Site icon চ্যানেল আই অনলাইন

তীব্র ঝড়ে প্লেন নিয়ে বেঁচে অাসা এক পাইলটের গল্প

পরিবারের সবচেয়ে ছোট সন্তান তিনি। ছোট থেকেই ঘুরে বেড়ানোর ভীষণ নেশা ছিল। মা-বাবাকে সবসময় বলতেন, ‘বড় হয়ে ঢাকা-কক্সবাজার রুটে বাস চালাবেন।’ তবে বড় হয়ে ছোটবেলার সেই স্বপ্নটাই ডানা মেলে উড়তে থাকে। ছুঁয়ে যায় আদিগন্ত বিস্তৃত আকাশকে। সেই আকাশই এখন তার নিত্য সঙ্গী। সেখানে মেঘের ভেলায় ঘুরে পাখির মতো উড়ে বেড়ান তিনি।

ছোটবেলায় লালিত সেই স্বপ্ন পূরণ হওয়া ব্যক্তির নাম রুপল নাদিম রসি। পৃথিবীর নানা প্রান্তে এখন তিনি পাখির মত ঘুরে বেড়ান। এই সকালে বাংলাদেশে, আবার বিকাল হতে না হতেই পৌঁছে যান মালেয়েশিয়ায়। পরেরদিন সকালে আবার পা ফেলেন ঢাকার মাটিতে।

২০০৯ সালে পাইলট জীবনের প্রশিক্ষণ শুরু হয় তার। কঠিন এ প্রশিক্ষণে বাধার সবগুলো দেয়াল টপকে স্পর্শ করেন সফল্যকে। দীর্ঘ পরিক্রমা ও ১৫০ ঘণ্টার উড্ডয়নসহ একাডেমিক সব পরীক্ষায় সফল হয়ে ২০১৫ সালে যোগ দেন ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সে।

জীবনের দোলাচলে কখনো কখনো কিছুটা থমকে গেলেও পুনরায় ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। আকাশে তীব্র ঝড়ের কবলে পড়ে বিমান নিয়ে সফলভাবে অবতরণ করে যাত্রীদের প্রাণরক্ষা করে হয়েছেন প্রশংসিত।

রসির এ পেশায় আছে জীবনের ঝুঁকি। আছে প্লেন বিধ্বস্ত হওয়ার শঙ্কা। রয়েছে নানমুখী চ্যালেঞ্জ।

চ্যানেল অাই অনলাইনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে রুপল নাদিম রসি শুনিয়েছেন তার জীবনের গল্প।

এইচএসসি পাসের পর বাবার পরামর্শে রসি শুরু করেন পাইলট হওয়ার প্রশিক্ষণ। বাবা নুরউদ্দিন আহমেদ সরকারি কর্মকর্তা হওয়ায় একসাথে সে সময় এতগুলো টাকার যোগান দেয়াও ছিল বেশ কঠিন। তবে সেক্ষেত্রে রসির মা শিরিন আহমেদের অবদানটাও অনেক বেশি। সংসারের খরচ থেকে প্রতিমাসে কিছু টাকা আলাদা করে রাখতেন তিনি। আর সেই টাকা জমিয়েই কেনা হয়েছিল উত্তরায় একখণ্ড জমি। রসির পড়াশোনার জন্য বিক্রি করে দেয়া হয় সেই জমি।

ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল এন্ড কলেজ থেকে ২০০৭ সালে এসএসসি ও ২০০৯ সালে এইচএসসি পাস করেন। এরপর বাবা-মায়ের পরামর্শে  শুরু করেন পাইলট হবার প্রশিক্ষণ। তবে শুরুতেই বাধার মুখে পড়েন। মেডিকেল টেস্টে সবকিছু ঠিক থাকলেও নাকের হাড্ডি কিছুটা বাঁকা থাকায় আটকে যান। পরে অপারেশন করে পুনরায় মেডিকেল টেস্টে সফল হন।

