আদিম সাম্যবাদী সমাজ থেকে আজকের আধুনিক বুর্জোয়া সমাজ পর্যন্ত মানুষের অগ্রযাত্রার যে ইতিহাস তা কখনোই কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। প্রতিনিয়ত বিরুদ্ধ পরিবেশের সাথে লড়াই করে করে মানুষ নির্মাণ করে চলেছে সভ্যতার ইতিহাস। ইতিহাসের এই মহা যাত্রায় কেউ কেউ এমন অবদান রাখেন যা ইতিহাসকে ব্যাপক ভাবে আলোড়িত করে; মানুষের চিন্তা জগতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসে। এমনি একজন চিন্তাবিদ হলেন মহামতি কার্ল মার্ক্স। একাধারে যিনি দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ, সমাজ বিজ্ঞানী ও সমাজ বিপ্লবী হিসাবে পরিচিত।
শোষণ, বঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে মুক্ত মানবের মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন সংবেদনশীল মানুষ মাত্রই দেখে থাকেন। মার্ক্সের আগে অনেক ভাবুক, দার্শনিক সাম্যবাদী সমাজের চিন্তা করেছেন। গ্রিক দার্শনিক প্লেটো সাম্যবাদী সমাজ নির্মাণের একটি কাঠামো নির্দেশ করেছিলেন। একই ভাবে টমাস মূর সহ আরও অনেকেই সমতার সমাজ কল্পনা করেছেন। তারা ভাবনার ক্ষেত্রে আন্তরিক হলেও কাঙ্ক্ষিত ওই সমাজ নির্মাণের সুনির্দিষ্ট কোন তত্ত্ব বা পদ্ধতি নির্দেশ করতে পারেন নি। যা পেরেছেন কার্ল মার্ক্স। অন্যান্য দার্শনিক থেকে মার্ক্স এখানেই বিশিষ্ট। তিনিই প্রথম সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার দার্শনিক ভিত্তি নির্মাণ করেন। এটা করতে গিয়ে মার্ক্স সমকালীন অর্থনীতি, সমাজ বিজ্ঞান, দর্শন যেমন পড়েছেন তেমনি ধ্রুপদী অর্থনীতি, দর্শন, নৃবিজ্ঞান সহ মানব জ্ঞানের প্রায় সকল শাখায় ব্যাপক অধ্যয়ন করেছেন। এই ব্যাপক অধ্যয়ন ও শোষিত শ্রমজীবী মানুষের প্রতি গভীর মমতাই মার্ক্সকে বিপ্লবী দার্শনিকে পরিণত করে। এ যাবতকাল দার্শনিকরা জগতকে কেবল ব্যাখ্যা করে গেছেন কিন্তু জগতটা পাল্টানোর বাস্তব কোন উদ্যোগ নেননি। এই উপলব্ধি থেকেই মার্ক্স জগত পাল্টানোর বাস্তব ও সুনির্দিষ্ট দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক রূপরেখা তৈরি করতে মনোযোগী হন।
তরুণ বয়সেই মার্ক্স জার্মান দার্শনিক হেগেলের জীবন ও জগতকে ব্যাখ্যার দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির প্রতি আকৃষ্ট হন। তবে নিজের দার্শনিক পর্যবেক্ষণ দিয়ে খুব দ্রুতই তিনি হেগেলীয় দর্শনের সীমাবদ্ধতা আবিষ্কার করে দেখান হেগেলীয় দর্শন জগতকে দ্বান্দ্বিক ভাবে ব্যাখ্যা করলেও এর চূড়ান্ত গন্তব্য পরম এক ভাব, যা জগত ও জীবন বোঝার ক্ষেত্রে এক গোলক ধাঁধার সৃষ্টি করে। ফলে তিনি হেগেলের দ্বন্দ্ব তত্ত্ব গ্রহণ করলেও একে ভাববাদ থেকে মুক্ত করে এর সাথে বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি যুক্ত করে নতুন তত্ত্ব নির্মাণ করেন যা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ হিসাবে পরিচিত। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে মার্ক্স দেখালেন জগত ও জীবনের বিকাশ কখনো একরৈখিক বা সরল পথে হয় না। জগতের সব কিছুতেই রয়েছে বিপরীত ধর্মী কিন্তু পরস্পর সংঘর্ষ যুক্ত উপাদান। বিপরীত ধর্মী এই উপাদানের সংঘর্ষের ফলে বস্তুর ভিতরে ক্রমাগত পরিবর্তন হতে থাকে এবং ওই পরিবর্তন একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় পৌঁছলে বস্তুটির গুণগত পরিবর্তন হয়ে নতুন একটি বস্তুতে রুপান্তর ঘটে। এভাবেই জগতের সকল কিছু বিকশিত হয়ে চলেছে। মার্ক্স এই পদ্ধতি শুধু প্রকৃতির ক্ষেত্রেই নয় মানব সমাজ বিকাশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য বলে মনে করেন। আর এই পদ্ধতিতে সমাজের ইতিহাস পর্যালোচনা করতে গিয়ে তিনি ঐতিহাসিক বস্তুবাদ তত্ত্ব নির্মাণ করেন। এই তত্ত্বের আলোকে মার্ক্স দেখান মানব সমাজ আদিম সাম্যবাদী অবস্থা থেকে