আমরা আরেকবার জহির রায়হানের মুখোমুখি দাঁড়াতে পারি; যাবতীয় ক্ষোভ, দ্রোহ, স্বপ্ন আর অভিমানের কার্নিভ্যাল নিয়ে আমরা জহির রায়হানের কাছে নিবেদন করতে পারি আমাদের সময়ের প্রয়োজন। ইতিহাসের ক্লাশরুমে আমরা জেনেছি, ব্ল্যাকবোর্ডে নয়; বরং চোখ রাখতে হয় ইতিহাস নির্মাণ-শ্রমিকদের চোখে, জেনে নিতে হয় রক্ত আর রক্তজবার পার্থক্য। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তি সংগ্রামের ভেতরে তেইশ বছরের শোষণ-বঞ্চনার যে ক্ষতগুলো ছিলো, রোদ পোহালেই তা শুকিয়ে যায় না— এ কথা কী আমরা জানতে পেরেছিলাম ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারির আগে?
পরাধীন বাংলাদেশে জীবন থেকে নেয়া জহির রায়হান স্বাধীন বাংলাদেশের সূচনালগ্নেই জীবন দিয়েছেন— বলা ভালো, জীবনের ভাষ্য নির্মাণ করেছেন। অতএব, উত্তর প্রজন্মের জন্যে তিনি সেই ভাষ্য নির্মাতাদের একজন; যাঁদের ভাষা রাজপথে গুলিবিদ্ধ করোটি সংলগ্ন, সহযোদ্ধার উপড়ে ফেলা চোখের মতোই জীবন্ত এবং অনিবার্য। এই অনিবার্যতা হতে পারতো আমাদের ইশতেহার— হয়েও ছিলো— কিন্তু আমাদের অধিকাংশ সাহিত্য বা সিনেমা করিয়েরা যেহেতু সমাজের যাবতীয় বিলাসবহুল ইতরামি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেননি, তাই আজও আমাদের ক্যালেন্ডারের শীতঘুমে স্মরণ করতে হয় জহির রায়হানকে; যদিও তিনিই হতে পারতেন আমাদের অস্তিত্বের শব্দাভিধান।
আমার চেতনা জগতে জহির রায়হানের এক অলৌকিক সমাপতন ঘটেছিলো ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে— দুজনকেই আবিষ্কার করেছিলাম তাঁদের সাহিত্যে এবং চূড়ান্ত নিমজ্জন ঘটেছে তাঁদের নির্মিত চলচ্চিত্রে। উভয়ের সৃষ্টিতেই মূর্ত হয়েছে রাজপথের রাজনীতি এবং শিকার হয়েছিলেন রাজপ্রাসাদের রাজনীতির। জীবন ও মৃত্যুর সঙ্গে বিরতিহীন সংলাপ বিনিময় করেছেন দুজনেই এবং তার রাশপ্রিন্ট হস্তান্তর করে গেছেন সময়ের কাছে; যদিও এ হস্তান্তর জহির রায়হানের ক্ষেত্রে যতোটা তাৎক্ষণিক, ঋত্বিকের ক্ষেত্রে ততোটা নয়। এর কারণ বোধ করি জহির রায়হান রাজনীতিকে চলচ্চিত্রের নাভিমূলে স্থাপন করেও গ্রামসির ‘ন্যাশনাল-পপুলার’- এর চোখ দিয়ে তাকে দেখতে পেরেছিলেন। তাই তাঁর জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০) ছয় দফার আশ্চর্য দৃশ্যকাব্য হলেও এর মায়াবী সম্প্রসারণ ঘটেছিলো আমাদের মনোজগতের প্রতিটি স্তরে। তাঁর সাহিত্যের ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য।
১৯৪৯ সালে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী জহির রায়হানের প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় নতুন সাহিত্য কুটির থেকে প্রকাশিত চতুষ্কোণ পত্রিকায়। কবিতার নাম ওদের জানিয়ে দাও। ১৯৫১ সালে, যখন তিনি ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী, ড. আলীম চৌধুরী ও এম এ কবীর সম্পাদিত যাত্রিক পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় তাঁর ছোটোগল্প হারানো বলয়। এরপর তাঁর সাহিত্য ধারাবাহিকভাবে পাঠ করলে বোঝা যায়, ইতিহাসকে তিনি গ্রহণ করেছিলেন উপকরণ হিশেবে, তা ব্যাপ্ত ছিলো তাঁর চলচ্চিত্রেও; কিন্তু ইতিহাস পুনর্বিন্যাসের সময় তিনি পাননি। তাঁর সাহিত্যে বিস্তর বিকাশ ঘটেছে মধ্যবিত্তের মননধর্মের এবং তিনি দেখিয়েছেন পতাকার রঙ বদল নয়; বরং বিপ্লব হলো মননধর্মের বদল।
