জি.আই.জেন হচ্ছে ডেমি মুর অভিনীত রাইডলি স্কট পরিচালিত আমেরিকান অ্যাকশনধর্মী ফিচার ফিল্ম। যেখানে যুদ্ধক্ষেত্রে নারীকেন্দ্রিক বিতর্কগুলো তুলে ধরা হয়েছে। নারী দুর্বল, নারী নরম, নারীর বুদ্ধি নেই, নারী যুদ্ধের সময় শুধু সংকটই তৈরি করে, সে পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করতে পারে না, অস্ত্র ধরতে জানেনা, যুদ্ধের প্রধান ক্ষতিগ্রস্ত সে এই রকম হাজারো যেসব ছাঁচিবদ্ধ ধারণা আমাদের এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বিদ্যমান তা ভেঙে চুরমার করে দেয় চলচ্চিত্রটি।
যুদ্ধ নিয়ে যত চলচ্চিত্র চোখে পড়ে সেগুলোতে নারীর ভূমিকা খুবই নগণ্য। সর্বোচ্চ হলে তাকে নার্স হিসেবে দেখা যায়। কাবেরী গায়েন তার ‘মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রে নারী নির্মাণ’ (২০১৩: ৩২) বইয়ে উল্লেখ করেন “যুদ্ধ-চলচ্চিত্র এমন একটি জঁরার প্রতিনিধিত্ব করে, যেখানে নারী খুব কমই প্রধান ভূমিকায় থাকে। তিনি আরো বলেন, পাশ্চাত্যের যুদ্ধ-চলচ্চিত্রে মূলত যেসব চরিত্রে নারীদের দেখা যায় সেসব হলো-নার্স, মা, স্ত্রী, প্রেমিকা/বান্ধবী, প্রতিরোধযোদ্ধা, সৈনিক, কদাচিৎ অফিসার এবং অবশ্যই অসহায় শিকার (গায়েন, ২০১৩: ৩২)। তবে জি.আই. জেন চলচ্চিত্রে এর ব্যতিক্রম ঘটেছে। শুধু তাই নয় একজন নারী যখন তার তীব্র প্রত্যয়, ইচ্ছা আর সাহস নিয়ে চিরাচরিত নিয়ম আর প্রথাকে ভেঙ্গে ফেলে দেয় তখন তাকে কেন্দ্র করে স্বার্থে আঘাত লাগা বিদ্যমান পরিপার্শ্বকেও জটিলভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন পরিচালক।
কাহিনীর শুরুতে দেখা যায় টেক্সাসের সিনেটর লিলিয়ান ডিহেভেন ইউএস নেভিকে জেন্ডার নিউট্রাল নয় বলে সমালোচনা করছেন। এর পেছনে যে কারণটি রয়েছে তা হল পুরুষের সঙ্গে মিলিয়ে নারীরা যদি কাজে সমদক্ষতা প্রমাণ করতে পারে তবে ইউএস মিলিটারি নেভির বিভিন্ন ক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরও নিয়োগ দেয়া হবে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে পরীক্ষামূলকভাবে ডিহেভেন নেভির একজন অফিসার (টপোগ্রাফিকাল অ্যানালিস্ট) জর্ডান ও’নীলকে বেছে নেন U.S SEAL এর অনুরূপ ট্রেনিং প্রোগ্রাম (কাল্পনিক) U.S. Navy Combined Reconnaissance Team (C.R.T.) এর একজন ট্রেইনি হিসেবে। মূলত ডিহেভেনের এজেন্ডা টেক্সাস থেকে নেভি বেজ অপসারণ না করা এবং তিনি জর্ডানকে তার এই পলিটিকাল এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য বেছে নেন, নারীর ক্ষমতায়নের জন্য নয়। এজন্যই জর্ডানকে যখন বেছে নেন তখন তাকে অন্যান্যদের তুলনায় বেশি ফেমিনিন মনে হওয়ায় বেছে নেন। কারণ তিনি চাননি জর্ডান ওই ট্রেনিং সফলভাবে সম্পন্ন করুক। