বেলজিয়াম দেশ হিসেবে ছোট হলেও অর্থনীতিসহ অন্য সবদিক দিয়ে উন্নত। ইউরোপের উন্নত ছোট এই দেশটি এখন জঙ্গি বাড়বাড়ন্ত। এক গবেষণায় দেখা গেছে জিহাদি সরবরাহের দিক দিয়ে ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে আছে বেলজিয়াম। এই ছোট দেশটি এখন ইউরোপের জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে ‘ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অফ র্যাডিকেলাইজেশন এন্ড পলিটিক্যাল ভায়োলেন্স’ এর তথ্যানুযায়ী, ইরাক ও সিরিয়াসহ মধ্যপাচ্যের বিভিন্ন দেশে বেলজিয়ামের ৪৪০ জন জিহাদি যুদ্ধ করছে। এটা মাথাপিছু হিসাবে ফ্রান্সের দ্বিগুণ ও ব্রিটেনের চারগুণ।
ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে বেলজিয়ামের একটি ঐতিহাসিক সংযোগ রয়েছে। সর্বশেষ গত শুক্রবার ফ্রান্সের প্যারিসে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ হামলা সঙ্গেও নাম উঠেছে তাদের। গত ১৮ মাসে বড় ধরনের সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে পঞ্চমবারের মতো বেলজিয়ামের নাম উঠলো।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্যারিস হামলার সঙ্গে জড়িত অন্তত তিন জন বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে বসবাস করতেন। বিভিন্ন সময়ে সন্ত্রাসী হামলার ক্ষেত্র হয়ে ওঠা বেলজিয়ামের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যান জামবোন নিজেই বলেছেন, সরকার কোনোভাবেই এটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।
এর কারণ হিসেবে বেকারত্ব ও বৈষম্যের কথা বলছেন বিশ্লেকরা। ছোট দেশে মুসলিম জনসংখ্যার আধিক্যকেও উল্লেখ করছেন কেউ কেউ।
গবেষক পিটার ভ্যান অস্ট্রিয়েনের তথ্যানুযায়ী, সিরিয়া ও ইরাকে যুদ্ধরত বেলজিয়ানের সংখ্যা এখন ৫১৬ জনে দাঁড়িয়েছে। তার তথ্য মতে, বেলজিয়ামের মোট জনসংখ্যার ৬ লাখ ৪০ হাজার মুসলিম। এর এক শতাংশের উপরে (১২৬০) জিহাদের সঙ্গে যুক্ত।
মুসলিমদের অধিকাংশই বসবাস করে মোলেনবেক এলাকায়। বেলজিয়ামের অন্য যেকোনো অঞ্চলের চেয়ে বেকারত্বের হার এখানে অনেক বেশি। এই অঞ্চলের ৩০ শতাংশ বেকারের মধ্যে ৩৭ শতাংশই তরুণ।
‘অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং উন্নয়ন সংস্থা(ওইসিডি)’র-তথ্য অনুযায়ী ইউরোপিও ইউনিয়ন ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বেলজিয়াম বিদেশী জন্মগ্রহণকারী এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে কর্মসংস্থানের পার্থক্যের হার সর্বোচ্চ। এই বৈষম্য অনেককে উগ্রপন্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
ফরাসি ও ফ্লেমিশ ভাষীদের জন্য বেলজিয়াম সমাজ মূলত বিভক্ত। এই কারণে নতুনদের একীভূত করায় সমস্যা হচ্ছে। এটা না হলে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় প্রজন্মের অভিবাসীদের আর্থ-সামাজিকভাবে অগ্রগতি অর্জন সম্ভব হতো এবং এটা করার ভালো রকম সুযোগও ছিলো।
