চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

কৃষিতে নজর রাখা এখন আরও জরুরি

করোনা ভাইরাস ইতিমধ্যেই বাংলাদেশকে বদলে দিয়েছে, বিশ্বকেও বদলে দিয়েছে। আমরা অনেক ধরনের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করছি। সামনে কী ঘটতে চলেছে, তার কিছু পূর্বাভাস মিলছে। তবে আরও কী কী ঘটতে পারে এবং তার মধ্যে ‘মহাবিপর্যয়’ কতটা সেটা একেবারেই অজানা। আমাদের অনেকেই হাসপাতালের এক হাজার টাকা দামের পর্দা কিনতে ব্যয় দেখাতে পারি লাখ টাকা, অপ্রয়োজনীয় মেডিকেল সরঞ্জাম কিনে খোলা আকাশের নিচে ফেলে রেখে নষ্ট করতে পারি। কিন্তু ভেন্টিলেশনের সরঞ্জাম সময়মতো সংগ্রহে উদ্যোগী হতে পারি না। এ ধরনের ব্যর্থতা কেবল যে বাংলাদেশেই, সেটা বলা যাবে না। যুক্তরাষ্ট্র তো দশকের পর দশক ধরে দাবি করে চলেছে যে, তারা বিশ্বের একক সামরিক ও অর্থনৈতিক পরাশক্তি। বিজ্ঞানে অনেক এগিয়ে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাতে অন্য দেশগুলোর চেয়ে ঢের এগিয়ে। তাদের বুদ্ধির তুলনা নেই। পারমাণবিক ও জীবাণু অস্ত্র উদ্ভাবন ও তৈরিতে তারা অঢেল অর্থ ব্যয় করছে। কিন্তু এখন নিউইয়র্কের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ বলছে চিকিৎসার অপরিচার্য সরঞ্জাম নেই, চিকিৎসক-নার্সদের সুরক্ষার ব্যবস্থা নেই। মানুষ মারার জন্য কত ধরনের গবেষণা চালাচ্ছে অনেক দেশ, কিন্তু মানুষ বাঁচানোর প্রশ্ন যখন সামনে তখন কত ধরনের অজুহাত!

বাংলাদেশের অর্থনীতির দুটি গুরুত্বপূর্ণ খাত তৈরি পোশাক শিল্প ও জনশক্তি রফতানি। দুটি খাতই বড় ধরনের সমস্যায় পড়তে পারে, এমন শঙ্কা প্রবল। বিশেষজ্ঞ-অর্থনীতিবিদরা একক পণ্যে নির্ভরতার বিপদ নিয়ে সতর্কবার্তা অনেক বছর ধরেই দিচ্ছিলেন। যদি পোশাক রফতানি অনেক কমে যায়? যদি সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, মালয়েশিয়া থেকে দলে দলে বাংলাদেশীরা ঘরে ফিরতে শুরু করে? তবে আমরা চাইলেই সঙ্কট থেকে পরিত্রাণ মেলে না। একটি সমস্যা তুলে ধরা খুব সহজ, কিন্তু সমাধান তত সহজ না হতে পারে।

যদি নিজেদের বদলে ফেলার মতো কিছু কাজ আমরা করতে পারি, সঙ্কটের মধ্যেও সম্ভাবনা বের করা যায়। যেমন, লকডাউনের সময় ঘরে বসে কাজের জন্য অপরিহার্য হচ্ছে আধুনিক তথ্য প্রযুক্তি। আমরা এ খাতের প্রতি নজর বাড়াতে পারি। চিকিৎসকদের পোশাক উৎপাদনের কাজ যদি সফলভাবে করা যায় তাহলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে রফতানিও করা সম্ভব। এ ধরনের আরও কিছু সুযোগ হয়ত মিলে যাবে।

