যে কোনো পেশায় কর্মতুষ্টি পেশার মানোন্নয়নে গূরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অতি সম্প্রতি একটি গবেষণায় দেখেছি, জাপানে বয়স্কদের চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসকদের কর্মতুষ্টি আছে কিনা এবং কী কী বিষয় এর উপর তা নির্ভরশীল। শুধু জাপান নয়, আমেরিকা, ইন্দোনেশিয়া, চীনসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এধরনের গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছে। বাংলাদেশের চিকিৎসকদের কর্মতুষ্টি নিয়ে সরাসরি কোন গবেষণা এখন পর্যন্ত না হলেও বিভিন্ন আলোচনায় এ বিষয়টি উঠে এসেছে।
সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে আমাদের দেশের চিকিৎসকরা যে মানের সেবা দিয়ে থাকেন তা আমরা নিজেরা কম আলোচনা করলেও বহির্বিশ্বে সমাদৃত। পর্যাপ্ত মানবসম্পদের অভাব, অপর্যাপ্ত বরাদ্দ, এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতা আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার মূল প্রতিবন্ধক। অন্যান্য দেশে চিকিৎসকদের কর্মতুষ্টি নিয়ে যে গবেষণাগুলো হয়েছে সেখানে চিকিৎসকদের কাজের পরিবেশ, আর্থিক প্রণোদনা, পেশাগত সমৃদ্ধি, চিকিৎসক রোগীর সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয় প্রতিফলিত হয়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যদি চিকিৎসকদের কাজের পরিবেশ নিয়ে ভাবা হয় তাহলে প্রথমেই আলোচিত হবে ধারণক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত রোগীর চাপ। প্রতিটি সরকারি হাসপাতাল তার ধারণ ক্ষমতার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি রোগী ভর্তি নিয়ে চিকিৎসা দিয়ে থাকে। এই বাড়তি রোগীর চাপ কিন্তু সামাল দিতে হয় চিকিৎসক, নার্স এবং চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত অন্যান্য কর্মীদের। আবার চিকিৎসা সেবা যে শুধু চিকিৎসক নির্ভর তাতো নয়, এর সাথে নার্স, স্বাস্থ্য সহকারী, ল্যাবরেটরি টেকনিশিয়ান এবং অন্যান্যরাও ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা অনুযায়ী যেখানে প্রতি একজন চিকিৎসকের জন্য তিনজন নার্স প্রয়োজন, সেখানে আমাদের দেশে চিকিৎসকের সংখ্যার তুলনায় নার্সের সংখ্যা প্রায় অর্ধেক। বর্তমানে কোভিড-১৯ বিশ্বমারীতেও আমাদের হাসপাতাল, চিকিৎসক, এবং সকল স্বাস্থ্যকর্মীকে অতিরিক্ত রোগীর চাপ সামলাতে হচ্ছে। এতে সেবার মান যেমন ব্যহত হচ্ছে, তেমনই অতিরিক্ত কাজের চাপে ঝুঁকির মুখে পড়ছে সকল স্বাস্থ্যকর্মীর দৈহিক ও মানসিক স্বাস্থ্য।
চিকিৎসক রোগীর সম্পর্ক চিকিৎসকদের কর্মতুষ্টি এবং কাজের স্পৃহার অন্যতম নিয়ামক। অথচ প্রায় প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও রোগীর স্বজনদের হাতে চিকিৎসক নিগ্রহের খবর পাওয়া যায়। প্রচলিত সংবাদমাধ্যমে লেখা হয় যে, ভুল চিকিৎসার কারণে স্বজনদের হাতে চিকিৎসক নিগ্রহ। এখানে প্রশ্ন থেকে যায় এই ভুল চিকিৎসা নির্ধারণ করবে কে? রোগীর স্বজন না কি সংবাদকর্মীরা? সংবাদমাধ্যমে এ ধরণের শিরোনাম ও পরোক্ষভাবে এরকম অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্ম নিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। সর্বশেষ একজন কোভিড আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু হবার পরেও চিকিৎসক নিগ্রহের ঘটনা ঘটেছে। অথচ বিশ্বব্যাপী কোভিড আক্রান্ত মানুষ মৃত্যুবরণ করছেন প্রতিনিয়ত। এখন পর্যন্ত কোভিডের কোন সুনির্দিষ্ট এবং কার্যকরী চিকিৎসা নেই বিধায় প্রতিরোধই একমাত্র উপায়। কোভিড আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুতে চিকিৎসক নিগ্রহের ঘটনাই চিকিৎসকদের কাজের পরিবেশের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে।
কোভিড-১৯ বিশ্বমারীতে চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত কর্মীরা আরেকটি বিশাল প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েছেন। সরাসরি কোভিড-১৯ রোগীদের সংস্পর্শে আসায় তারা সবসময়ই ঝুঁকিতে ছিলেন এবং আছেন। এখন পর্যন্ত কত সহস্র চিকিৎসক কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়েছেন তার সঠিক হিসেব আমাদের কাছে নেই। কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন শতাধিক চিকিৎসক যারা প্রায় প্রত্যেকে কোভিড-১৯ রোগীর চিকিৎসায় নিয়োজিত ছিলেন। চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের ও পরিবার আছে, যারাও তাদের মাধ্যমে এই ঝুঁকির সম্মুখীন হয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন অনেক ছবি আমরা দেখেছি যেখানে ছোট শিশু আকুতি নিয়ে তাকিয়ে আছে চিকিৎসক মা কিংবা বাবার দিকে, অথচ কাছে যেতে পারছে না। এই যে মানসিক চাপ নিয়ে চিকিৎসক এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরা কাজ করে যাচ্ছেন, তার জন্য সামান্য ধন্যবাদ তো তারা প্রত্যাশা করতেই পারেন। সামান্য কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন ই কাজের স্পৃহা বাড়াতে নিয়ামকের ভূমিকা রাখতে পারে।
গত বছর যখন কোভিড-১৯ এর প্রথম ধাক্কা আসে, তখন চিকিৎসক, স্বাস্থ্যসেবাকর্মীসহ অন্যান্য ফ্রন্টলাইনারদের জন্য সরকার কর্তৃক প্রণোদনা ঘোষিত হয়। নিঃসন্দেহে ফ্রন্টলাইনার দের উৎসাহিত করার জন্য, কাজের স্পৃহা বাড়ানোর জন্য এটি ভালো উদ্যোগ। এমন নয় যে এই প্রণোদনার জন্যই তারা কাজ করেন, কিংবা প্রণোদনা ছাড়া কাজ করবেন না। বরং এটি এক ধরনের স্বীকৃতি। ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিতদের জন্য বিভিন্ন দেশে সবসময়ই ঝুঁকিভাতার প্রচলন আছে। আমাদের দেশে চিকিৎসকদের জন্য সুনির্দিষ্ট কোন ঝুঁকি বিষয়ক নীতিমালা আছে কি না জানা নেই, তবে কোভিড-১৯ এ ঘোষিত প্রণোদনা কে সেই ঝুঁকিভাতা হিসেবেই ধরা যায়। অথচ বছর পেরিয়ে যখন চিকিৎসকরা কোভিড-১৯ এর দ্বিতীয় ধাক্কা সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন তখনও সেই প্রণোদনা তারা পান নি। এমন নয় যে দেশে কেউই তা পায় নি, অন্যান্য অনেক ফ্রন্টলাইনারই তা পেয়েছেন। কোভিড-১৯ বিশ্বমারীতে চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিতরা ব্যতিত অন্যান্য পেশায় নিয়োজিতরা কিভাবে বেশি ঝুঁকিতে আসছেন তা তর্কসাপেক্ষ।
