অনেক আগেই অনন্য মাইলফলক স্পর্শ করেছে দেশের বিদ্যুৎ। প্রায় তেইশ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ক্লাবে নাম লিখিয়েছে বাংলাদেশ। গেলো বছর হাতিরঝিলে বর্ণিল আলোক উৎসব আয়োজনের মাধ্যমে শুরু হয় যে উৎসব: তার রেশ চলছে এখনো। তখন বসুন্ধরা এবং মিরপুরেও আতশবাজি পুড়িয়ে এই আলোক উৎসব করা হয়। হাতিরঝিলে উনিশো একাত্তর সাল থেকে এই পর্যন্ত বিদ্যুতের অবস্থা তুলে ধরা হয় তখন লেজার শো’র মাধ্যমে। সেই বর্ণিল আতশবাজিতে ঝিকমিক করে ওঠে রাতের আকাশ এখনো বিদ্যুতে সফলতার আলোতে জ্বলছে। চোখ ধাঁধানো আলোক সফলতার বড় সাক্ষি রাজধানীবাসী। অনির্বাণ আগামীর বাংলাদেশ একমাত্র বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মাধ্যমেই নিশ্চিত করা যায়।
দুই হাজার নয় সালে তীব্র বিদ্যুৎ সংকটের মধ্যে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। সরকারের টানা দুই মেয়াদের শাসনামলে দেশে বিদ্যুৎ পরিস্থিতির ব্যাপক উন্নতি হয়। এরই মধ্যে দেশে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংখ্যা একশটি ছাড়িয়ে হয়েছে একশো চব্বিশটির বেশি। কয়লাভিত্তিক, গ্যাসভিত্তিক, তেলে চালানো, ডুয়েল ফুয়েল গ্যাসেও চালানো যায়, তেলেও চালানো যায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পাশাপাশি চলছে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ কাজ। সৌর বিদ্যুতের ব্যবহারও ব্যাপকভাবে বাড়িয়েছে সরকার। দুই হাজার একুশ সালের মধ্যে চব্বিশ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে শতভাগ মানুষকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার। এরই মধ্যে স্থাপিত সব কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা বেড়ে হয়েছে সতেরো হাজার তেতাল্লিশ মেগাওয়াট। এছাড়া ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্টগুলো থেকে দুই হাজার আটশো মেগাওয়াট এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে প্রায় দুইশো নব্বই মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে। আর দেশের মোট জনগোষ্ঠীর নব্বই শতাংশই এখন বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে।
দুই হাজার তেরো সালের বারো নভেম্বর দশ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা অর্জনের সফলতার দাবিদার বিদ্যুৎ বিভাগ। তিন বছর পর দু্ই হাজার ষোল সালের নয় ডিসেম্বর পনের হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা অর্জনের সফলতা আসে। বিশ হাজার মেগাওয়ার্টের সফলতা পেয়েছি আমরা। দেশের একশত চব্বিশটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা সতেরো হাজার তিতাল্লিশ মেগাওয়াট। এর সঙ্গে ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্টগুলো থেকে আরও দুই হাজার আট শত মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যায়। নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে প্রায় দুই শত নব্বই মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। সেই হিসাবে মোট উৎপাদন ক্ষমতা দাঁড়িয়েছে প্রায় তেইশ হাজার মেগাওয়ার্টের কাছাকাছি। এই সফলতার দাবিদার বিদ্যুত বিভাগ। এর পরে সেপ্টেম্বরে ভারত থেকে আসে পাঁচ শত মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। বর্তমান সরকার দুই হাজার নয় সালে ক্ষমতা গ্রহণের সময় বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ছিল চার হাজার নয়শত বিয়াল্লিশ মেগাওয়াট। মাত্র দশ বছরে এই অগ্রগতি নিঃসন্দেহে একটি বিরল অর্জন। তাই বার্ষিক কর্মসম্পাদন মূল্যায়নে প্রথম স্থান অর্জন করেছে দেশের বিদ্যুৎ বিভাগ।