বাংলাদেশে বড় ভরসার স্থল কৃষি। জিডিপিতে কৃষির হিস্যা ১১-১২ শতাংশ। কিন্তু এই খাত আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা দেয়, কর্মসংস্থানের ৪০ শতাংশের বেশি নিশ্চিত করে। অর্থনীতিতে যত সঙ্কট আসুক, চাল-সবজি-মাছের জোগান নিশ্চিত থাকলে আমরা কিছুটা হলেও স্বস্তিতে থাকব। এ কারণে সরকারের কাছে অনুরোধ, কৃষির প্রতি সর্বোচ্চ মনোযোগ প্রদান করুন। এখন বোরো মৌসুম চলছে। আমি গত কয়েকদিনে দিনে দেশের অন্তত একশ’ স্থানে ফোন করে খবর নিয়েছি সবুজ ধানের গাছ ছেয়ে ফেলেছে গোটা দেশ। সর্বোচ্চ সবুজ গালিচা বিছিয়ে আছে যেন। কয়েকদিন পর এ গালিচা হয়ে উঠবে স্বর্ণাভ। কয়েকদিন আগে অনেক স্থানে বৃষ্টি হয়েছে। তাতে সেচের পানি কিছুটা হলেও কম লেগেছে। কোথাও কেউ সার বা কীটনাশকের সমস্যার কথা বলেনি। এটা খুব ভাল দিক। সরকার চাইলেই সেচ কাজের বিদ্যুৎ বিল মওকুফ করে দিতে পারে। কৃষি খাতে ঋণের জোগান বাড়ানো সম্ভব। সুদের হার কমিয়ে দিলে যে ক্ষতি হবে, সেটা বাড়তি ফসল মিললে পুষিয়ে যাবে। এ সব পদক্ষেপ কৃষকের দুশ্চিন্তা কমাবে। বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখাও সহজ হবে।

বাংলাদেশে প্রতি বছর যে ধান উৎপন্ন হয় তার অর্ধেকের বেশি মেলে বোরো মৌসুমে। লকডাউন, আইসোলেশন বা এ ধরনের যে সব ব্যবস্থা তা ফসলের মাঠে খুব প্রভাব ফেলবে না। কৃষকরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন থেকে কাজ করতে অভ্যস্ত। সরকারকে কেবল এটা নিশ্চিত করতে হবে যে কেউ যেন টাকার অভাবে সার কেনা বা সেচের পানি দেওয়া থেকে বঞ্চিত না হয়। দোকানে গিয়ে সার বা ডিজেল না পেয়ে কাউকে যেন ফিরে আসতে না হয়। সার উৎপাদনের কারখানায় যেন কোনো ধরনের সমস্যা নয়, দেশের সর্বত্র বিতরণের ব্যবস্থা যেন ভেঙে না পড়ে তার প্রতিও নজর চাই।

২০১২-১৩ সালে বাংলাদেশে বোরো চাল উৎপন্ন হয়েছিল ১ কোটি ৮৭ লাখ টন। পরের তিনটি বছর উৎপাদন ১ কোটি ৯০ লাখ টনের আশপাশে থাকে। ২০১৭ সালে (প্রবল বন্যায় হাওরে ফসল ভেসে যাওয়ার বছর) গোটা দেশে বোরো চাল উৎপাদন হয় ১ কোটি ৮০ লাখ টন। পরের বছর বন্যা হয়নি। ফের উৎপাদন বাড়ে ১ কোটি ৯৫ লাখ টন।

২০১২-১৩ অর্থ বছরে দেশে তিন মৌসুমে মোট চাল উৎপন্ন হয়েছিল ৩ কোটি ৩৮ লাখ টন। পরের তিন বছর উৎপাদন ছিল যথাক্রমে ৩ কোটি ৪৩ লাখ টন, ৩ কোটি ৪৭ লাখ টন ও ৩ কোটি ৪৭ লাখ টন। পরের বছর অর্থাৎ হাওরে প্রবল বন্যার বছরে উৎপাদন কম হয় ৩ কোটি ৩৮ লাখ টন। ২০১৭-১৮ সালে চাল উৎপাদন বাড়ে ৩ কোটি ৬২ লাখ টন।

২০১৬-১৭ অর্থ বছরে বাংলাদেশে চাল, গম ও ভুট্টা মিলিয়ে মোট খাদ্য শস্য উৎপন্ন হয়েছিল ৩ কোটি ৮৬ লাখ টন। পরের বছর এ তিন ধরনের শস্য উৎপন্ন হয় ৪ কোটি ১৩ লাখ টন।