দ্বান্দ্বিক ভাবে বিকশিত হতে হতে দাস সমাজ, সামন্তবাদী সমাজ, পুঁজিবাদী সমাজ হয়ে আধুনিক সাম্যবাদী সমাজের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দাস সমাজ থেকে পুঁজিবাদী সমাজ এই প্রতিটি স্তরে পরস্পর বিরোধী দুটি শ্রেণী বিদ্যমান যারা ইচ্ছা নিরপেক্ষ ভাবে পরস্পর সংগ্রামে লিপ্ত থাকে। এই শ্রেণী সংগ্রামের ফলে সমাজের ভিতর পরিমাণ গত পরিবর্তন হতে হতে এক সময় গুণগত পরিবর্তন হয়। অর্থাৎ সমাজ বিপ্লব সংগঠিত হয় এবং নতুন এক সমাজ তৈরী হয়। এভাবেই মানব সমাজ আজকের এই পুঁজিবাদী স্তরে এসে উপনীত হয়েছে।
রক্ষণশীল সমাজ চিন্তাবিদরা এ পর্যন্ত প্রায়শই মার্ক্সের সাথে একমত পোষণ করলেও এরপর আর আগাতে চান না। তারা মনে করেন পুঁজিবাদ ইতিহাসের শেষ কথা। বিশেষ করে সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পর তারা ঘোষণা দিয়ে বলেছেন ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটে গেছে। কিন্তু সোভিয়েত রাশিয়াহীন আজকের পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থা কি মানুষকে মুক্তি দিতে পেরেছে? আজকে পুরো পৃথিবীর দিকে তাকালে দেখা যায় একদিকে মুষ্টিমেয় কিছু ধনকুবের পাহাড় সম সম্পত্তি কুক্ষিগত করে রেখেছে অপরদিকে কোটি কোটি নিরন্ন মানুষ সভ্যতার এই স্বর্ণ যুগে অনাহারে, অপুষ্টিতে ভুগে করুণ মৃত্যু বরণ করছে। পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থায় এটিই হওয়ার কথা। কার্ল মার্ক্স তার পুঁজি গ্রন্থ সহ অন্যান্য গ্রন্থে পুঁজিবাদী অর্থনীতির ব্যবচ্ছেদ করে এই কথাই বলেছেন শ্রমিকের শ্রম শোষণ ছাড়া পুঁজির বিকাশ, নিরাপত্তা ও মুনাফা বৃদ্ধি সম্ভব নয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতি অন্তর্গত ভাবেই মুনাফা নির্ভর আর মুনাফার একমাত্র উৎস শ্রম শোষণ। এটি কোন ব্যক্তির ইচ্ছা অনিচ্ছার ব্যাপার নয়। নেহায়েত ব্যবস্থা গত ব্যাপার। ফলে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রেখে শ্রমিক শ্রেণী তথা সমাজের ৯৯ ভাগ মানুষের মুক্তি সম্ভব নয়। এর বাস্তব উদাহরণ আমরা আজকের পৃথিবীতে প্রত্যক্ষ করছি। খোদ আমেরিকাতে অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট মুভমেন্ট সংগঠিত হয়েছে। যার একটি মূল শ্লোগান ছিল ১ভাগ বনাম আমরা ৯৯ ভাগ। সারা পৃথিবী জুড়ে আজ শোষিত বঞ্চিত ৯৯ ভাগ মানুষ পুঁজিবাদী অর্থনীতির যাঁতাকলে পিষ্ট। বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষও এর বাইরে নয়।
সর্বশেষ করোনা সংকট মোকাবেলায় পুঁজিবাদী বিশ্বের চরম ব্যর্থতা এটি প্রমাণ করে দিয়েছে মুনাফা তাড়িত পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্হা মানুষের সর্বাধিক কল্যাণ তথা সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে না। এখানেই কার্ল মার্ক্সের চিন্তা ও দর্শনের প্রাসঙ্গিকতা। মার্ক্স তার সারা জীবনের তত্ত্ব চর্চা ও বিপ্লবী সংগ্রামের মাধ্যমে এটিই বলতে চেয়েছেন মানুষ অদ্যাবধি যা কিছু অর্জন করেছে তার সবটুকু অর্জিত হয়েছে মানুষের যুথবদ্ধ সৃজনশীল শ্রমের মাধ্যমে। কিন্তু আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজ এটি অস্বীকার করে মানুষের ওই সৃজনশীল শ্রমের উপর পুঁজির একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে অল্প কিছু পুঁজিপতির মুনাফার যুপকাষ্ঠে বলি দিচ্ছে পুরো মানব জাতিকে। পুঁজিবাদের এই প্রলয়ংকরী ধ্বংস লীলা থেকে মানব সভ্যতাকে রক্ষা করতে হলে আমাদের মহামতি কার্ল মার্ক্সের জীবন, দর্শন ও তাঁর নির্দেশিত সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদের পথেই অগ্রসর হতে হবে।
আজ মহান এই বিপ্লবী সমাজ চিন্তাবিদের জন্মদিন। গভীর শ্রদ্ধা ও বিপ্লবী সালাম জানাই তাঁর জীবন ও কর্মের প্রতি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)