রাজধানীর এয়ারপোর্ট রোডে সৌন্দর্যবর্ধনের অংশ হিসেবে বনসাই লাগানোর বিরোধী বেশিরভাগ পরিবেশবিদ। তারা বলছেন, দেশীয় ছায়াবৃক্ষের পরিবর্তে এই গাছ একদিকে যেমন এয়ারপোর্ট রোডের সৌন্দর্য নষ্ট করছে, তেমনি ভবিষ্যতে পরিবেশের জন্যও তা ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনবে।
তিন কোটি টাকা খরচে চীন থেকে আনা হচ্ছে বনসাই। এয়ারপোর্ট রোডের ছয় কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বনসাই লাগানোর পরিকল্পনা নিয়ে অালোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠেছে। মানুষেরে মধ্যে আছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ।
বনসাই না লাগিয়ে কৃষ্ণচূড়া, জারুল, আম, নিম বা এ ধরনের গাছ লাগানো হলে পরিবেশের জন্য উপকারি হতো বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। অনেকে আবার সৌন্দর্যবর্ধনে বিদেশি গাছ দেশীয় আবহাওয়া তথা পরিচর্যার অভাবে বেশিদিন টিকবে না বলেও মনে করেন।
ভিনাইল ওয়ার্ল্ড গ্রুপ নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ৯০ কোটি টাকা খরচে র্যাডিসন হোটেলের উত্তর পাশ থেকে এয়ারপোর্ট চত্বরের আগে পর্যন্ত সৌন্দর্যবর্ধনের যে কাজ করছে তার অংশ হিসেবেই লাগানো হচ্ছে বনসাই। এর সার্বিক তত্বাবধানে রয়েছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর।
দেশীয় গাছ কেটে বনসাই লাগানোর বিষয়ে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের কাছে প্রশ্ন রাখা হলে, চ্যানেল আই অনলাইনের কাছে তারা দাবি করেন, এ প্রকল্প বাস্তবায়নে এখন পর্যন্ত একটি গাছও কাটা হয়নি। সড়কের সৌন্দর্যবর্ধনে বনসাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেও বলে তারা মনে করছেন।
তবে, পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারি পরিচালক সাইফুল ইসলাম জানিয়েছেন, এ বিষয়ে তাদের কাছ থেকে কোন অনুমতি নেয়নি সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর। বিষয়টিকে তারা মোটেও ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন না বলে জানিয়েছেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এম এম আমানত উল্লাহ খান সৌন্দর্যবর্ধনের নামে বনসাই লাগানোর বিরোধিতা করে বলেন: দেশি গাছ বাদ দিয়ে এই বিদেশি বনসাই লাগানোর প্রকল্পকে আমার কাছে অদ্ভূত মনে হয়েছে।
‘এরকম একটা অদ্ভুত চিন্তা কার মাথা থেকে কিভাবে এলো তা আমার বোধগম্য হচ্ছে না।’
তিনি বলেন: বনসাই সাধারণত ঘরে থাকে, বাগানে থাকে। সেখানেই এদের দেখতে ভাল লাগে। পৃথিবীর অনেক দেশ ঘুরেছি। কিন্তু কোথাও এমন রাস্তার ধারে অদ্ভূত বনসাই দেখেছি বলে মনে করতে পারছি না।
তার মতে, বনসাই লাগানোর ফলে নগরবাসী ছায়া থেকে বঞ্চিত হবে, কমে যাবে পাখির আনাগোনা। ওই দিকটা মরুভূমির মতো হয়ে যাবে। বিভিন্ন ঋতুতে এয়ারপোর্টের দু’পাশে ফুলের যে সমারোহ দেখা যেতো তা থেকে বঞ্চিত হবে নগরবাসী।
বনসাই প্রকল্প সৌন্দর্য বৃদ্ধিকারক নয়, বরং হানিকারক উল্লেখ করে তিনি বলেন, আগেকার দিনে রাজা-বাদশাহরা পথের ধারে বড় বড় গাছ লাগাতো পথিকের শ্রান্তির জন্য। দীর্ঘ পথ হেঁটে পথিকরা যাতে বিশ্রাম নিতে পারে। আর এখন সেসব ভুলে বনসাই লাগানো হচ্ছে। এর পেছনে আবার ব্যয় করা হয়েছে তিন কোটি টাকা!