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায় ডিহেভেন ভুল একজনকে বেছে নিয়েছেন। কারণ জর্ডান সবসময়ই নিজেকে প্রমাণ করতে চান, তার দক্ষতা অন্যান্য অফিসারদের তুলনায় বেশি এমনকি তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার চেয়েও। অথচ তাকে সেখানে সাবোর্ডিনেট করে রাখা হয়েছে। তার প্রেমিক তার একই যোগ্যতার, তারা একই স্কুলে পড়েছে এবং একই ট্রেনিং নিয়েছে অথচ সে পুরুষ হওয়ায় তার র্যাংক জর্ডানের তুলনায় বেশি। সে এই বৈষম্য মেনে নিতে পারে না। উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় সে যুদ্ধক্ষেত্রে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে আবেদন করেছিলো। কিন্তু তার কাজ যেহেতু সাবমেরিনে হবে তাই সাবমেরিনে নারীদের জন্য আলাদা বাথরুম সুবিধা না থাকায় তার আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়।
যুগ যুগ ধরে ধরে নেয়া হয়েছে পুরুষই যুদ্ধ করবে, সেই নেতৃত্ব দেবে, সামরিক বাহিনীতেও তাই তারাই থাকবে। ফলে প্রত্যেকটি দেশে সামরিকবাহিনীতে যদি নারী পুরুষের অনুপাত বের করা হয় কোনো দেশেই এই অনুপাত ৫০:৫০ হবেনা। যেমন যদি বাংলাদেশের হিসাব দেয়া হয় সেখানে সেনাবাহিনীতে পুরুষ ও নারীর শতকরা অনুপাত ৯১:৯, নৌবাহিনীতে ৯৭:২ এবং বিমান বাহিনীতে ৯৮:২ (আমাদের সময়ে ১১/১১/২০১৫ তারিখ প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী)১। যুক্তরাষ্ট্রেও এই হিসাব ৮০:২০ (পুরুষ:নারী) এর উপরে নয়। সেখানে সামরিক বাহিনীতে মোট নারীর পরিমাণ ১৪.৬ শতাংশ২। বিভিন্ন রাষ্ট্রে সামরিকবাহিনীতে নারীদের উপস্থিতির এই স্বল্প হার এটাই প্রমাণ করে যে বিদ্যমান ব্যবস্থাটা নারীদের এই পেশায় আসার জন্য অতোটা অনুকূলে না। জর্ডানের যুদ্ধে যোগদানের ইচ্ছাকে বাথরুম না থাকার দোহাই দিয়ে প্রত্যাখ্যান করাটা এই ব্যবস্থাকেই প্রতিফলিত করে।
যাই হোক জর্ডানকে এই প্রোগ্রামে বেছে নেয়ায় তার মধ্যে দারুণ উৎসাহ দেখা যায়। কারণ সে দীর্ঘ দিন ধরে প্রতীক্ষায় ছিলো নিজেকে প্রমাণ করার জন্য। সেই সুযোগ পেয়ে সে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। এই সুযোগের বিষয়টি সে তার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে শেয়ার করে। কিন্তু তার কোনো প্রতিক্রিয়া না থাকায় সে মনঃক্ষুণ্ণ হয় এবং জিজ্ঞেস করে তার কিছু বলার আছে কিনা। তখন তার বয়ফ্রেন্ড আপত্তি জানায় যে তিন মাসের জন্য জর্ডান নেভাল বেজে চলে যাবে যেখানে কিনা ওয়ার্ল্ড ক্লাস যোদ্ধারা থাকে। তার ধারণা তারা জর্ডানের মাথার খুলির উপর কর্নফ্লেক্স খাবে অর্থাৎ তারা জর্ডানকে খুব সহজভাবে মেনে নেবে না। তাই শুধু শুধু সেখানে সোলজার-গার্ল সাঁজতে যাবার কি দরকার তার। বরং যেখানে আছে সেখানেই তো ভালো আছে। তখন জর্ডান তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে ‘Operational experience is key to advancement’. তখন তার বয়ফ্রেন্ড রেগে যায় এবং বলে- If you made up your mind do it, go. You always do what you wanna