বিজ্ঞানলেখক ও মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ড. অভিজিৎ হত্যা মামলার রায়ে ছয় আসামির মধ্যে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের পাঁচ সদস্যকে মৃত্যুদণ্ড এবং উগ্রপন্থি এক ব্লগারকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। গত মঙ্গলবার ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবুর রহমান তার রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছেন, “নাস্তিকতার অভিযোগ এনে নিষিদ্ধ সংগঠন আনসার আল ইসলামের সদস্যরা, অর্থাৎ এ মামলার অভিযুক্তরাসহ মূল হামলাকারীরা সাংগঠনিকভাবে অভিজিৎ রায়কে নৃশংসভাবে হত্যা করে। স্বাধীনভাবে লেখালেখি ও মতপ্রকাশের জন্যে অভিজিৎ রায়কে নিজের জীবন দিয়ে মূল্য দিতে হয়।” বিচারক তার পর্যবেক্ষণে আরও বলেছেন, “অভিজিৎ রায়কে হত্যার উদ্দেশ্য হল জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে বন্ধ ও নিরুৎসাহিত করা, যাতে ভবিষ্যতে কেউ স্বাধীনভাবে লেখালেখি ও মত প্রকাশ না করতে পারে।”
অভিজিৎ রায় হত্যার মামলার রায়ের আগে এ মাসেই তার বইয়ের প্রকাশক জাগৃতি প্রকাশনীর ফয়সাল আরেফিন দীপন হত্যা মামলায় রায় আসে একই আদালত থেকে। ওই রায়ে আট আসামির প্রত্যেককেই মৃত্যুদণ্ড দেন বিচারক। অভিজিতের মামলার আসামিদের মধ্যে অন্তত চারজন দীপনের মামলায়ও দণ্ডপ্রাপ্ত। অভিজিতের মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত যা বলেছেন তার অনেকটাই মিলে যায় দীপনের রায়ের ক্ষেত্রেও। দুই রায়েই আদালত যা বলছেন তা হচ্ছে- মানুষের মনে আতঙ্ক তৈরি করে জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করা আর এসব উদ্দেশ্যই হলো মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে বন্ধ করে দেওয়া। রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক চরিত্র ধ্বংস করে দেওয়াই ছিল আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্যদের লক্ষ্য। আদালতের এই পর্যবেক্ষণ ভয়ের পরিবেশের বিপরীতে এক নির্ভয় সমাজ ব্যবস্থা বিনির্মাণের যে আকাঙ্ক্ষা সেটাই প্রতিভাত হয়েছে। ভয়ের পরিবেশ তৈরিকে আদালত অপরাধতুল্য বলে বিচারিক পর্যায়েও স্বীকৃতি দিয়েছেন, এবং বলছেন ‘আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলে একদিকে নিহত ব্যক্তির আত্মীয়রা মানসিক শান্তি পাবেন, অন্যদিকে ভবিষ্যতে এ ধরনের জঘন্য অপরাধ করতে অন্যরা ভয় পাবে এবং নিরুৎসাহিত হবে।’
লেখালেখির কারণে এবং লেখা প্রকাশের কারণে অভিজিৎ রায় ও ফয়সাল আরেফিন দীপনকে হত্যা করেছিল ধর্মীয় দুর্বৃত্তরা, এটা আদালতের রায় থেকেই স্পষ্ট। ভবিষ্যতে এ ধরনের জঘন্য অপরাধ করতে অন্যদের ভয় পাইয়ে দিতে এবং নিরুৎসাহিত করতে আদালত মনে করেছেন আসামিদের এক্ষেত্রে শাস্তি হওয়া বাঞ্ছনীয়। এটা সুস্থ সমাজ বিনির্মাণের পদক্ষেপ নিশ্চিতভাবেই। রায়ে দেওয়া আদালতের এই পর্যবেক্ষণ স্বাধীন লেখালেখির পরিবেশ, মুক্তভাবে মতপ্রকাশের অধিকারকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বাস্তব ক্ষেত্রে কি সেই পরিবেশ আছে, কিংবা রাষ্ট্র-সরকার সেটা গ্রাহ্য করছে, প্রশ্ন!
