বিষয়টা নিয়ে কথা বলতেও এখন আর ইচ্ছে হয় না। কারণ কে শোনে কার কথা। কার জন্য এত প্রতিবাদ, লেখালেখি, মানববন্ধন, হাহাকার? কে আমলে নেয় এসব? যাদের কানে পৌঁছানোর কথা এই কান্না, তারা কি আদৌ এসব শোনে? তাদের কান অবধি কি পৌঁছায় এই আর্তচিৎকার?
এটি এখন প্রতিদিনকার সংবাদ শিরোনাম। অমুক জায়গায় সড়ক দুর্ঘটনায় তিনজনের প্রাণহানি; বাস-ট্রাক সংঘর্ষ; বেপরোয়া বাসের চাপায় প্রাণ গেলো অন্তঃসত্ত্বা নারীর; ঘাতক বাস কেড়ে নিলো বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর জীবন; মহাসড়কে নসিমন উল্টে নিহত ৬; নৈশকোচ খাদে পড়ে অন্তত ৮ জনের প্রাণহানি; এরকম সংবাদ শিরোনামের সংখ্যা গণনা করে কুলানো যাবে না।
গত এক বছরের সংবাদপত্র বিশ্লেষণ করলে সম্ভবত একটি দিনের পত্রিকাও পাওয়া যাবে না যেখানে এরকম শিরোনাম নেই। আরও মর্মান্তিক শিরোনামও আমাদের দেখতে হয়, যেমন সম্প্রতি ময়মনসিংহের একটি ঘটনার শিরোনাম ছিল: বাসের চাকায় পিষ্ট হচ্ছেন মা, বাস ঠেলছেন ছেলে। এমন নির্মম, নৃশংস, বীভৎস, ভয়ানক সংবাদ শিরোনাম আমাদের লিখতে হয় প্রতিদিন। এর বিরুদ্ধে সম্পাদকীয়, নিবন্ধ, সেমিনারে প্রবন্ধ, মানববন্ধন বা বিক্ষোভ সমাবেশে জ্বালাময়ী বক্তৃত কী আসে যায়? একটি দিনও কি আমরা সড়ক দুর্ঘটনামুক্ত থাকতে পারছি? বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক থেকে গৃহকর্মী, কে নিরাপদ এই সড়কে?
এই নিবন্ধটি যখন লিখছি, তখন রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালের বিছানায় কাৎরাচ্ছেন অগ্রজ সাংবাদিক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজার গৃহকর্মী রোজিনা। গত ২০ এপ্রিল রাতে প্রথমে তিনি তার ফেসবুক ওয়ালে খবরটি জানান। এই নিবন্ধ যখন লিখছি তার কয়েক ঘণ্টা আগেই রাজধানীতে দুটি বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে প্রাণ গেছে খোদ বাস চালকের। আহত অন্তত ৮জন। এই নিবন্ধ যেদিন লিখছি, তার দিন দুয়েক আগেই যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, রাজধানীতে চলাচলকারী ৮৭ ভাগ বাস-মিনিবাসই কোনো ধরনের ট্রাফিক আইন মানে না।
একটি দেশের রাজধানীকে বলা হয় সে দেশের আয়না। বিদেশী পর্যটকেরা প্রথমে এই শহরেই পা রাখেন। ফলে দেশের অন্য প্রান্তের অবস্থা যাই হোক, রাজধানীটা অন্তত ঝা চকচকে এবং সুশৃঙ্খল রাখার চেষ্টা করা হয়।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমাদের রাজধানীটাই সবচেয়ে বেশি বিশৃঙ্খল, এলোমেলো, অনিয়ম আর বেপরোয়া মানুষের দখলে। এখানে ফুটপাথে একটু শান্তিমতো হাঁটার উপায় নেই। রাস্তায় বেরোলে প্রাণ নিয়ে কিংবা সুস্থ শরীরে বাসায় ফেরার নিশ্চয়তা নেই। ধূলা, দূষণ আর ভয়ঙ্কর শব্দের যন্ত্রণায় অস্থির এই মহানগরীর নাগরিকেরা। বলা হয়, এটি পৃথিবীর বসবাসের অযোগ্য শহরগুলোর শীর্ষে। ফলে প্রতিদিনই এই মহানগরী খবরের শিরোনাম এবং সঙ্গত কারণে তার অধিকাংশই নেতিবাচক সংবাদ।