do anyway. Don’t ask my permission. You wanna go off and live with a bunch of cock swinging commandos for three months… তখন জর্ডান প্রশ্ন করে যদি সে এই তিন মাস ট্রেনিং শেষ করে তিন বছরের জন্য অপারেশন ফিল্ডে যায় তখন কী হবে? তখন তার বয়ফ্রেন্ড উল্টো প্রশ্ন করে- Will i wait if you go off to war? Is that what you are asking me? জর্ডান দৃঢ়তার সঙ্গে উত্তর দেয়- Yeah, something like that. Exactly like that. এরপর তার বয়ফ্রেন্ড রাগ করে সেখানে থেকে চলে যায়।
তাদের কথোপকথনের এই সিকুয়েন্সটি দেখানোর মাধ্যমে নারীর অগ্রগতির পথে বাধা হিসেবে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা কীভাবে ভূমিকা পালন করে তা স্পষ্ট হয়েছে। রান্নাঘরের চার দেয়াল থেকে যখনই কোনো নারী বের হয়ে আসতে চায় তখনই প্রেমিক, স্বামী কিংবা পরিবার বাধা হয়ে দাড়ায়। এখানে নারী হয়ে জর্ডান যুদ্ধের ট্রেনিং নেবার কথা বলে যেন দেবতুল্য পুরুষের জাত্যভিমানে আঁশটে পানি ছুড়ে মেরেছে। মহাভারত অশুদ্ধ করে ফেলেছে। কোথায় সমাজের চিরাচরিত নিয়ম হচ্ছে পুরুষটি যুদ্ধে যাবে আর নারীটি তার পথ চেয়ে বসে থাকবে বছরের পর বছর, কান্না করবে তার বিরহে, প্রার্থনা করবে তার মঙ্গলে আর জর্ডান কিনা তার পুরুষ সঙ্গীটিকে বলছে তার জন্য অপেক্ষা করতে। একারণে তার বয়ফ্রেন্ড তার এই সুযোগকে সহজভাবে মেনে নেয় না।সেটা তার বয়ফ্রেন্ড ভালোভাবেই বুঝিয়ে দেয় ওই কথোপকথনে।
যাই হোক জর্ডান তার প্রত্যয়ে অটুট থাকে এবং প্রফেশনাল কমব্যাট ট্রেনিংয়ের জন্য নেভাল বেজে যায়। সেই একমাত্র নারী এবং প্রথম নারী যাকে এই ট্রেনিংয়ের জন্য বাছাই করা হয়েছে। এই ট্রেইনিং প্রোগ্রামটি এতোটাই কঠিন, নিষ্ঠুর আর হিউমিলিয়েশনের মাধ্যমে করা হয় যে ৬০ ভাগ পুরুষ সৈন্যই সহ্য করতে না পেরে চার সপ্তাহের মধ্যে ড্রপ-আউট করে যা মাস্টার চীফ জেমস আরগেইলের মুখে শোনা যায়। কিন্তু এই ভয়াবহ ট্রেনিং জর্ডানকে দমাতে পারে না। সে অন্যসব পুরুষ ট্রেনিদের মতই পরিশ্রম করতে পারে, শক্তিতে বলিয়ান হয়ে ভারী নৌযান বয়ে নিয়ে যেতে পারে। নারীকে যে সব প্রথাবদ্ধ ধারণার মধ্যে আবদ্ধ করে রাখা হয় তার সবগুলোই জর্ডান ভেঙ্গে দেয়। ফলে পেশী আর মেধা শক্তির এই প্রশিক্ষণ জর্ডানকে দমাতে পারে না। কিন্তু বাধা আসে অন্য দিক থেকে সেটা হলো দীর্ঘ দিনের পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব। তার সহপ্রশীক্ষণার্থীরা তাকে হীনভাবে দেখে। মনে করে একজন নারীর পক্ষে এখানে টিকে থাকা সম্ভব নয়। জাত্যভিমানে ভুগতে থাকে নারীবাদী লেখিকা তসলিমা নাসরিন যেটাকে বলেছেন মেগালোমানিয়া।