প্রশ্নটা প্রাসঙ্গিক কারণ ধর্মীয় সন্ত্রাসীদের চাপাতির কোপে অভিজিৎ-অনন্ত-দীপনেরা প্রাণ হারানোর পর প্রশাসনের উচ্চপদস্থরা লেখালেখির মাধ্যমে ‘সীমা লঙ্ঘন’ না করার নসিহত দিয়ে আসছেন, সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নানাজনের মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে ‘আমারও অনুভূতি আহত হয়’ নামীয় নানা বার্তা। এসবের মাধ্যমে দুর্বৃত্ত-সৃষ্ট ভয়ের পরিবেশে আরও বেশি ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, এতে স্বাধীন লেখালেখি ও মুক্তচিন্তার পরিবেশকে বাধা দেওয়া হয়েছে, হচ্ছে। এসবের বাইরে আছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নামের আইনের সীমাহীন অপব্যবহার, ছিল তথ্য প্রযুক্তি আইনের সাতান্ন ধারার নামীয় আরেক কালাকানুন। একদিকে চাপাতি হাতে ধর্মীয় সন্ত্রাসী আর অন্যদিকে মুক্তচিন্তাকে অভয় না দিয়ে চোখ রাঙানির মত যে সকল ঘটনা সেগুলো আদতে ভয়ের পরিবেশকে দূরীভূত করার চাইতে ভয়ের পরিবেশকে আরও ঘনীভূত করেছে।
প্রসঙ্গক্রমে অনেক উদাহরণ টানা যায়। নিকট অতীত থেকে চলমান নানা ঘটনার মধ্যে ফটোসাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের দীর্ঘ কারাবাস আরও অবিদিত নয়। ফেসবুকে একটা পত্রিকার লিঙ্ক শেয়ারের ‘অপরাধে’ তাকে যেভাবে হেনস্থা করা হয়েছে সেটা ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের অসহিষ্ণুতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সাবেক এক কর্মচারী, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও বর্তমান এক সাংসদের মামলায় নয় মাস কারাগারে কাটাতে হয়েছে তাকে। ফেসবুকে লিঙ্ক শেয়ারের কারণে প্রথমে তাকে পাওয়া যায়নি কোথাও। এরপর তাকে আবিস্কার করা হলো সীমান্তে। দেওয়া হলো নিজ দেশে ‘অবৈধ অনুপ্রবেশের’ মামলা। পুলিশের কাছে যাওয়ার পর দেওয়া হলো আরও মামলা। মামলার পর মামলা দিয়ে তাকে জেলে আটকে রাখা হলো। দিনের পর দিন জামিন পাননি তিনি। ‘গুম’ হয়ে যাওয়ার পর তার পুত্র প্রশাসনের সহযোগিতা চেয়েও পায়নি। এগুলো নিশ্চিতভাবেই ভালো উদাহরণ হনয়। সাংবাদিক কাজলকে এই হয়রানির মাধ্যমে ওই সাংসদ কি জিতে গেছেন? না, জিতেননি তিনি। সাংবাদিক কাজলকে এই হয়রানি দেশ-বিদেশে আলোচিত হয়েছে। সরকার হয়েছে সমালোচিত।
সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল অবশেষে জামিন পেয়েছেন। এদিকে কার্টুন আঁকার কারণে কারাগারে আছেন কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর ও লেখক মুশতাক আহমেদ। গতবছরের ৫ মে কার্টুনিস্ট কিশোর ও লেখক মুশতাক আহমেদকে র্যাব গ্রেপ্তার করার পর তাদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দেওয়া হয়। র্যাবের অভিযোগ- গত এপ্রিল এবং মে মাসে কার্টুনিস্ট কিশোর ফেসবুকে ‘লাইফ ইন দ্য টাইম অব করোনা’ শিরোনামে ধারাবাহিকভাবে কার্টুন প্রকাশ করেন, যেখানে এই মহামারি রোধে সমাজের ভূমিকা নিয়ে বিদ্রূপ করা হয়েছিল আর সরকার যেভাবে জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি সামলেছে তার সমালোচনা করা হয়েছিল। কিশোর-মুশতাকের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা ফেসবুকে জাতির জনক, মুক্তিযুদ্ধ, করোনাভাইরাস মহামারি সম্পর্কে গুজব, রাষ্ট্র/সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার অভিপ্রায়ে অপপ্রচার বা বিভ্রান্তি ছড়ানো, অস্থিরতা-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছেন। একই অভিযোগে অ্যাক্টিভিস্ট দিদারুল ভূঁইয়া এবং ব্যবসায়ী মিনহাজ মান্নানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, পরে তারা জামিন পেয়েছেন। কিন্তু অদ্যাবধি জামিন মেলেনি কিশোর-মুশতাকের।
