১২ সেপ্টেম্বরের ঘটনা। অন্য দশজন সাধারণ বাসযাত্রীর মতো এক সময়ের জনপ্রিয় অভিনেত্রী বর্তমান তথ্য প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম গণপরিবহনে চড়ে গুলশানের বাসায় যান। ঐদিন সচিবালয়ে কাজ সেরে তিনি বেলা সাড়ে বারোটার দিকে একটি বাসে উঠে সাধারণ যাত্রীদের সাথে বসেন। কুশল বিনিময় করেন। বাসে উঠে তিনি সাধারণ যাত্রীদের মতো ভাড়াও পরিশোধ করেন। দু ঘণ্টা পর বাসটি গুলশানে পৌঁছায়। বাসে চড়া অবস্থায় যেসব অসঙ্গতিগুলো তাৎক্ষণিক ভাবে প্রতিমন্ত্রীর চোখে পড়ে তা তিনি চালক এবং সহকারিদের বলেন।
তথ্য প্রতিমন্ত্রীর গণপরিবহনে উঠার সংবাদ ঐদিনই বিভিন্ন পত্রিকার অনলাইন ভার্সনে চলে আসেG টেলিভিশনেও এই সংবাদ প্রচারিত হয়। ফেসবুকেও বিষয়টি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ফেসবুকে সংবাদটি ভাইরাল হওয়ার পর পক্ষে-বিপক্ষে নানা ধরনের মন্তব্য লক্ষ্য করা যায়। অনেকেই নেতিবাচক, কটাক্ষ মন্তব্যও করেন। পরবর্তীতে তথ্য প্রতিমন্ত্রী নিজে ফেসবুকে তার ভেরিফাইড পেজে গণপরিবহনে যাওয়া নিয়ে ব্যাখ্যা দেন। সেখানে তিনি স্পষ্টতই বলেন, লোক দেখানোর জন্য বা অন্য কোনো অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য নয়, নিজের তাগিদেই তিনি গণপরিবহনে চড়েছেন। এসি গাড়ি রেখে গণপরিবহনে চড়ে তিনি কার্যত গণপরিবহনের সমস্যা ও দুরবস্থাগুলো বুঝতে চেয়েছেন। আগামীতেও তিনি গণপরিবহনে যাওয়া-আসা করবেন বলে দৃঢ়তার সাথে বলেন।
একসময়ের স্নিগ্ধ ও সু-অভিনেত্রী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রী তথ্য প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম গণপরিহনে চড়ে কার্যত একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ তৈরি করেছেন। কেননা বাংলাদেশের মন্ত্রী-মিনিস্টার এমন কী হালে কোনো এমপিদের গণপরিবহনে কখনই চড়তে দেখা যায় না বলেই প্রতীয়মান। বরং বেশিরভাগ মন্ত্রী-মিনিস্টার যখন যে রাস্তা দিয়ে চলেন, সেখানে চলাচলের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হয়। রাস্তাঘাটে চলাচলকারী সাধারণ মানুষ এ নিয়ে বেশিরভাগ সময় বিরক্তিই প্রকাশ করেন।
আমরা যারা নিত্য গণপরিবহনে চলাচল করি তাদের চোখেও কখনই পড়েনি যে, কোনো মন্ত্রী-মিনিষ্টার গণপরিবহনে সংগোপনে বা জানিয়ে চলাচল করছেন। তবে শুধু মন্ত্রী-মিনিস্টারই নন, মন্ত্রী মিনিস্টারদের বাইরে অন্য রাজনৈতিক নেতাদেরও চলাচল করতে দেখা যায় না। এমনকি যারা বাম রাজনীতি এবং ইসলামী হিকমত কায়েমের সাথে যুক্ত তাদেরকেও দেখা যায় না। বেশিরভাগ বড়, ছোট, উঠতি নেতারাই চার চাকাতেই চলাচল করে থাকেন। আওয়ামী লীগ, বিএনপির বাইরে এমন কী মধ্যম সারির বাম নেতারাও এখন গাড়িতেই চলাচল করেন। মন্ত্রী, এমপি বলে শুধু নয়, এখনতো ছোট বড় সব নেতারই এক বা একাধিক গাড়ি আছে। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের মাঠ কাঁপানো নেতাদেরও এখন সবার গাড়ি আছে। কেউ ভুলেও গণপরিবহনের কাছে যান বলে মনে হয় না।
ঢাকা শহরে গণপরিবহনে আমার নিজের চড়ার অভিজ্ঞতা তিন দশকের কাছাকাছি। নিজের প্রয়োজনে ঢাকার প্রায় সব রুটেই গণপরিবহনে চলাচল করেছি। কিন্তু কখনই বাসে মন্ত্রী-মিনিস্টার বা উচ্চ পর্যায়ের কোনো নেতার সাথে দেখা হয়নি। তবে ২০০২ সালে গণপরিবহনে প্রথম দেখা পাই প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা আবুল বাশারের। কোনো একদিন শাহবাগ থেকে লাল দোতলা বাসে চেপে গুলিস্তান থেকে বাসায় ফিরছিলাম। বাসে ঢুকতেই সাইড সিটে বসেছিলাম। বাস শাহাবাগ পেরিয়ে যাবার পর দেখি সামনে উপরের রড ধরে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন তার মুখবয়বটা চেনা। ভালো করে দেখে বুঝতে পারলাম প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা এবং বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির পলিট ব্যুরোর সদস্য আবুল বাশার। দ্রুত সিট থেকে উঠে উনাকে সালাম দিয়ে বসতে বললাম। উনি বসবেন না বলে জানালেন। আমি তখন বললাম, ‘আমি আপনাকে চিনি। প্লিজ আপনি বসুন।’ কোথায় যাবেন জিজ্ঞেস করলে জানালেন মিরপুরে যাবেন।