দিনের প্রশিক্ষণ শেষে বিশ্রামের সময় হলে জর্ডান তার বেডে যায়। সেখানে তার পাশের বেডে থাকা এক প্রশিক্ষণার্থী ঘোর আপত্তি জানায়। কারণ কোনো এক নারীর পাশের বেডে থাকাটা তার জন্য আপত্তিজনক। কিন্তু জর্ডান তা মোটেও তোয়াক্কা করে না। সে স্পষ্টভাবে ওই প্রশিক্ষণার্থীকে জানিয়ে দেয় এভাবে “Listen you moron, I am here to stay. If you don’t wanna be in my life, move out or ring out (Drop out). That’s it. End of file.”। জর্ডানকে কোনো ধরণের পুরুষতান্ত্রিকবাধাই দমাতে পারে না। বরং সে তাদের সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমেই তার প্রশিক্ষণ চালিয়ে নিতে চায়। ফলে পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মেয়েদেরকে দুর্বল ভেবে যে অতিরিক্ত সুবিধা দিতে চায় তা সে নিতে ঘোর আপত্তি জানায় এবং এতে অপমানিত বোধ করে। তার বিশ্বাস যা পুরুষ করতে পারে একজন নারীও অবশ্যই তা করতে পারবে। ফলে আমরা দেখি যখন তার সঙ্গে জেনারেলের প্রথম দেখায় জেনারেল তার প্রশিক্ষণ সার্বিকভাবে ‘as painless as possible’ করতে চায় তখন জর্ডান এতে প্রতিবাদ জানায়। সে বলে ‘I deserve a certain amount of pain’। অর্থাৎ সে নারী-পুরুষের আলাদা মানদণ্ড মেনে নিতে চায় না।
তার প্রশিক্ষক যারা তারা তাকে মেয়ে হবার কারণে ভিন্নভাবে ট্রিট করে। তার জন্য থাকে ভিন্ন ব্যবস্থা। জর্ডানের ভাষায় “double standard” “the separate quarters” “the differential treatment” যা সে মেনে নিতে পারেনা। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, সারাদিনরাতের কঠোর শারীরিক পরিশ্রম, নিদ্রাহীনতা এবং একটি লিখিত পরীক্ষার পর পরিশ্রান্ত প্রশিক্ষণার্থীদেরকে যখন একটি Obstacle Course (প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে live-fire এর বাধা অতিক্রম করে একটি দেয়াল টপকে এপারে আসা) এ অংশ নিতে হয় তখন সে সবাইকে সাহায্য করে যেমনটা করা উচিত একটি দলের। কিন্তু সেখানে সে যাকে সাহায্য করে দেয়াল পার হতে সেই সহকর্মীই প্রতারণা করে তাকে সাহায্য না করে সবার পেছনে ফেলে যায়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেয় সে ফেল করেছে ওই কাজে। অথচ ফলাফলে তাকে ফেল করা সত্ত্বেও পাশ দেখানো হয়। কিন্তু যে তাকে প্রতারণা করে তার আগেই দেয়া পার হয়েছে তাকে ফেল দেখানো হয়। এই বিষয়ে মাস্টার চীফের কাছে জানতে চাইলে আরেকজন প্রশিক্ষক তাকে জানায় সে নারী হবার কারণে ৩০ সেকেন্ড সময় তার জন্য বেশি দেয়া ছিলো। ফলে নিয়ম অনুযায়ী তার সহকর্মী তার আগে কাজটি সম্পন্ন করা সত্ত্বেও ফেল করেছে এবং জর্ডান পাশ করেছে। এই ঘটনার পরে এ ধরণের দ্বিমুখী নীতির বিরুদ্ধে সে জেনারেলের কাছে অভিযোগ করতে যায় যে জেনারেল তাকে সবসময় সফটভাবে (নারী এবং দুর্বল ভেবে) ট্রিট করে। সে জেনারেলের কাছে স্বয়ং জেনারেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে। তাদের কথোপকথনটি নিম্নে তুলে ধরা হল:
জর্ডান: I believe you instructed me to come directly to you, sir if I felt I was being mistreated in anyway sir.
