এক
সময়টা ছিল খুব কঠিন।
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এফডিসিতে দাঁড়িয়ে এই হত্যাকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন।
তাঁর এই সাহস দেখে চলচ্চিত্রাঙ্গনের অনেকেই অবাক হয়ে গিয়েছিল সেদিন।
একজন দেশসেরা কৌতুকাভিনেতা এভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়ে এফডিসির সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ!
ভাবা যায় না।
কিন্তু তিনি একাত্তুরের চেতনায়, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ আর বঙ্গবন্ধু- প্রেমে অন্ধ হয়ে এই দুঃসাহসের কাজটা করেছিলেন।
আর এই প্রতিবাদ করাই হলো তাঁর কাল।
সামরিক শাসক জিয়ার লেজুড়বৃত্তি করা জাতীয়তাবাদী ধারার পরিচালক, কাহিনীকার খান আতা, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, আমজাদ হোসেনসহ সবাই মিলে তাঁকে একযোগে বয়কট করল।
তাঁর হাতে তখন কোনো কাজ নেই। বলতে গেলে প্রায় বেকার- সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ল তাঁর পক্ষে কিন্তু তিনি তাদের কাছে মাথা বিক্রি করেননি- মাথা নোয়ান নি।
তখন তাঁকে দেখা গেছে নানান বিচিত্র পেশায়।
কখনো এফডিসির সামনে হকারি করতেন।
চা-পান বিক্রি করতেন।
পত্রিকা বিক্রি করতেন, চিত্রালি- পূর্বানী- বিচিত্রা।
কেউ তাঁর দিকে ফিরেও তাকান নি।
অথচ তিনি তখন দেশের অন্যতম সেরা কৌতুকাভিনেতা যাঁর অভিনয়ের শুরুটা হয়েছিল ১৯৫৯ সালে আকাশ আর মাটি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। শতাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন।
দুই
আমাদের ছোটবেলায় আমরা তিনজনের অভিনয় দেখার জন্য মুখিয়ে থাকতাম।
খান জয়নুল- আলতাফ আর রবিউল।
এই তিনজনের অভিনয় দেখলে, না শুধু অভিনয় না- এঁদের দেখলেই আমরা হেসে গড়িয়ে পড়তাম।
তাঁর শারিরীক গঠন, তাঁর অঙ্গভক্তি আর সংলাপ বলার পারদর্শিতা আমাদেরকে বিনোদিত করত। তবে তাঁর অভিনয়ের আরেকটি অন্যতম বৈশিষ্ট ছিল তাহল- হাতির কানের মতো কান দুটোকে সংলাপ বলার তালে তালে নাচাতে পারতেন।
‘১৩ নং ফেকু ওস্তাগার লেন’ সিনেমা দেখে আমরা ছোটরা এই ঠিকানা খুঁজে বের করার জন্যে নারিন্দা থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম।
এই সিনেমা কতবার দেখেছি- মনে পড়ে না আমার।
তিন
সেই দুর্বিষহ দিনে এই যুদ্ধটা তিনি একা একা করেছেন- অনেকদিন।
সেনা শাসক জিয়াউর রহমান মারা গেলেন।
স্বৈরশাসক এরশাদ ক্ষমতায় এলেন।
কিন্তু তিনি কোনো সরকারের কাছেই সুযোগ নিতে চান নি।
নিজের অভাবের কথা বলেন নি।
বেলাজের মতো অনুদানের কথা বলেন নি।
নির্লজ্জের মতো হাতও পাতেন নি।
নিজের জন্য কিছুই চান নি।
অথচ যারা তাঁকে সেদিন সিনেমা থেকে বয়কট করে তাঁর জীবনকে বিষিয়ে তুলেছিলেন তারা জীবৎকালে তাদের আদর্শের বাইরে গিয়ে বিভিন্ন সরকারের কাছে দফায় দফায় হাতে-পায়ে ধরে ফকিন্নির মতো টাকা নিয়েছেন, অনুদান নিয়েছেন, সাহায্য নিয়েছেন।
তারপর একদিন, এভাবে জীবন সংগ্রামে ধুকতে ধুকতে সবার অজান্তে, নীরবে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন।
আমরা কেউ তাঁর খোঁজ রাখিনি।
তিনি একজন অতি সামান্য মানুষ।
নাম তাঁর রবিউল আলম।
জন্ম মুর্শিদাবাদে ১৯৩৯
মৃত্যু ১৮ এপ্রিল, ১৯৮৭
রবিউল অভিনীত বিখ্যাত সব সিনেমা-
১৩ নং ফেকু ওস্তাগার লেন।
তোমার আমার।
জোয়ার এলো।
নাচঘর( উর্দু )।
অনেক দিনের চেনা।
রাজা সন্ন্যাসী।
অরুণ বরুণ কিরণমালা।
সাত ভাই চম্পা।
নীল আকাশের নীচে।
সমাপ্তি।
দর্পচূর্ণ।
অধিকার।
কাঁচ কাটা হীরে।
দীপ নেভে নাই।
অশ্রু দিয়ে লেখা।
বাঘা বাঙালী।
আলোর মিছিল, মাসুদ রানা, পরিচয়, এপার ওপার, দোস্ত দুশমন, প্রতিনিধি, সমাধি, গুন্ডা, হাবা হাসমত, বন্ধু, অশিক্ষিত, জিঞ্জির, অভিমান, সাম্পানওয়ালা, ছুটির ঘণ্টা, যাদুনগর,আনারকলি, গাঁয়ের ছেলে, ভাঙা গড়া,রেশমী চুড়ি, লাল কাজল, বড় বাড়ীর মেয়ে, রজনীগন্ধা, ঝুমুর, মৎস্য কুমারী, চোর, অভাগী…
এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)