যেসব কারণে এই কথিত তিলোত্তমা শহরটিকে বসবাসের অযোগ্য বলা হয়, তার মধ্যে নিঃসন্দেহে একটি বড় কারণ সড়কের অব্যবস্থাপনা। পিক আওয়ারে এই মহানগরীর রাস্তায় বেরোলে এটা বোঝার উপায় থাকে না যে, এখানে কোনো ট্রাফিক সিস্টেম কাজ করছে। এই একুশ শতকেও, যখন আমরা উন্নয়নশীল রাষ্ট্র হবার যোগ্যতা অর্জন করেছি বলে উৎসব পালন করি, তখনও শহরের প্রাণকেন্দ্রে আমাদের ট্রাফিক পুলিশগণ দড়ি দিয়ে রাস্তা বন্ধ করে গাড়ির গতিরোধ করেন। ট্রাফিক সিগন্যালে লাল-সবুজ বাতি জ্বললেও ট্রাফিক পুলিশদের লাঠি এবং হাতের ইশারায় এমনকি রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে গাড়ির চাকা থামাতে হয়। এই হলো আমাদের খোদ রাজধানীর সড়কের চিত্র।
যারা এই শহরে নিয়মিত পাবলিক বাসে যাতায়াত করেন, তারা জানেন একই রুটের বিভিন্ন কোম্পানির, এমনকি একই কোম্পানির বাসগুলোও কী ভয়াবহ প্রতিযোগিতায় নামে! ওভারটেক করা, সাইড না দেয়া এবং ইচ্ছা করে লাগিয়ে দেয়া এবং ঝনঝন করে জানালার কাঁচ ভেঙে অসভ্যের মতো ছুটে চলার দৃশ্য এই শহরের মানুষের এখন গা সওয়া হয়ে গেছে। বাসের ভেতরে বসে যাত্রীরা প্রতিবাদ করলেও চালক, হেলপার আর কন্ডাকটরের রুঢ় আচরণের তিক্ত অভিজ্ঞতার শিকার ভদ্রলোকেরা এসব মুখ বুজে সহ্য করেন। এবং ভাবেন, কিছু পয়সা জমিয়ে কিংবা গ্রামের কিছু জমিজমা বিক্রি আর ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে একটা ছোট প্রাইভেটকার কিনে ফেলবেন। যেহেতু এত বছরেও এই শহরে কোনো ট্রাফিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি এবং পাবলিক পরিবহন বলতে এখানে ওই অর্থে যা আছে সেখানে বস্তুত একধরনের নৈরাজ্যই বিদ্যমান, ফলে মোটামুটি স্বচ্ছল মানুষেরাই টাকা এধার-ওধার করে একটা গাড়ি কিনে ফেলেন এবং সড়কের যানজট বাড়িয়ে দেন।
যেখানে একটি বাসে ৫০-৬০জন লোক একসাথে যেতে পারেন, সেখানে একটি প্রাইভেট কারে বড়জোর দুজন চড়েন। তার মানে এই শহর থেকে যদি প্রাইভেটকার তুলে দেয়া যায় এবং নৈরাজ্যমুক্ত এবং ভদ্র ও মার্জিত রুচির লোকদের দ্বারা বাস-মিনিবাস চালু কর করা যায়, তাহলে এখানে ট্রাফিক জ্যাম কী জিনিস, মানুষ সেটি ভুলে যাবে ছয় মাসের মধ্যে। কিন্তু এটি কে করবে?
পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ এই মেগাসিটিতে দুজন মেয়র আছেন। মেয়র না থাকলেও সেই দায়িত্বে অন্য কেউ থাকেন। কিন্তু তাদের অসহায়ত্বের কথাও আমরা জানি এবং তারা নিজেরা সেটি প্রকাশ্যেই বলেন। কারণ এই শহরের অভিভাবকের সংখ্যা এত বেশি যে, কে কখন কোন কাজটি কোন ধান্দায় করেন, তা বোঝা মুশকিল। ফলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সমন্বয়হীনতা কী জিনিস এবং পরিণাম কত ভয়াবহ, তা প্রতিনিয়তই দেখতে হয় এই মহানগরীর দুই কোটি মানুষকে।
ফলে যখন এখানে রাজিবের হাত দুটি বাসের মধ্যে চাপা পড়ে বিমূর্ত চিত্রকলার মতো ঝুলে থাকে, যখন বেপরোয়া বাসের চাপায় গৃহকর্মীর পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, যখন উদ্ধত ট্রাকের ধাক্কায় ফুটপাথে দাঁড়িয়ে চা পানরত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর শরীর থেকে ধড় আলাদা হয়ে যায়, সেই ঘটনাগুলো সংবাদ শিরোনাম হয় এবং আমরা সেগুলো পড়তে থাকি, টেলিভিশনে দেখতে থাকি, এবং আহা উহু করতে থাকি। এই আহা উহুতেই আমাদের সান্ত্বনা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)