জেনারেল: Oh. All right Lieutenant. I want names. I want specific grievances.
জর্ডান: Permission to speak frankly, sir? Its you, sir. It started at the moment I got here.
জেনারেল: Oh? Really?
জর্ডান: It’s the double standard, the separate quarters, the deferential treatment. It’s the way you practically pulled my chair out for me when we first met.
জেনারেল: Because I was civil? Now you’re complaining?
জর্ডান: I can’t afford civility, sir. How am I supposed to fit in with these guys when you’ve got me set up as an outsider? You’ve given me a different set of rules. The answer is, I can’t. I mean really, why don’t you issue me a pink petticoat to wear around the base?
এই কথোপকথনে বোঝা যায় যে সমাজ নারীদেরকে আগে থেকেই দুর্বল ভেবে তাদেরকে অতিরিক্ত সুবিধা দিয়েই নারী পুরুষের মধ্যে বিভাজন করে থাকে। সমাজ নারীকে সুযোগ দেবার আগেই ধরে নেয় নারীর দ্বারা এই কাজ সম্ভব নয়। এই বিভাজনের বিরুদ্ধে তাই জর্ডান প্রতিবাদ করে। তাদের এই কথোপকথনের পরে জেনারেল তার বৈষম্যমূলক নীতি বাদ দেয়। এরপর সিনেমা এগিয়ে যায় জর্ডানের দুর্বিষহ প্রশিক্ষণ আর একাগ্র সাধনার মধ্য দিয়ে। দিনরাত মিলে টানা ২০ ঘণ্টারও বেশি ট্রেনিং নেয়া, ভারী নৌযান সমুদ্রে বয়ে নিয়ে যাওয়া এবং বয়ে নিয়ে আসা, পানিতে শারীরিক কসরত করা, খাবারের জন্য লড়াই করা, ভারী ওজনের বড় বড় ড্রাম অসমতল বালিময় জায়গার মধ্য দিয়ে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া, দুর্গম জঙ্গলে মিশন কমপ্লিট করা, সমুদ্রে নেমে প্রশিক্ষণ নেয়া এবং যথাসময়ে বোটে উঠতে না পারায় সমুদ্রে তাকে ফেলে যাওয়া, নাক-মুখ দিয়ে পানি ঢেলে অত্যাচারিত হওয়া (শত্রুপক্ষের দ্বারা ইন্টারোগেশনের সময় যাতে তথ্যের জন্য ভয়ংকরভাবে অত্যাচারিত হয়েও তথ্য না দিতে এবং মাঝ সমুদ্রে ফেলে দিলেও যাতে প্যানিক না করে), মেশিনগান ঠিক করা এবং সেখানে ফার্স্ট হওয়া সবই চলতে থাকে। দেখা যায় প্রশিক্ষণের মাঝপর্যায়ে সে ৪০% পুরুষকে পেছনে ফেলে দিতে সক্ষম হয়েছে। জর্ডান টিকে আছে এবং সেটা খুব ভালোমতোই। নারীকে পুরুষের মত সুযোগ সুবিধা দিলে যে সেও বনসাই এর পরিবর্তে বিশাল আকারের বটগাছ হতে পারে তা জর্ডান প্রমাণ করে।
