আবার আর্সেনিক দূষণের ক্ষেত্রে সরকারের নির্ধারিত মাত্রা আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মাত্রা এক নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৯৩ সালে খাবার পানিতে আর্সেনিকের নিরাপদ মাত্রা নির্ধারণ করে প্রতি বিলিয়নে ১০ পার্টস (পিপিবি) নির্ধারণ করে দেয়। সরকারি হিসেবে এটা হলো ৫০ পিপিবি। যেকারণে সরকারি মাত্রা বিবেচনায় নিলে প্রায় ২ কোটি মানুষ আর্সেনিক দ্বারা দূষিত পানি পান করছে আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মাত্রার বিচারে এই সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি।
প্রশ্ন হচ্ছে সরকার দেশের মানুষের এতো বড় বিপদে কি করছে? বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত থেকে দেখা যায় যে, সরকারিভাবে পানির সমস্যা সমাধানে অনেক কাজ করা হচ্ছে। দেশের মানুষের জন্য বিভিন্ন ধরনের উন্নয়নমূলক কাজে বার্ষিক যে অর্থ খরচ করে তার প্রায় ৫ শতাংশ খরচ করা হচ্ছে পানির জন্য। কিন্তু সেই খরচগুলো করার ক্ষেত্রে না আছে কাজের সমন্বয় না আছে পর্যাপ্ত জবাবদিহিতা। নিরাপদ পানির ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনায় রয়েছে বিরাট ঘাটতি। সরকারি কাজের মনিটরিং ব্যবস্থাও দুর্বল। এদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বাড়ছে। সবমিলিয়ে গরিব বাংলাদেশের মানুষ বড় বিপদে আছে। আর সেই বিপদ বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে সরকারি কাজের দুর্নীতি। স্বার্থবাদী রাজনীতিবিদদের “খাই খাই স্বভাব”। ফলে সরকারি কাজের দুর্নীতি ও রাজনীতিবিদদের যৌথ প্রযোজনায় জীবন দিয়ে খেসারত দিতে প্রস্তুত হচ্ছে বাংলাদেশ ও দেশের মানুষ । সরকারি পরিসংখ্যান থেকেই দেখা যায় যে, স্বাধীন বাংলাদেশের ৯ কোটি ৯০ লাখ মানুষ বাসাবাড়িতে জীবাণু দ্বারা দূষিত পানি ব্যবহার করে। এই মানুষদের জীবনের দায় স্বাধীন বাংলাদেশে কে নেবে? সেই প্রশ্নের উত্তর দ্রুত খুঁজে বের করে এর একটা সমাধান বের করাটাই এখন সময়ের দাবী।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)