যোগ দেন তিন মাসের প্রশিক্ষণে। একাডেমিক বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা ও স্বল্পতার কারণে ২ বছরের প্রশিক্ষণ শেষ হতে লেগে যায় ৪ বছর। একপর্যায়ে বেশ হতাশ হয়ে পড়েন।

২০০৯ এ প্রশিক্ষণে যোগ দিলেও প্রথম আকাশে উড্ডয়ন শুরু করেন ২০১২ সালের শুরুর দিকে রাজশাহী এয়াপোর্টে।

প্রথম দিনের সেই আকাশে উড়ার স্মৃতি এখনো জ্বলজ্বল করে রসির স্মৃতিপটে। ‘ভেবেছিলাম অনেক ভয় পাবো। ১ ঘণ্টার মতো সেদিন ফ্লাই করেছিলাম। চালাতে গেলেই প্লেন উপরে উঠে যাচ্ছিল। কখনো আবার নিচে চলে যাচ্ছিল।’

কিন্তু সেদিন ভয়কে জয় করেছিলেন রসি। এরপর থেকে আরও আগ্রহ বেড়ে যায় তার। তবে এর কিছুদিন পর আবার ভাটা পড়ে রসির স্বপ্নে। সরকারের উন্নয়ন কাজের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয় রাজশাহী এয়ারপোর্ট। আর ১৫০ ঘণ্টার মধ্যে তখন  ফ্লাইংয়ের সময় ১০ ঘণ্টাও পূর্ণ হয়না তার। পুনরায় হতাশা গ্রাস করে এ তরুণ পাইলটকে।

এরপর প্রশিক্ষণ একাডেমি থেকে নিয়ে যাওয়া হয় বরিশাল এয়ারপোর্টে। সেখানে ১৬ ঘণ্টার ফ্লাইং শেষে প্রথম একক উড্ডয়নের (একা প্লেন চালানো) সুযোগ পান রসি।

তার আকাশে উড়ার শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত হিসেবে সেই দিনকেই উল্লেখ করেন তিনি। রসির ভাষায়, ‘ভীষণ রোমাঞ্চকর সে অভিজ্ঞতা। প্লেনে সেদিন আমি ছাড়া আমার আর কেউ না থাকায় প্লেনটা যেন অনেক বেশি হালকা লাগছিল। বারবার মনে হচ্ছিল কোনো কিছু ভুল হতে দেয়া যাবে না। অন্যসময় ইন্সট্রাক্টর থাকে। এদিক-ওদিক তাকালে বকা শুনতে হতো। কিন্তু সেই দিন আর কেউ বকা দেয়ার জন্য ছিল না। প্রাণভরে আকাশ দেখেছিলাম সেদিন। নিচ থেকে সবাই প্লেনটা দেখছিলো। এটা ছিলো একটা দারুণ অভিজ্ঞতা।’

সেদিনই জীবনের শ্রেষ্ঠ ল্যান্ডিং করেছিলেন রসি। তবে ল্যান্ডিং করার পরই নিচে দেখতে পান কাদা-পানি ভর্তি একটি বালতি। ল্যান্ডিং করার পরপরই রসির মাথায় ঢেলে দেয়া হয় সেই বালতির কাদা-পানি। অনেক দৌড়াদৌড়ি ছোটাছুটি করেও শেষ রক্ষা হয় না তার। একক উড্ডয়ন শেষে এই প্রক্রিয়ায় মধ্য দিয়েই যেতে হয় সব পাইলটকেই।

এভাবে পর্যায়ক্রমে ২০টা লিখিত পরীক্ষা ও তিনটি একক উড্ডয়ন সফলের পর ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট (প্রাইভেট পাইলটস লাইসেন্স) পান রসি। পরবর্তীতে আরও পরীক্ষা আর ভাইভার পর পান কমার্শিয়াল পাইলট লাইসেন্স। তবে লাইসেন্স পেলেও চাকরি পাওয়াটা প্রায় দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে রসির জন্য।