গত বছর মার্চ মাসে বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগীর সন্ধান পাওয়ার পরে, সারাদেশে সাধারণ ছুটি ঘোষিত হলেও, দেশের কোনো স্বাস্থ্যকর্মী এক দিনের জন্যেও ছুটিতে যাননি। দেশের প্রয়োজনে সকল স্বাস্থ্যকর্মীর সব ধরণের ছুটি বাতিল করা হয়। সারা দেশে লকডাউন ঘোষিত হয়, স্বাস্থ্যকর্মীরা নিজ ব্যবস্থাপনায় যাতায়ত করেন এবং সেবা কর্ম অব্যহত রাখেন। শুধু চিকিৎসকরাই নন, স্বাস্থ্যসেবাখাতের সাথে জড়িত সকলেই সীমাহীন ত্যাগ স্বীকার করেন। মেডিক্যাল টেকনোলজিস্টরা চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে গ্রামেগঞ্জে গিয়ে রোগীর স্যাম্পল সংগ্রহ করেন, এম্বুলেন্সে করে মোটরসাইকেলে করে সেই স্যাম্পল যথাসময়ে বিভাগীয় বা জেলা সদরের ল্যাবে প্রেরণ করেন। ল্যাবে মাইক্রোবায়োলজিস্টরা সকাল-বিকাল-রাত সেই স্যাম্পল পিসিআর মেশিনে দিয়ে রেজাল্ট বের করেন। হাসপাতালগুলোর পরিসংখ্যানবিদরা যথা সময়ে সেই রেজাল্ট রিপোর্টিং করেন। দেশের কোনো সিভিল সার্জন অফিস এক দিনও বন্ধ ছিল না, অফিসের কর্মীরা সকাল থেকে রাত অবধি স্বাস্থ্যঅধিদপ্তরের সাথে যোগাযোগ বজায় রেখে দিকনির্দেশনা মোতাবেক কাজ করে গিয়েছেন। চিকিৎসক, নার্স, টেকনোলজিস্ট, মাইক্রোবায়োলজিস্ট , অফিস কর্মীদের এই অবদান আমাদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে হবে।
তাই, প্রণোদনা সবার আগে পাওয়া উচিত ছিল এই স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। এই প্রণোদনার দিকে যে চিকিৎসক সমাজ বুভুক্ষের মতো তাকিয়ে আছেন তা নয়। কিন্তু ঘোষিত প্রণোদনা যখন অন্যান্য পেশায় নিয়োজিতরা পান এবং সাধারণ মানুষ প্রণোদোনার ঘোষণা জেনে চিকিৎসকরা তা পেয়েছেন বলে ধরে নেন, তখন প্রণোদনা না পাওয়া চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের জন্য তা হতাশার এবং ক্ষেত্রবিশেষে অসম্মানের।
সর্বশেষ লকডাউন এর সময় চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের হেনস্তার শিকার হতে হয়েছে “মুভমেন্ট পাস” নিয়ে। চিকিৎসক এর পরিচয়পত্র দেখার পরেও তাদেরকে যেতে দেয়া হয় নি কিংবা জরিমানা করা হয়েছে। এধরনের অতি উৎসাহী কর্মকান্ড ও যথেষ্ট হতাশাজনক।
হাসপাতালে যেমন কেউ শখ করে যায় না, তেমনি চিকিৎসকরাও হাসপাতালে বেড়াতে যান না, যান চিকিৎসা দিতে। এই মুভমেন্ট পাস প্রচলনের সময় শুরু থেকেই চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের এর জন্য তা উন্মুক্ত করা উচিত ছিল। কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে গৃহীত বিভিন্ন সিদ্ধান্তের মতোই এ বিষয়টিতেও সমন্বয়হীনতা পরিলক্ষিত হয়েছে।
শুরু করেছিলাম চিকিৎসকের কর্মতুষ্টি নিয়ে, যা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা এবং গবেষণা এখন সময়ের দাবী। সীমিত সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে গেলে চিকিৎসকদের কর্মতুষ্টি, কাজের পরিবেশ ইত্যাদি নিশ্চিত করা জরুরী। অনিচ্ছুক ঘোড়া দিয়ে যেমন ঘোড়দৌড় প্রতিযোগীতায় জয়ী হওয়া অসম্ভব, তেমনি হতাশ, কাজের চাপে পিষ্ট, শংকিত চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যসেবাকর্মী দিয়েও ভালো মানের সেবা নিশ্চিত করা অসম্ভব, জোড়াতালি দিয়ে কোনরকমে চালিয়ে নেয়া সম্ভব খুব জোর।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)