আরেকটা বড় সমস্যা হলো নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ১৩ লাখ ব্রাসেলস বাসিন্দার শহরে পুলিশের সংখ্যা খুবই কম।
কোনো না কোনোভাবে বেলজিয়ান জিহাদিদের জড়িত এমন হাইপ্রোফাইল সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা দেখে নেয়া যাক:
প্যারিস হামলা: হামলার তিন সন্দেহভাজন তিন ফরাসি ভাই বেলজিয়ামে বাস করতেন। এর একজন ইব্রাহীম আবদেস সালাম শুক্রবার বাটাক্লান কনসার্ট হলে আক্রমণের সময় নিহত হয়েছেন। আরেক ভাই মোহাম্মেদকে শনিবার বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসের মোলেনবেক থেকে আটক করা হয়েছে। আর তৃতীয়জন আবদেস সালাম। তাকে ধরতে গ্রেফরি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।
২০০৫ সালে ইরাকে মার্কিন সামরিক চৌকিতে হামলা: জিহাদিদের সঙ্গে বেলজিয়ামের জটিল সম্পর্ক এক দশকের বেশি সময় আগে থেকে। আইএসআইএস’র আগে আল-কায়েদার হয়ে আত্মঘাতী বোমা হামলা চালিয়েছে বেলজিয়ান জিহাদিরা। ২০০৫ সালে ইরাকে মার্কিন সামরিক চৌকিতে আত্মঘাতী হামলা চালায় বেলজিয়াম নাগরিক মুরিয়েল ডিগাউকি। তিনি খ্রিষ্টান থেকে ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন।
প্যারিসের সুপারমার্কেটে হামলা: চলতি বছরের জানুয়ারিতে ফরাসি ব্যাঙ্গ পত্রিকা শার্লি হেবদোর কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে ১২ জনকে হত্যা করে বন্দুকধারীরা। এর মাত্র কয়েকদিন পরই প্যারিসের একটি সুপার মার্কেটে হামলা চালিয়ে একজন পুলিশ অফিসারসহ আরো দুইজনকে হত্যা করে বন্দুকধারী। জিহাদি জঙ্গি আমেদি কাউলিবলি যে অস্ত্র দিয়ে হামলা চালিয়েছে ছিলেন সেই অস্ত্রও বেলজিয়াম থেকে আনা হয়েছিলো।
মোলেনবেক হত্যা: শার্লি হেবদো হামলার পরপরই বেলজিয়াম জুড়ে অভিযান চালায় সেদেশের নিরাপত্তাবাহিনী। অভিযান সময় দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় শহর ভারভিয়াসে পুলিশের গুলিতে এক সন্দেহভাজন নিহত হয়। পরে জানা যায়, সন্দেহভাজন ওই জিহাদি বেলজিয়ামের নাগরিক। কিছুদিন আগেই সে সিরিয়া থেকে বেলজিয়ামে ফিরেছে এবং সেখানে বড় ধরনের হামলার পরিকল্পনা করছিলো।
ইহুদী মিউজিয়ামে হামলা: গত বছরের মে’তে ব্রাসেলসের একটি ইহুদী মিউজিয়ামে হামলা চালিয়ে চারজনকে হত্যা করেন মেহেদী নিমেওচি। ফরাসি এই নাগরিক মিউজিয়াম হত্যাকাণ্ডে ব্যবহার করেন বেলজিয়ামের অস্ত্র, যেটা তিন জিহাদিদের অভয়ারণ্য হিসেবে খ্যাত মোলেনবেক থেকেই নিয়েছিলেন। হামলা চালিয়ে পালানোর পর ফ্রান্সের মার্সেই থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।
প্যারিস-ব্রাসেলসগামী ট্রেনে ব্যর্থ হামলা: গত আগস্টে প্যারিস থেকে ব্রাসেলসেগামী একটি ট্রেনে বড় ধরনের হামলার পরিকল্পনা করেছিলেন মরক্কোর নাগরিক আইয়ুব এল-খাজানি। কিন্তু নিরাপত্তাবাহিনীর তৎপতায় শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হন তিনি। পরে কর্মকতারার জানান, মরক্কোর নাগরিক হলেও খাজানি দীর্ঘদিন ব্রাসেলসে থাকতেন।