যাইহোক জর্ডানের প্রশিক্ষণ এগিয়ে যায় এবং তাদের পরবর্তী মিশন হয়- Survival, evasion, resistance and escape । অর্থাৎ এই মিশনে তাদেরকে একটি কৃত্রিম অপারেশন দেয়া হয় যেখানে তাদেরকে শত্রুপক্ষ ধরে ফেলবে এবং এখান থেকে পালিয়ে বেঁচে ফিরতে হবে। এই সেনারা যদি কখনও শত্রুপক্ষের কাছে ধরা পড়ে তখন তাদের ভেতর থেকে যেন কোনো তথ্য বার করে নিতে না পারে সেটা নির্মম অত্যাচার সহ্য করে হলেও তার প্রশিক্ষণ হচ্ছে এটা। এজন্য কয়েকটি গ্রুপে তাদেরকে ভাগ করে দেয়া হয়। জর্ডানের গ্রুপে জর্ডানকে গ্রুপ লিডার করা হলে গ্রুপের অন্যান্যরা আপত্তি জানায়। এখানেও চলে আসে সেই চিরাচরিত পুরুষতান্ত্রিক চেতনা। একজন নারীর নেতৃত্বকে পুরুষরা খুব সহজে মেনে নিতে পারে না। পরে মাস্টার চিফের ভয়ে তারা মেনে নেয়। অপারেশনে গেলে তাদেরকে প্রশিক্ষক যারা তারা আটক করে ফেলে। তাদের কয়েকজনকে খাঁচায় ভরে রাখে এবং বাকিদেরকে আলাদা করে রেখে দেয়। সেখান থেকে একজন একজন করে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় ভয়ংকরভাবে অত্যাচারের মাধ্যমে। কিন্তু জর্ডানের পালা আসলে আর পুরুষ ট্রেইনিদের যেভাবে অত্যাচার করা হয় তাকে সেভাবে করা হয় না। তাকে অন্যান্য পুরুষদের তুলনায় আরো ভয়ংকরভাবে অত্যাচার করা হয়। অত্যাচারের এক পর্যায়ে তার জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হয়েছে বলে এক প্রশিক্ষক জানালেও মাস্টার চিফ তাতে কর্ণপাত করে না। সবার সামনে তাকে নির্মম অত্যাচার করা হয়। তার উপর মাস্টার চীফের অত্যাচার দেখে অন্যান্য কমান্ডো এবং প্রশিক্ষণার্থীরাও আঁতকে ওঠে। জর্ডানের উপর এই ধরণের অত্যাচার সে নারী বলেই করা হয়। মনে করা হয় সে হয়তো কিছু বলবে না। কিন্তু জর্ডানের উপর অত্যাচার যখন সেক্সুয়ালি এবিউজের পর্যায়ে চলে যায় তখন জর্ডান বুঝতে পারে মাস্টার চীফ তার সীমা অতিক্রম করে তার উপর অত্যাচার করছে। এবং তখন সে প্রতিবাদ করে। জর্ডান প্রোটোকল ভেঙ্গে মাস্টার চীফের উপর পাল্টা আক্রমণ চালায় এবং তাকে আহত করে ফেলে দেয়। তখন অন্যান্য প্রশিক্ষণার্থীরা চীফকে থামতে বললে চীফ জানায় সে এর মাধ্যমে বরং জর্ডানকে ফেবার দিচ্ছে। সে তাকে বাড়ি ফিরে যেতে বলে কারণ এই রণক্ষেত্র নারীর কোনো জায়গা নয়। তখন আধমরা জর্ডান উঠে দাঁড়ায় এবং তীব্র ভাষায় মাস্টার চীফকে গালি দেয়। তখন মাস্টার চীফ সম্বিত ফিরে পায়।
যখন চীফ তার রক্ত পানিতে ধুয়ে ফেলতে যায় তখন তার সহপ্রশিক্ষক তাকে বলে- It was out of line in there. It ain’t gonna happen again. তখন মাস্টার চীফ উত্তর দেয়- Yeah, it will. May be not with you or with these guys or with me. She is not the problem. We are. চীফের এই বক্তব্যে উঠে আসে পুরুষতান্ত্রিক যে মনোভাব আর যে জাত্যভিমান তা আসলে কোনোদিনই নারীকে মুক্তির রাস্তায় সোজা পথে উঠতে দেবে না। কোথাও না কোথাও কোনো না কোনো ভাবে বাধা আসবেই। কারণ সমস্যাটা