বংলাদেশের দুটি নামকরা এয়ারলাইন্স সেসময় বন্ধ হয়ে যায়। এর মাঝে রসি বুঝে ফেলেন অভিজ্ঞ ওই পাইলটগুলোর চাকরি না হওয়া পর্যন্ত তার কোথাও সুযোগ হবে না। এর মাঝে ২০১৩ সালে ভর্তি হন কম্পিউটার সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে।

কিন্তু আকাশে ওড়া ছেলেটি যেনো ক্রমশই হাঁপিয়ে ‍উঠে ছিলেন পড়াশুনা, টেবিল, ও রুটিন মাফিক জীবন-যাপনে। আর সেখান থেকে মুক্তি পেতেই ভর্তি হন ইউল্যাবের মিডিয়া এন্ড জার্নালিজম বিভাগে। সেখানে পড়ার সময় কাজ করেছেন বিভিন্ন প্রোডাকশন হাউজেও।

এরই মাঝে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সে ডাক পড়ে পরীক্ষার জন্য। ভীষণ অবাক হন রসি। সেখানে ৭০ জন পরীক্ষা দেয়ার পর মনোনীত করা হয় ১৪ জনকে। আর এরপরই রসির স্বপ্ন যেনো বাস্তবে পরিণত হয়।

পরবর্তীতে গ্রাউন্ড ট্রেনিং, রুট ট্রেনিং, লাইন ফ্লাইং এ যান। এর মাধ্যমেই ম্যানুয়্যাল থেকে অটোমেশন প্লেন চালাতে অভ্যস্ত হন তিনি। সফল হন আইআরসি (ইনিশিয়াল রুট চেক) পরীক্ষায়।

প্রথম ইন্টারন্যাশনাল রুটে প্লেন চালিয়ে যান নেপাল। কিন্তু ৭০০ ঘণ্টার উড্ডয়ন সম্পন্ন করার পর ২০১৭ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু হয় তার দূরযাত্রা। এখন তিনি প্লেন নিয়ে যান মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, কাতার ও ওমানে।

এ পাইলটের এখন সপ্তাহে ৭ দিনের মধ্যে প্রায় ৫ দিনই রাতে মালয়েশিয়া আর সকালে বাংলাদেশে থাকতে হয়। তবে নিজের এ লাইফস্টাইলে নিয়ে খুবই সন্তুষ্ট রসি।

জীবনের কষ্টের স্মৃতি হিসেবে রসি তার শ্রদ্ধেয় ইন্সট্রাক্টর শাহেদ কামালের মৃত্যুর ঘটনাকে তুলে ধরেন। অন্য একটি একাডেমিতে প্রশিক্ষণ দেওয়ার সময় প্লেন বিধ্বস্ত হয়ে মারা যান শাহেদ কামাল। এটা মেনে নেয়া ভীষণ কষ্টকর ছিল রসির জন্য। এরপর আর উড্ডয়ন করতে চাননি এ পইলট। ধীরে ধীরে সেই শোক কাটিয়ে ওঠার সাথে সাথে কেটে যায় ভয়।

তরুণ প্রজন্ম যারা পাইলট হতে চায় তাদের উদ্দেশ্যে রসি বলেন: ‘এ পেশায় আসতে হলে অনেক বেশি ধৈর্যশীল হতে হবে। থাকতে হবে মানসিক শক্তি। লাইফস্টলে আসবে অনেক পরিবর্তন। আর অসুস্থ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই এখানে।’

সামান্য ভুলেই ঘটতে পারে লাইসেন্স বাতিলের মতো ঘটনা। সেজন্য এ পেশায় প্রতি মুহূর্তে অনেক বেশি সচেতনতা জরুরি বলে উল্লেখ করেন রসি বলেন, চ্যালেঞ্জ নিতে আগ্রহী ও সাহসী ছেলে-মেয়েদের এ পেশায় ভাল করার সুযোগ অনেক বেশি।

এ পেশাকে ভালোবাসলে তবেই এখানে আসার পরামর্শ দিয়েছেন এ তরুণ পাইলট। একজন পাইলটের কাছে আবহাওয়া, কুয়াশা, ঝড় এগুলোই বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি।

Exit mobile version