সারাদেশের চরাঞ্চলে যে এক কোটি মানুষের বসবাস এর মধ্যে বড় অংশ নারী। এই নারীরা কম-বেশি সবাই কৃষিকাজের সাথে যুক্ত। যারা চরের কৃষাণী বলেই পরিচিত। এঁরাই অপার কষ্টে-পরিশ্রমে ফসল চাষ করে, যত্মআত্তি করে ঘরে তোলে। বহু দুর্গম দূরবর্তী চরে গিয়ে দেখেছি কৃষিকাজের সাথে পুরুষদের তেমন একটা সম্পৃক্ততা নেই। কৃষিকর্মের প্রায় সবই করছে নারীরা। এর অন্তর্গত কিছু কারণও অবশ্য রয়েছে। প্রথমত পুরুষেরা বেশিরভাগ সময় বাড়িতেই থাকে না। আয় রোজগারের জন্য তারা পার্শ্ববর্তী শহরে, গঞ্জে পাড়ি জমান। আবার সীমান্ত এলাকায় দেখা যায় বেশিরভাগ পুরুষ কাজের সন্ধানে প্রতিবেশী দেশ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে চলে গেছেন। ফলে কৃষিকাজের সবকিছুই সামাল দিতে হয় নারীদের। এদিকে বাড়ির আশেপাশে প্রচুর কৃষিজমি থাকার কারণে নারীরা বাড়তি আয়ের লক্ষ্যেও কৃষিকাজ করতে পছন্দও করেন। আর তাই বছর এলে বা কৃষি মৌসুম শুরু হলে চরের প্রায় প্রতিটি ভূমিহীন নারীই এক দুই বিঘা জমি বন্দোবস্ত নিয়ে বাদাম, তিল, ধনে, পটল, কুমড়া, পেঁয়াজ, ভুট্টা- এসব ফসল, সবজি চাষ করেন।
চরের সম্ভাবনাময় ফসলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো হলো- ধান, বাদাম, পেঁয়াজ, রসুন, ভুট্টা, গম, মাসকালাই। সবজির মধ্যে কুমড়া, পটল, শাক, চিচিঙ্গা, পেঁপে, বেগুন, কচু চরাঞ্চলে তুলনামূলক বেশি হয়ে থাকে। এছাড়া স্থানভেদে এখন কালোজিরা, ধনিয়া, মেথিসহ বিভিন্ন ধরনের মসলার চাষও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। একই সাথে ভেষজ জাতীয় গাছেরও চাষাবাদ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে চরাঞ্চলে। উল্লিখিত ফসল, সবজিসমূহ চাষবাস করে বাড়তি আয়ের মাধ্যমে চরের অনেক কৃষাণীই তাঁদের জীবনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে। উত্তরবঙ্গের কুড়িগ্রাম এবং লালমনিরহাট জেলার বিভিন্ন চরাঞ্চলে তামাক চাষের সাথেও নারীরা সম্পৃক্ত। তবে এই ধরনের চাষবাসকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।
দেশের প্রচুর চরে এখন চিনাবাদাম চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। চিনাবাদাম চাষেও কৃষাণীরা মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। জমি তৈরি থেকে শুরু করে সবই তারা করছে। বাদাম তোলার সময় হলে দেখা যাচ্ছে নারীরা দল বেঁধে ক্ষেত থেকে বাদাম তুলছে। বিশেষ করে যমুনা, তিস্তা ও পদ্মার চরে শত শত বিঘা জমিতে এখন বাদাম চাষ হয়। আর বাদমই বদলে দিয়েছে চরের অতিদরিদ্র নারী বা কৃষাণীর জীবনমান। জামালপুর, রাজবাড়ি, পাবনা, লালমনিরহাট, রংপুর, রাজশাহীতে বহু কৃষাণী নিজেরাই স্বল্প বিনিয়োগে বাদাম চাষ করে থাকেন। বাদামকে এখন ‘চরের সোনা’ও বলা হয়। জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ, ইসলামপুর, বখশীগঞ্জের বিভিন্ন চরগুলোতে যে বাদাম চাষ হয় সেটা কৃষাণীরাই করে থাকেন। এদিকে বৃহত্তর ময়মনসিংহ এলাকায় ব্যাপক