ফসলের সামান্য ক্ষতি হলেও তা থেকে ফায়দা লুটতে তৎপর হয়ে ওঠে অসাধু ব্যবসায়ীরা। তারা ‘নাই, নাই’ রব তোলে। এর প্রভাব পড়ে চালের বাজারে। ২০১৭ সালে চাল আমদানির ওপর ২৮ শতাংশ শুল্ক-কর ধার্য ছিল। কিন্তু হাওরে ধান উৎপাদন বিঘ্নিত হওয়ায় ঘাটতি পুষিয়ে নিতে এ হার কমিয়ে করা হয় মাত্র ২ শতাংশ। ব্যবসায়ীরা এ সুযোগে আমদানি বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু তার সুফল ক্রেতাদের দেওয়া হয়নি। ব্যবসায়ীদের মুনাফা বাড়ে। মানুষের দুর্ভোগ বাড়ে। সে সময়ের বাণিজ্যমন্ত্রী বাজার নিয়ে ফাটকা খেলার দায়ে কুষ্টিয়ার এক চাল ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু কুষ্টিয়ার সাংবাদিকরা জানায়, ওই ব্যবসায়ী ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় অনেক নেতার সঙ্গে রাজনৈতিক মঞ্চে বসে আছেন।

হাওরে সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টন খাদ্য ঘাটতি হয়েছে। পরের আউশ ও আমন মৌসুমে এ ঘাটতি পূরণের সুযোগ ছিল। কিন্তু বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি।

করোনা-বিপদের সময়ে বোরো ধান উৎপাদন যেন সামান্যতমও বিঘ্নিত না হয়, সেটা নিশ্চিত করা চাই। রফতানি বাণিজ্য ও প্রবাসে কর্মসংস্থানের মতো খাতে এমনকি স্বল্প মাত্রার ঝুঁকির সঙ্গে যদি বোরো ধান উৎপাদনে ঘাটতি যুক্ত হয়, তাহলে সর্বনাশের শেষ থাকবে না।

২০১৭ সালের মার্চ মাসের শেষ দিকে অকাল বন্যায় হাওরে ধানের উৎপাদন কম হয়েছিল। এবারে তেমনটি যদি ঘটে? করোনা লকডাউন নিয়ে ব্যস্ত থাকার সময় এ দিকটি যেন না ভুলি।

খরা মৌসুমে ৪০ লাখ টনের মতো ভুট্টা উৎপন্ন হয়। ২০ লাখ টনের মতো গম মেলে। এ দিকে মনোযোগ আছে তো?

মিঠা পানির মাছ এবং শীত-বর্ষার সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ সাফল্য দেখিয়ে চলেছে। এ দিকটাতেও নজর চাই। রফতানি বাণিজ্য বা প্রবাসে কর্মসংস্থানের সবটা বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে নেই। সর্বোচ্চ কূটনৈতিক দক্ষতা প্রদর্শন করলেও সাফল্য নিশ্চিত, সেটা বলা যাবে না। কিন্তু কৃষির প্রায় সবটাই আমাদের হাতে। সময়ের কাজ সময়ে করতে না পারার কারণে আমরা যেন নিজেদের বিপদ নিজেরা না বাড়াই।

মনে রাখুন, করোনার কারণে বিশ্বের অনেক কিছুই আর আগের মতো থাকবে না। আমরা গত বছর ডেঙ্গু মোকাবেলা করেছি। এটা স্থানীয় সমস্যা। মশারি ব্যবহার ও পরিচ্ছন্ন থাকলেই অনেকটা নিরাপদ। কিন্তু নিশ্চিত থাকুন, করোনা-পরবর্তী বিশ্ব একেবারেই অন্যরকম হবে। তবে যেমন ‘নতুন বিশ্ব’ সামনে আসুক, চাল-ডাল-মাছ-সবজির-তেলের চাহিদা থাকবেই। আমাদের সৌভাগ্য, বাংলাদেশের কৃষি এ ক্ষেত্রে শক্ত জমিনের ওপর দাঁড়িয়ে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)