করোনা মহামারির শুরুতে সরকারের নানা ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতা এতখানি করুণ ছিল যে খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রীও প্রকাশ্য প্রেস ব্রিফিংয়ে ‘তাকে কিছু জানানো হয় না’ বলে অভিযোগ করেছিলেন। দেশের নানা প্রান্তে স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা চাল চুরির যে ঘটনাগুলো ঘটেছে তার বিপরীতে মন্ত্রণালয়কেই কঠোর ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে। অনেককেই আইনের আওতায় ওই সময় আনা হয়েছিল। সকালে এক সিদ্ধান্ত দিয়ে বিকেলে কিংবা পরের দিনই সেই সব সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের মত নানা ঘটনাও ঘটেছে ওই সময়ে। সমন্বয়হীন সেই পরিস্থিতিতে সরকারের নানা ভূমিকায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকার সমর্থক অ্যাক্টিভিস্টদেরও সমালোচনামুখর থাকতে দেখা গেছে। ওই সমালোচনাগুলো আদতে কথিত ‘গুজব’ তৈরির অপচেষ্টা নয়, জনস্বাস্থ্যে উদ্বিগ্ন নাগরিকের প্রবল আকুতি ছিল ওগুলো। সে সময়ে কার্টুনিস্ট কিশোর অন্য সকলের মত তার নিজস্ব ভাষায় প্রতিবাদ করেছেন। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে এই প্রতিবাদ ছিল তার স্বতঃস্ফূর্ত নাগরিক উদ্বেগের প্রকাশ। কিন্তু সেটা সহ্য করতে পারেনি রাষ্ট্র, তাই তাকে ফেলে রেখেছে কারাপ্রকোষ্ঠে।
সামাজিক অসঙ্গতি শিল্পসহযোগে প্রকাশই যেকোনো কার্টুনিস্টের স্মারক। আহমেদ কবির কিশোর এর ব্যতিক্রম নন। স্বাভাবিকভাবেই করোনাকালের অসঙ্গতিগুলো ওঠে এসেছিল তার তুলির আঁচড়ে। এই প্রকাশ সহ্য করতে না পারা আমাদের নীতিনির্ধারকদের অসহিষ্ণুতা, এটা তাদের দীনতা; দুঃখের বিষয় এই দৈন্যের খেসারত দিতে হচ্ছে রাষ্ট্রকে, হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে কিশোরকে। তার দীর্ঘ এই কারাবাস, জামিন না পাওয়া বাজে উদাহরণ হিসেবে লিখা থাকবে ইতিহাসে।
শুরু করেছিলাম অভিজিৎ-দীপনের রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে যেখানে বলা হয়েছে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করতে হত্যার মত ঘটনা ঘটিয়েছিল অপরাধীরা। সেই ভয়ের পরিবেশকে সমর্থন করেননি আদালত। ভয়কে জয় করে নির্ভয়চিত্ত মানবিক সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে অপরাধীদের শাস্তি দিয়ে অপরাধকে নিরুৎসাহিত করতে চেয়েছেন আদালত। অপরাধীদের শাস্তি দিয়ে আদালত বলতে চেয়েছেন মুক্তচিন্তা অপরাধ নয়। অথচ এই দেশেই সেই মুক্তচিন্তার পরিবেশকে বাধা দেওয়া হচ্ছে। অন্য অনেকের মত কিশোর-মুশতাকের কারাবাস, জামিন না পাওয়া সেই ভয়ের পরিবেশকেই জিইয়ে রাখার অপচেষ্টার প্রতিনিধিত্ব করছে।
ভয় দেখিয়ে কিছু জয় করা যায় না, কারণ ভয় ক্ষণস্থায়ী। অসম সাহসী না হলেও ভয় পেতে পেতে মানুষ একটা সময়ে সে ভয়কেই জয় করে ফেলে। তাই অন্যায়ভাবে ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি না করে মুক্তচিন্তার পরিবেশকে সঙ্গ দিন। কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর কার্টুন এঁকে ‘সরকারকে ফেলে দেওয়ার’ পরিবেশ তৈরির মত কিছু করেননি। তাকে মুক্তি দিন। সমালোচনা গ্রহণের মত ইতিবাচক মানসিকতা ধারণ করুন। সমালোচনা ‘ষড়যন্ত্র’ নয়, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)