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম স্মাক্ষরিত এক চিঠিতে জানা যায়, দু্ই হাজার আঠারো থেকে দুই হাজার উনিশ অর্থবছরে বিদ্যুৎ বিভাগ বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির সার্বিক মূল্যায়নে একান্নটি মন্ত্রণালয় বিভাগের মধ্যে বিদ্যুৎ বিভাগ প্রথম স্থান অর্জন করেছে। বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি এপিএ’তে বিদ্যুৎ বিভাগের অর্জিত নাম্বার ছিয়ানব্বই দশমিক চার ছয়। বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি এপিএ মূলত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি হিসাবে মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর প্রতিনিধি হিসাবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বিভাগের সচিবের মধ্যে স্বাক্ষরিত একটি সমঝোতা দলিল। সরকারি কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি, সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা উন্নয়নের জন্যে সরকারি কর্মসম্পাদন ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির আওতায় বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি প্রবর্তন করা হয়। এই চুক্তিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বিভাগের কৌশলগত উদ্দেশ্যে সব কৌশলগত উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য নেওয়া কার্যক্রম ও এসব কাজের ফলাফল নিরুপনের জন্য কর্মসম্পাদন সূচক ও লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হয়। সংশ্লিষ্ট অর্থবছর শেষ হওয়ার পর ওই বছরের চুক্তিতে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বিভাগের প্রকৃত অর্জন মূল্যায়ন করা হয়। দু্ই হাজার আঠারো থেকে দুই হাজার উনিশ অর্থবছরে বিদ্যুৎ বিভাগ সাতান্নটি কর্মসম্পাদন সূচকের মধ্যে উনপঞ্চাশটিতে শতভাগ অর্জন করে। তবে অন্য চারটিতে কোনো অর্জন নেই।
এই সফলতার বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘এ সাফল্যের মূলমন্ত্র মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সফল নেতৃত্ব এবং বিদ্যুৎ বিভাগের দলগত চেষ্টা। বাংলাদেশে মানুষের ঘরে ঘরে বিদ্যুং পৌছে দেয়ার জন্য আমরা নিরলস ভাবে কাজ করছি।’
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে সরকার নানামুখী কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে। এপিএ’র মাধ্যমে সব কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিদ্যুৎ বিভাগ বিভিন্ন কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করে। উনত্রিশ মে দুই হাজার উনিশ এর হিসাব অনুযায়ী সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন বারো হাজার আটশত তিরানব্বই মেগাওয়ার্ট। বিদ্যুতের বর্তমান গ্রাহক সংখ্যা তিন কোটি পঞ্চান্ন লক্ষ। বিদ্যুতের মোট সঞ্চালন লাইন এগারো হাজার আটশত চুরানব্বই এবং গ্রিড সাবষ্টেশনের ক্ষমতা বিয়াল্লিশ হাজার একশো নব্বই এমভিএ। বিদ্যুতের মোট বিতরণ লাইন আছে পাঁচ লাখ ছয় চল্লিশ হাজার কিলোমিটার জুড়ে। বিতরণে সিস্টেম লস হয় জুন দুই হাজার উনিশ এর হিসাব অনুযায়ী নয় দশমিক পয়ত্রিশ শতাংশ আর মোট বিতরণ লস নয় দশমিক পঁয়ত্রিশ। বিদ্যুতের মাথাপিছু উৎপাদন পাঁচশো দশ এবং বিদ্যুৎ সুবিধা আওতার জনগোষ্ঠীর পরিমাণ পঁচানব্বই শতাংশ।
কর্মসম্পাদন সূচকে বিদ্যুত বিভাগের প্রথম হওয়ার সফলতার পেছনের প্রধান কারিগর বাংলাদেশের আলোকিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণের প্রতিটি ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়া- তার সরকারের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন সবসময়ই। বিদ্যুৎ বিভাগের এই সফলতার প্রতিক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রী বলেন- ‘বিদ্যুৎ ব্যতীত কোনভাবেই কাঙ্খিত উন্নয়ন সম্ভব নয়। একটি দেশের উন্নয়নে বিদ্যুৎ অপরিহার্য। আমরা দেশের সুষম উন্নয়নে বিশ্বাসী। কাজেই আমাদের লক্ষ্য শুধু শহরেই নয় তৃণমূলের গ্রাম গঞ্জের ঘরে ঘরে বিদ্যুতের সেবা পৌঁছে দেয়া।’
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী গণভবনে চারটি নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং দশটি উপজেলায় শতভাগ বিদ্যুতায়নের উদ্বোধন করেন। চারটি নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলো শিকলবাহা দুইশো পঁচিশ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকল পাওয়ার প্লান্ট। চাঁপাইনবাবগঞ্জ একশো মেগাওয়াট পাওয়ার প্লান্ট। শাল্লা চারশো কিলোওয়াট সোলার পাওয়ার প্লান্ট এবং সরিষাবাড়ি তিন মেগাওয়াট সোলার পাওয়ার প্লান্ট। শতভাগ বিদ্যুতায়িত উপজেলা আরও হলো- ফরিদপুর সদর, রাজৈর, নওগাঁ সদর, কামারখন্দ, আখাউড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর, শালিখা, মেহেরপুর সদর, মদন ও বেলাবো।