তো আর নারীর না। সমস্যাটা তো আসলে পুরুষের। এই সমাজে পুরুষরাই যে শুধু পুরুষ হবার কারণে নারীদের তুলনায় অতিরিক্ত অনেক ধরণের সুবিধা পেয়ে থাকে। অধিকারগুলোর যদি ভাগ বাটোয়ারা হয়ে যায় তাহলে তো সে আর নিজেকে শ্রেষ্ঠ বলে গর্ব করতে পারবে না, অতিরিক্ত সুবিধা ভোগ করতে পারবে না, ছেড়ে দিতে হবে অর্ধেক আসন, অর্ধেক নেতৃত্ব। মাস্টার চীফের বক্তব্যে তাই এই বক্তব্য উঠে আসে।
কিন্তু এদিকে তো তাকে নিয়ে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে মিডিয়াতে। এমনকি মিডিয়া তার নামকরণও করে ফেলেছে জি. আই. জেন নামে যা সিনেমার টাইটেল। সবাই তার নাম জানতে চায়। তাকে এবং সিনেটর ডিহেভেনকে নিয়ে কাভারস্টোরি করতে চায় আর ওদিকে তো এই মেয়ে ব্যর্থ হয়ে ট্রেনিংয়ে ইস্তফা দিয়ে কেনো এখনও ঘরে ফিরে আসছে না তা নিয়ে সিনেটর ডিহেভেনের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। কারণ সে চায়নি জর্ডান সেখানে ভালো করুক। সে তো তার স্টেটে নেভাল বেজগুলো থেকে যাক শুধু তাই চেয়েছেন, নারীর ক্ষমতায়ন নয়। সিনেটরের দর্শন হচ্ছে একটি দেশে নারীদেরকে বেশি দরকার ঘরে। নারীর জীবনের মূল্য পুরুষের তুলনায় বেশি। তাই যুদ্ধ বা দেশরক্ষার কাজ পুরুষেরই করা মানায় নারী কেনো শুধু শুধু তার মূল্যবান জীবন দিতে যাবে। তার এই দর্শন প্রকাশ পায় জর্ডানকে যখন মিথ্যা ফ্রেমে আটকে সিলস ট্রেনিং থেকে প্রত্যাহারের চেষ্টা করা হয়। সিনেটরের চরিত্র দেখানোর মাধ্যমে সেই নারীদের মুখোশ উন্মোচন করা হয়েছে যারা এই পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নারীদের জন্য দেয়া অতিরিক্ত সুবিধাগুলো নিয়ে বহাল তবিয়তে থাকতে চায়।
এই মিশনের পর যখন তাকে তার সহপ্রশিক্ষনার্থীরা, প্রশিক্ষকরা সম্মানের সঙ্গে দেখা শুরু করে, তখনই তাকে সেখান থেকে সরিয়ে ফেলার মিথ্যা অভিযোগ আনা হয় যে জর্ডান সমকামী। মূলত মিশনের পরদিন ওই নেভাল-বেজে থাকা এক ডাক্তার যিনি নারী, তাকে এক পার্টিতে আমন্ত্রণ জানায় এবং জর্ডান সেখানে যায়। সেখানে যারা পার্টি করছিলো তারা সবাই ওই বেজে কাজ করা নারী। তাদের সঙ্গে থাকা অবস্থায় গোপনে সিনেটর ডিহেভেনের নিযুক্ত ফটোগ্রাফার জর্ডানের ছবি তুলে নেয় এবং সেই ছবি মিলিটারিতে পাঠিয়ে জর্ডানকে সমকামের অভিযোগে অভিযুক্ত করে। তাকে এ বিষয়ে বলা হয় যে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তাকে ডেস্কে কাজ করতে হবে এবং প্রশিক্ষণ বাদ দিতে হবে। জর্ডান এটাকে তার জন্য চরম অবমাননাকর হিসেবে দেখে এবং মেনে নিতে পারে না। সে ডেস্কে কাজ করার বদলে ঘণ্টা বাজিয়ে প্রশিক্ষণ থেকে ভলান্টারিলি ইস্তফা দিয়ে