উপন্যাসের গড়নে তাঁর মৌলিকত্ব ছিলো যেনো চলচ্চিত্রের ছোটো ছোটো ফ্রেমেরই মতো করে তিনি গড়ে তুলতেন এক বা দুই শব্দের বাক্য। এই ছোটো ছোটো বাক্যগুলো তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে পুরো উপন্যাস জুড়ে ছড়িয়ে বিদ্যুৎ মায়াকোভস্কির পাত্লুনপরা মেঘের মতোই। গল্পের ক্ষেত্রে অবশ্য জহির রায়হানকে খুঁজে পাই স্রোতের আরেক ধারায়, যেখানে তিনি আগুনের বাসিন্দা— শিল্প প্রভাবে দূরগামী। মধ্যবিত্তের মাতৃমুখ তাঁর সাহিত্যে যেমন আদর পেয়েছে, তেমনি নবমী নিশির মতো তিনি স্মরণ করেছেন মার্ক্সের অচর্চিত বর্ণমালাকে। মকবুল বুড়োর রোজনামচাকে তিনি পৌঁছে দিয়েছেন মন্তুর প্রাত্যহিক জীবনের কার্নিশে।
ভাবনার এ বাতাবরণ তাঁর চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও সমান অবিনাশী। এখনও তাঁর কাঁচের দেয়াল (১৯৬৩) বা বেহুলা (১৯৬৬) দেখলে আচ্ছন্ন স্মৃতি থেকে আমরা উদ্ধার করি বাংলার আদি প্রতিমাকে।
কেবল নীলাঞ্জন ছায়া সঞ্চারের জন্য নয়, শিল্পকে তিনি দেখেছিলেন ছোপ ছোপ রক্ত থেকে জেগে উঠা এক মর্মন্তুদ আলো হিসেবেই। এ কারণেই, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হতেই তিনি বলতে পেরেছিলেন— ‘আমি পথের মানুষ, পথেই ফিরে যাচ্ছি’। তিনি আদতে পথেই ছিলেন। কারণ তিনি জানতেন, শিল্পীর কোনো ঘর থাকতে নেই, ঠিকানা থাকতে নেই। শিল্পীর একমাত্র আশ্রয় হলো মানুষ। সে-ই মানুষের ওপর যখন বর্বর পাকিস্তানি দানবের ঘৃণ্য গণহত্যা শুরু হলো, জহির রায়হান লেনিনের শরনাপন্ন হলেন। স্টপ জেনোসাইড (১৯৭১) নির্মাণের সময়ই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন চলচ্চিত্রও ব্যবহৃত হয়, কেননা তার পেছনেও থাকে মানুষ নামধারী ক্রয়যোগ্য প্রাণিরা।
‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী ও কুশলী সহায়ক সমিতি’র উদ্যোগে ‘বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম পরিষদ’- এর সহযোগিতায় নির্মিত হয় স্টপ জেনোসাইড— আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম খণ্ড। এ হিসেবে জহির রায়হান যেমন বাংলাদেশের গণ-আন্দোলনভিত্তিক প্রথম রাজনৈতিক চলচ্চিত্র জীবন থেকে নেয়া’র নির্মাতা, তেমনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম চলচ্চিত্রটিও তাঁর। মনে রাখতে হবে, সে সময়ে ভারতে অবস্থানরত শিল্পীদের মধ্যে জহির রায়হান ছিলেন তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক বিভাগের একজন কর্মী। হয়তো এ কারণেই নির্মাতা আলমগীর কবিরের ইংরেজি ধারাভাষ্যে বাংলাদেশের মানুষের ওপর চালানো বর্বর পাকিস্তানিদের গণহত্যার প্রাথমিক প্রামাণ্যচিত্রটি হয়ে উঠেছে বিশ্ব চৈতন্যের পাণ্ডুলিপি। প্রামাণ্যচিত্রের শুরুতেই লেলিনের ছবি আর তার উক্তির উচ্চারণ যখন ক্রমে এগিয়ে যেতে থাকে একটি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামে ত্যাগের সত্যচিত্র হিসেবে এবং প্রতিমুহূর্তেই গণহত্যা, নির্যাতন প্রসঙ্গে ‘স্টপ’ উচ্চারণটি আমাদের কানে আসে— আমরা তখন জহির রায়হানকে খুঁজে পাই আমাদের প্রজন্মের প্রত্যাখ্যানের মাতৃভাষা হিসেবে।
কেনো বলছি আমাদের প্রজন্ম? কারণটি তিনি নিজেই দেখিয়ে গেছেন যখন প্রতিটি নির্মাণে তিনি কান পেতেছেন তাঁর সময়ের ইতিহাসে আর চোখ রেখেছেন উত্তরকালে। বোরহেসের গল্পের মতোই জহির রায়হানকে তাঁর সৃষ্টিতে খুঁজে পাই আত্মাবলোকনে; তাঁর সৃষ্টি হয়ে উঠে বাংলাদেশের আত্মার বিবরণী। এ কারণেই স্বাধীন বাংলাদেশে চলচ্চিত্রের রূপরেখা কেমন হবে, তার পূর্ণাঙ্গ ধারণাপত্র তিনি নির্মাণ করেছিলেন এবং জমাও দিয়েছিলেন সরকারের কাছে। কিন্তু তিনি যেহেতু ছিলেন রমণীয়তা থেকে দূরে এবং স্বাধীন বাংলাদেশেও পাকিস্তানি ভূত-দর্শনের লুম্পেনরা কারবার করে খাচ্ছিলো, সেহেতু জহির রায়হানের ধারণাপত্র রয়ে গেলো অননুসৃত।