প্রধানমন্ত্রী বিদ্যুতের সফলতার বিষয়ে আরও বলেন- ‘দুই হাজার নয় সালে আবার আমরা শুরু করলাম কিভাবে দেশের উন্নয়ন করবো। কিন্তু উন্নয়ন করতে গেলে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন অপরিহার্য। সেজন্য আমাদের একটা প্রচেষ্টাই ছিল কত দ্রুত আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারি। উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গে গ্রীড লাইন তৈরি এবং সরবরাহে আমরা গুরুত্ব দেই।’
প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক ই এলাহী চৌধুরী এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট নসরুল হামিদ বিপু বিদ্যুত বিভাগের প্রথম হওয়ার সফলতার পেছনে অবদান রেখে চলেছেন। বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব আহমেদ কায়কাউস বিভিন্ন সময় নানা জায়গায় পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে দেশের বিদ্যুৎ খাতের অগ্রগতির চিত্র তুলে ধরেন নিয়মিত এবং প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব নজিবুর রহমান ও অন্যদের সাথে বারবার ভিডিও কনফারেন্স করে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করেন।
সরকার বিদ্যুতের বহুমুখীকরণেও গুরুত্বারোপ করেছে এমনটাই বারবার উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী- ‘আমরা যেমন সোলার পাওয়ার প্লান্ট করছি, তেমনি পরামাণু ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রও করছি। তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করছি আবার ভারতের থেকেও বিদ্যুৎ কিনে নিয়ে আসছি। জামায়ত বিএনপি সরকার বিদ্যুৎ রেখে গিয়েছিল ষোলশো মেগাওয়াট আর আমরা দিচ্ছি প্রায় তেইশ মেগাওয়াট আশা করি বাংলাদেশের জনগণ এটা একটু ভালোভাবে মনে রাখবেন। প্রায় পঁচানব্বই ভাগ মানুষ এখন বিদ্যুৎ পাচ্ছেন এবং আমাদের লক্ষ্য প্রত্যেক ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ যাবে। সব থেকে আনন্দের বিষয় জাতীয় গ্রীডে সোলার বিদ্যুৎ থেকে যোগ হয়েছে। যদিও এটা খুব ব্যয়বহুল তারপরেও যে যাত্রাটা শুরু হয়েছে ভবিষ্যতে এই সোলার বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যবহারের অতিরিক্তটা আমাদের জাতীয় গ্রীডে চলে আসছে। নতুন প্রযুক্তি যখন এসে গেছে তাই আমরা এটা ব্যবহার করতে শুরু করে দিয়েছি। কাজেই আমাদের দুর্গম সব এলাকাতেও সোলার প্যানেলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ দেয়া সম্ভব হচ্ছে। পঁয়তাল্লিশ লাখ সোলার প্যানেল ইতোমধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনে চলে এসেছে।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘যে সুযোগটুকু আমরা মানুষের জন্য করে দিতে পারছি। সে জন্য আমি জনগণের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। আমাদেরকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছিলেন বলেই আমরা আজকে আপনাদের সেবা করার সুযোগ পেয়েছি। আর সুযোগ পেয়েছি বলেই আজকে এই উন্নয়ন আমরা করতে পারছি এবং এর ফলে মানুষ গ্রামে বসে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে। কেউ যদি কাজ করে খেতে চায় সে সুযোগটা তারা পাচ্ছে সেই সুযোগটা আমরা সৃষ্টি করেছি এবং সেটা একেবারে তৃণমূল পর্যায়েই আমরা করে দিচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী বিদ্যুৎ ব্যবহারে সবাইকে সাশ্রয়ী হবার পরামর্শ দেন- বিদ্যুৎ উৎপাদনে যে ব্যয় হয় তার চেয়ে অনেক কম দামে আমরা বিদ্যুৎ দিচ্ছি তাই সবাইকে এই বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হতে হবে। বিদ্যুতের যেন কোন অপচায় না হয়।’
কর্মসম্পাদন সূচকে বিদ্যুত বিভাগের প্রথম হওয়ার এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারলেই দুই হাজার এক চল্লিশ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত পথে পৌছে যাবে উন্নত সমৃদ্ধ দেশের কাতারে এ কথা বলা যায় নিঃসন্দেহে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)