চরাঞ্চলে যে সরিষার চাষাবাদ হয় সেখানেও সবচেয়ে বেশি অংশগ্রহণ রয়েছে নারী কৃষকদের। বালুময় ব্রক্ষ্মপুত্র নদের চরে শুষ্ক মৌসুমে প্রতিবছরই কৃষাণীরা প্রচুর সরিষার আবাদ করে থাকেন। চরের বড় অংশই এখন ‘সবজিভান্ডার’ বলে খ্যাত। বিশেষ করে ব্রক্ষ্মপুত্র নদ অববাহিকা এবং তিস্তাতে প্রচুর সবজি হয়। এদিকে তিস্তা নদীর শতাধিক বালুচরে শুষ্ক বা খরা মৌসুমে এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো কুমড়া চাষ। এই কাজটিও করে থাকেন কৃষাণীরাই। বিভিন্ন উন্নয়ন সংগঠন থেকে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কৃষাণীরা বিশেষ কায়দায় তিস্তার তপ্ত বালুময় চরে কুমড়ার চাষ করে কিছুটা হলেও তাদের অভাবে সংসারে স্বাচ্ছন্দ্য ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন। উন্নয়ন সংগঠন প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশনের সহায়তায় উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন চরাঞ্চলে মিষ্টি কুমড়া চাষে রীতিমতো বিপ্লব হয়েছে বললে ভুল হবে না। বালুতে বিশেষ পদ্ধতিতে কুমড়া চাষ করা হয়। কুমড়া ছাড়াও চরাঞ্চলে হালে স্কোয়াশ চাষও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
হালে খানিকটা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চরাঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের ওষধি গাছের চাষাবাদও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ওষধি গাছের চাষবাস মূলত কৃষাণীরাই করে থাকেন। চরে বসবাসরত কৃষাণীরা বাড়ির আশেপাশে যে পতিত জমি পড়ে থাকে সেখানেই ওষধি গাছের চাষবাস করে লাভবান হচ্ছেন। রাজশাহী বাঘা উপজেলার বিভিন্ন দুর্গম চরে কৃষাণীরা বসতবাড়ির চারপাশে ঘৃতকুমার, তুলশী, বাসক, কালমেঘ-প্রভৃতি ওষধি গাছের চাষ করে আর্থিকভাবে বেশ সাফল্য পেয়েছেন।
এদিকে চরের নারীদের আরেকটি বড় আয়ের উৎস হলো-গবাদি পশুপালন। পশুপালনে চরের নারীরা বরাবরই দক্ষ এবং পরিশ্রমী। এ কারণেই চরের নারীরা পশুপালনে সবসময় উৎসাহ বোধ করে থাকেন। পাবনার যমুনা বক্ষের সবুজ সুন্দর চরগুলোতে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি পরিবারেই গরু রয়েছে। নারীরা আপন মমতায় লালন পালন করছেন। অনেক চরেই পুঁজি স্বল্পতার কারণে নারীরা সংঘবদ্ধ হয়ে সমিতি করে যৌথ মালিকানায় গরু লালনপালন করছেন। পরবর্তীতে তারা গরু বিক্রি করে লাভের টাকা সমানভাবে নিজেদের মধ্যে ভাগ করেন। এভাবে পদ্মা, যমুনা বক্ষের বহু নারী গরু পালনের মধ্যদিয়ে পরিবারের সম্পদ ও সঞ্চয় দুইই বাড়াতে সক্ষম হয়েছেন। যমুনা সমাজ কল্যাণ সংস্থা বহুদিন ধরে যমুনা চরের কৃষাণীদের উন্নয়নে কাজ করছে। এই সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক মনজেদ আলী তাঁর অভিজ্ঞতা টেনে জানান, গরু পালন করে বছর শেষে একজন নারী ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত লাভ করতে সক্ষম হয়েছেন। চরের নারীরা শুধু গরুপালনই