ফিরে আসে। ফিরে এসে যখন সে বয়ফ্রেন্ডের কাছে জানতে পারে যে আসলে তাকে ফ্রেম করা হয়েছে তখন সে সিনেটরের সঙ্গে দেখা করতে যায়। সে সিনেটরের মুখোশ উন্মোচন করে দিতে চায় যে সিনেটর আসলে বেজ আর ভোটের জন্য তাকে শুধু ব্যবহার করেছে। জর্ডানও ছেড়ে দেয় না। সে সিনেটর ডিহেভেনকে হুমকি দেয় মিডিয়াকে সবকিছু বলে দেবার। জর্ডানের এই চাপে সিনেটর বাধ্য হয় তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ তুলে নিতে এবং প্রশিক্ষণে ফেরত পাঠায়।
জর্ডান ফিরে যায় তার প্রশিক্ষণে। প্রশিক্ষণের সর্বশেষ ধাপ অপারেশনাল রেডিনেস এক্সারসাইজ যা বিঘ্নিত হয় একটি জরুরি অবস্থার কারণে। লিবিয়ার মরুভূমিতে ইউএস এর একটি Reconnaissance Satellite পতিত হলে যারা সেটি উদ্ধার করতে যায় তাদের ইভাক্যুয়েশন প্ল্যান ব্যর্থ হয়। এই গ্রুপের সহযোগিতার জন্য জর্ডানদের প্রশিক্ষণ গ্রুপকে সেখানে পাঠানো হয়। তারা প্ল্যান করে লিবিয়ান গার্ডদের চোখে না পরে মিশন কমপ্লিট করার। কিন্তু অপারেশনের এক পর্যায়ে মাস্টার চীফের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাবার পর পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করলে জর্ডান তার টপোগ্রাফিকাল এনালাইটিক স্কিল ব্যবহার করে অসাধারণ নেতৃত্বের মাধ্যমে মিশন কমপ্লিট করে সবাইকে নিয়ে ফিরে আসতে সক্ষম হয়। মাস্টার চীফ গুলিবিদ্ধ হয় এই মিশনে। জর্ডান মাস্টার চীফকে লিবীয় সেনা এবং বোমা বিস্ফোরণ উভয়ের হাত থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। তাদের এই মিশনে অন্যান্য পুরুষদেরকে নেতৃত্ব দেয় জর্ডান। ফলে তার সতীর্থরাও এই ঘটনার পর তাকে জানায় আজকের পর তারা যেকোনো জায়গায় তার সঙ্গে যুদ্ধে যেতে প্রস্তুত। অর্থাৎ জর্ডান পুরুষতন্ত্র ও এর সকল বাধাকে অতিক্রম করতে সক্ষম হয় এবং তার সহকর্মীরাও তাকে সহজভাবে নিতে সক্ষম হয়।
সিনেমাটিতে বেশ কিছু যায়গায় মেয়েদেরকে দর্শনীয় বস্তু হিসেবে উপস্থাপন করা সত্ত্বেও (যেমন বীচের ধারে বিকিনি পড়া অন্যান্য নারীদের সঙ্গে জর্ডানের যে ছবি তুলে তার বিরুদ্ধে সমকামের অভিযোগ আনা হয়, বারে কয়েকজন নারীকে অবজেক্ট হিসেবে দেখানো) বলবো জি. আই. জেন একটি নারীবাদী সিনেমা। একজন নারীও যে পুরুষের মতো সুযোগ পেলে নিজের সত্ত্বাকে মেলে ধরতে পারে এবং সমাজের সংকীর্ণতাতে দমে না যেয়ে আত্মপ্রত্যয়ের মাধ্যমে ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে তার প্রমাণ জি.আই.জেনের জর্ডান। ফলে বলা যায় নারী সম্পর্কিত প্রচলিত অনেক ডিসকোর্সই পরিচালক এখানে ভেঙে ফেলেছেন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)