শিল্পের পক্ষে এক ধরণের নাতিশীতোষ্ণতাকে অবলম্বন করে জহির রায়হানকে হয়তো বা গভীর মর্মান্তিক ভাবতে পছন্দ করেছেন তৎকালীন শিল্প-কারবারিরা। দেশ স্বাধীন হবার পরও যে দেশের মধ্যেই পাকিস্তানি প্রেতাত্মাদের দৌরাত্ম শুরু হবে, খন্দকার মোশতাকরা রাতারাতি রঙ বদলে ফেলবে— তা স্বাধীন দেশের বুঝতে সময় লেগেছিলো। শেষে বোঝা গেলো এমনই এক সময়, যখন জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করা হলো, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কফিনে একের পর এক পেরেক ঠুকে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হলো যুগপৎ সামরিকতন্ত্র আর মোল্লাতন্ত্র।
১৯৭১ সালের ষোলোই ডিসেম্বর বাংলাদেশ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মুক্ত হয়; কিন্তু মিরপুর হানাদারমুক্ত হয় ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি। ষোলোই ডিসেম্বরেই দেশে ফিরে এসেছিলেন জহির রায়হান। তাঁর ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে আল-বদররা ধরে নিয়ে গেছে, এ খবর তিনি দেশে ফেরার আগেই পেয়েছিলেন। দেশে ফিরেই তিনি বুদ্ধিজীবী হত্যা ও গণহত্যার তথ্য অনুসন্ধান ও ঘাতকদের ধরার জন্যে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করেছিলেন। জাতীয় প্রেসক্লাবের একটি ঘরে ছিলো এই কমিশনের দপ্তর। জহির রায়হান ছিলেন সেই কমিশনের চেয়ারম্যান, সদস্য সচিব ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের বাশারত আলী। প্রতিদিন শত শত স্বজনহারা মানুষ আসতেন এই দপ্তরে। এই কমিশনের এক সংবাদের সূত্রেই তিনি খুঁজে বের করেছিলেন জামায়াত ইসলামীর নেতা আল-বদরের খালেক মজুমদারকে, যে ব্যক্তি শহীদুল্লাহ কায়সারকে তাঁর কায়েতটুলীর বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলো। হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণের জন্যে আদালতের বিচারে খালেকের সাত বছরের কারাদণ্ডও হয়েছিলো।
ভাইকে খোঁজার জন্যে নানা নির্ভর-অনির্ভরযোগ্য সংবাদের ওপর ভিত্তি করেই বেরিয়ে পড়তেন জহির রায়হান। ৩০ জানুয়ারি সকালে তিনি মিরপুরে শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে যান। ওইদিন মিরপুরে অবাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় অবস্থানকারী পলাতক পাকিস্তানি সৈন্য, অবাঙালি রাজাকার ও আল-বদরদের অতর্কিতে হামলায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও পুলিশের শতাধিক সদস্য নিহত হয়েছিলেন। এদিনই নিহত হয়েছিলেন জহির রায়হান। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর রহস্য নিয়ে জল ঘোলা করেছে পাকিস্তানি দোসররা। নানা রকম মিথ্যাচার করেছে দীর্ঘ একটি সময় ধরে। অবশেষে ‘দৈনিক ভোরের কাগজ’- এ সাংবাদিক জুলফিকার আলি মানিকের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয় কীভাবে অবাঙালি, আল-বদর, রাজাকারদের গুলিতে জহির রায়হানকে হত্যা করা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণে উঠে আসে সমস্ত সত্য। অবসান হয় মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের ছড়ানো সকল বিভ্রাট।
আজ যখন কিছু পচা-গলা-প্রত্যাখ্যাত রাজনীতিবিদরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে নানা রকমের বিভ্রান্তি ছড়ানো শুরু করেছে, মুক্তিযুদ্ধে শহিদের গাণিতিক সংখ্যার উদ্ভট কুযুক্তি তৈরি করছে; তখন বারবার মনে পড়ে জহির রায়হানের সত্যদর্শী শিল্পের কথা। স্খলনের অতলে তলিয়ে যাওয়া এই আমাদের জন্যেই এখনও মহাকালের অর্ঘ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন জহির রায়হান।
অতএব, ইতিহাস বিকৃতির এই খোঁড়া রাজনৈতিক কালে জহির রায়হানই আমাদের ত্রাতা; আমাদের উদ্ধারকর্তা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)