এর সাত-আট বছর পর একদিন দুপুরের পর মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে এটিসিএল পরিবহনে চড়ে পল্টনে যাওয়ার জন্য বাসে উঠতেই শুনতে পাই পেছনের সিট থেকে কেউ একজন আমাকে ডাকছে। দেখি জাসদ নেতা নাজমুল হক প্রধান। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের প্রখ্যাত ছাত্র নেতা হিসেবে যিনি দেশব্যাপী পরিচিত। তিনি তার পাশে বসতে অনুরোধ করলেন। নাজমুল হক প্রধান ডেমরা যাচ্ছেন জাসদের একটি সভায় যোগ দিতে। নাজমুল হক প্রধান বর্তমানে নির্বাচিত সংসদ সদস্য এবং জাসদের একটি অংশের সাধারণ সম্পাদক।
মাঝে একদিন শাহবাগ থেকে মিনিবাসে যাওয়ার পথে দেখি মাথার উপরের রড ধরে দাঁড়িয়ে আছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিপি, একসময়ের তুখোড় জনপ্রিয় ছাত্রনেতা বর্তমানে কমিউনিষ্ট পার্টির নেতা রাগিব আহসান মুন্না। আমরা দুজনের পাশাপাশি রড ধরে মোহাম্মদপুরের দিকে আসি। বাসে দাঁড়ানো অবস্থায় দুজনে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা করি। সেদিন বাসের যাত্রীরা কেউ ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি যে ছাত্রনেতা রাগিব আহসান মুন্না বাসে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন। উল্লিখিত তিনজন ছাড়া আর কোনোদিন কোনো নেতার সাথে গণপরিবহনে দেখা হয়নি।
গণপরিবহনে মন্ত্রী-মিনিস্টারতো দূরে থাক কোনো সংসদ সদস্য চলাচল করে বলে মনে হয় না। তবে এমপি হওয়ার আগে বেশিরভাগ এমপিরই যে গণপরিবহনে চলার অনেক অভিজ্ঞতা রয়েছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। শেখ হাসিনার গত পার্লামেন্টে থাকা অনেক এমপিকে ঢাকাতে দেখিছি নিয়মিত তারা গণপরিবহনে চড়তেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন খুলনার ননী গোপাল মন্ডল। নবম সংসদে নির্বাচিত হওয়ার পর অনেকদিন ধরেই তিনি ঢাকাতে মিনিবাসে চলাচল করতেন। ইতিহাস বলে আগে আমাদের বেশিরভাগ এমপিরই কোনো গাড়ি ছিল না, গণপরিবহনেই বাড়ি থেকে ঢাকায় আসা-যাওয়া করতেন। আবার ঢাকায় এসে গণপরিবহনেই চলাচল করতেন।
মাগুরা থেকে মোট চারবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য প্রয়াত মো. আছাদুজ্জামানের কোনোদিনই ব্যক্তিগত গাড়ি ছিল না। জিয়ার আমলে ৭৯ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনেও তিনি আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাাচিত হয়েছিলেন। জিয়াউর রহমান তাকে মন্ত্রীত্ব আর গাড়ি-বাড়ির অফার দিয়েছিলেন কয়েকবার। এসবের কাছে মাথানত করেন নি। আছাদুজ্জামান সংসদ অধিবেশনের আগে ঈগল বা সোহাগ পরিবহনে চড়ে ঢাকায় এসে পার্লামেন্ট হোস্টেলে উঠতেন। রিকসা, বাসে চড়ে ঢাকায় ঘুরতেন। ২০১০ সালের ১০ নভেম্বর গণপরিবহনে চড়ে পাবনার বাড়িতে ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছিলেন তৎকালীন পার্লামেন্টের অন্যতম সদস্য জনপ্রিয় নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুল। এরকম আরও অনেকের কথাই হয়ত জানা যাবে।
তথ্যপ্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম গণপরিবহনে চড়ে দোষের কিছুই করেননি। বরং দুঘণ্টার জন্যে গণপরিবহনে চড়ে তিনি গণপরিবহন যাত্রীদের হ্নদয়ের কাছে পৌঁছে গেছেন। বাস্তবেই তিনি বুঝতে পেরেছেন গণপরিবহনে কী ধরনের সমস্যা বিরাজমান, চ্যালেঞ্জগুলো কোথায়। তারানা হালিম মানুষের হৃদয়ের কাছে নতুন নয়, বরাবরই যান। অনেকেই হয়ত জানেন না, এক যুগেরও বেশি সময় ধরে তিনি চ্যানেল আইতে ‘জীবন যেখানে যেমন’ নামে একটি অনুষ্ঠান করেন। শ্রমজীবী, কর্মজীবীসহ নিম্ন আয়ের মায়েদের জীবন সংগ্রাম-কষ্ট, যাপিত জীবনের ভেতরের গল্প, অব্যক্ত বেদনা তিনি তুলে ধরেন সুন্দর করে।
তথ্য প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম সত্যিই এক সুন্দরের সূচনা করেছেন। আমরা আশা করছি তিনি আগামীতে জনগণকেন্দ্রীক তার এই কর্মকাণ্ড আরো অব্যাহত রাখবেন। নিন্দুকদের তিনি সমুচিত জবাব দেবেন এই বলে যে, লোক দেখানো নয়, সত্য জেনে সত্যটিই তিনি করেছেন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)