নয়, পাশাপাশি ছাগল ও ভেড়া পালনও করে থাকে। ভেড়াপালন চরাঞ্চলে এখন বেশ জনপ্রিয় উঠেছে। গরু পালনের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, একেক জন নারী বছর জুড়ে ১৬ থেকে ২০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে দ্বিগুণেরও বেশি দামে গরু বিক্রি করে থাকে। ফলে দেখা যায়, গরুর পেছনে যে খরচপাতি হয়েছে সে অর্থ বাদ দিয়েও বড় অংকের টাকা লাভ থাকছে।
চাষবাস এবং পশুপালনের ক্ষেত্রে চরের কৃষাণীদেরকে বহুবিধ সমস্যাও পোহাতে হয়। বিশেষ করে জমি প্রস্তুত করা থেকে শুরু করে বীজ সংগ্রহ, ফসল বোনা, যত্ম-আত্তি করা, ফসল কাটা-সবক্ষেত্রেই তাদেরকে বেশি কষ্ট ও পরিশ্রম করতে হয়। এদিকে ফসল থেকে তাদের বাড়তি আয়ের বিষয়টি পুরোটাই নির্ভর করে প্রকৃতির মেজাজের উপর। এর প্রধানতম কারণ চর এলাকা সবচেয়ে বেশি প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ। এখানে নদী ভাঙ্গন, বন্যা, খরা থেকে শুরু করে সব ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগই বিদ্যমান। ফলে দেখা যায়, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে অনেক সময় ভালো ফসল হওয়া সত্ত্বেও তার সুফল তারা ভোগ করতে পারেনি। বেশিরভাগ সময় আকস্মিক বন্যায় চরের ফসল ডুবে নষ্ট হয়ে যায়। আবার খরার সময় বৃষ্টিপাত না হওয়ার কারণে বা প্রয়োজনীয় সেচ সুবিধা না থাকায় পটল, বাদামের ক্ষেত পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষাণীরা। একইসাথে ক্ষেতে পোকামাকড়ের প্রকোপ বাড়লে তাও তারা জরুরী ভিত্তিতে নিরসন করতে সমর্থ হন না। কারণ কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের অফিসসমূহ মূলভূমিতে হওয়ার কারণে তাদের সাথে তাৎক্ষণিকভাবে যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব হয় না। আবার কর্মকর্তা বা ব্লক সুপারভাইজাররা সমস্যা সম্পর্কে অবহিত হলেও লোকবলের অভাব, যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না- এরকম নানা অজুহাতে তারা সরাসরি সরেজমিনে যেতে চান না। এরকম প্রেক্ষিতে দেখা যায়- সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চরের কৃষাণীরা। এরকম স্থানীয় পর্যায়ে অসংখ্য সমস্যা রয়েছে যে সব সমস্যা সমাধান না হওয়ার কারণেই কৃষাণীরা তাদের প্রত্যাশা মাফিক ফসল ঘরে তুলতে পারে না। তবে প্রকৃতি ভালো থাকলে, দুর্যোগ না হলে চরের কৃষাণীদের মুখে হাসি ফুটতে সময় লাগে না।
চরের কৃষাণীরা যুগ যুগ ধরে কৃষি কাজের সাথে যুক্ত হলেও কৃষক হিসেবে তারা কোনো স্বীকৃতি পাননি। আর স্বীকৃতি পাননি বলে কৃষিকার্ড প্রাপ্তি, ব্যাংক ঋণসহ বিভিন্ন ধরনের সহায়তা পাওয়া থেকে তারা বঞ্চিত রয়েছেন।দেশের চরাঞ্চলে কত কৃষাণী রয়েছে তারও কোনো সঠিক তথ্য নেই। চরের কৃষাণীদের কাজের স্বীকৃতি দেওয়ার সময় এসেছে। চরের কৃষাণীদের কাজের স্বীকৃতি দেওয়া হলে আমাদের খাদ্য উৎপাদন আরও বাড়বে যা আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)