‘আমাদের এতো সুন্দর সুন্দর দেশি গাছ থাকতে সেগুলো বাদ দিয়ে বনসাই কেন?’ প্রশ্ন রাখেন অধ্যাপক ড. এ এম এম আমানত উল্লাহ খান।
বনসাই বেশিদিন বাঁচতে পারবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, বনসাই এর জন্য প্রয়োজন অনেক পরিচর্যা। ‘এতো পরিচর্যা সম্ভব বলে আমার মনে হয় না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. দিদার উল আলম অবশ্য ভিন্ন কথা বলছেন।
তিনি বলেন: সবুজায়ন সবসময়ই একটা ভাল বিষয়। সেক্ষেত্রে যে বনসাই লাগানো হচ্ছে তার ফলে এয়ারপোর্ট ও এর আশপাশের এলাকায় এক নৈসর্গিক পরিবেশ সৃষ্টি হবে। এগুলোকে যদি পরিচর্যার মাধ্যমে ঠিকঠাক রাখা যায় তাহলে তা সুফল বয়ে আনবে।
তার মতে, বনসাই লাগানোর ফলে এয়ারপোর্ট সংলগ্ন এলাকায় অক্সিজেন বাড়বে। তবে প্রকল্প বাস্তবায়নে এক সঙ্গে সব গাছ না কেটে ধীরে ধীরে কিছু গাছ কেটে-লাগিয়ে এভাবে একটা ধারাবাহিকতা মেনে গাছ লাগানোর পরামর্শ দিয়েছেন এ বিশেষজ্ঞ।’
পরিবেশ তথা মানবস্বাস্থ্যের ক্ষতির বিষয়ে তিনি বলেন, কিছু কিছু গাছ অাছে মানুষের জন্য এবং পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। সেই ধরনের গাছ লাগানো হলে বিরূপ প্রভাব পড়বে।
পরিবেশ বাঁচাও অন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: সৌন্দর্যবর্ধনে বনসাই প্রকল্প কোনই সুফল বয়ে আনবে না।
‘পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য আমাদের দেশীয় গাছ লাগাতে হবে,’ উল্রেখ করে তিনি বলেন: গাছপালা ভূমিক্ষয় রোধে সহায়তা করে। আবার ফলজ বৃক্ষ থেকে আমরা বিভিন্নরকম ফলমূল পাই। এর অর্থনৈতিক মূল্যও রয়েছে।
‘বনসাই থেকে ফল পাবো নো, ছায়া পাবো না, পাবো না পরিমিত অক্সিজেন। আমাদের দেশীয় গাছ দেখতে কত সুন্দর! সেখানে এই কিম্ভূত আকৃতির বনসাই বড়ই বেমানান।’
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সবুজ উদ্দীন খান জানান, সৌন্দর্যবর্ধনের এ কাজে সরকারের একটি টাকাও খরচ হচ্ছে না ।ভিনাইল ওয়ার্ল্ড নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এর যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করছে।
তিনি জানান: এ পর্যন্ত চীন থেকে ৭৬ টি বনসাই আনা হয়েছে। প্রয়োজন বুঝে বিভিন্ন দেশ থেকে আনা হবে আরও বনসাই। তবে ফাইকাস জাতীয় বনসাই দেখতে বেশি সুন্দর হওয়ায় এখন পর্যন্ত যা লাগানো হয়েছে তার সবই ফাইকাস। এ বনসাইগুলোর একেকটির দাম দেড় থেকে ২ লাখ টাকা। এয়ারপোর্ট এলাকার সৌন্দর্যবর্ধনে এ গাছগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে দাকি করেন এ কর্মকর্তা।
বিভিন্ন মাধ্যমে সমালোচনার মুখে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন অবশ্য জানিয়েছে, এ প্রকল্পের সঙ্গে তাদের কোন সম্পর্ক নেই।