অতি সম্প্রতি ভারত-বাংলাদেশের মিডিয়ায় আলোচিত ঘটনা ছিল অনুপ চেটিয়াকে বাংলাদেশ থেকে ভারতে হস্তান্তর। আসামের স্বাধীনতাকামী সংগঠন ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম (উলফা)-এর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক অনুপ চেটিয়া। ভারতীয় শাসকগোষ্ঠি ও মিডিয়া যার নামের আগে বিচ্ছিন্নতাবাদী, সন্ত্রাসী ইত্যাদি বিশেষণ যোগ করে থাকে।
১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে ঢাকার মোহাম্মদপুরে গ্রেফতার হওয়া অনুপ চেটিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা ৩টি মামলায় বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডও হয়। যার মেয়াদ ২০০৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারী শেষ হয়। কিন্তু তিনি জেলে আটকে থাকেন অন্তত: ১৮ বছর। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার গত ১১ নভেম্বর অনুপ চেটিয়াকে ভারতের বিজেপি সরকারের কাছে হস্তান্তর করে।
অনুপ চেটিয়াকে হস্তান্তরের প্রবল চাপ থাকলেও অতীতে কোনো সরকার এ উদ্যোগ নিতে পারেনি। বর্তমান সরকার শেষ পর্যন্ত তাকে ভারত সরকারের হাতে তুলে দিল। কথিত আছে ভারত সরকারের হাতে আটক বাংলাদেশী কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসী ও অপরাধীকে এদেশে ফিরিয়ে আনার লক্ষে বন্দী বিনিময় চুক্তির অংশ হিসাবে অনুপ চেটিয়ার মতো একজন রাজনৈতিক নেতাকে সেদেশে হস্তান্তর করা হয়। যদিও বাংলাদেশের সরকার সেটা অস্বীকার করে।
বাংলাদেশের জেলে দীর্ঘদিন আটকে থাকা যে ব্যক্তিকে নিয়ে ভারত সরকারের ঘুম হারাম, সেই অনুপ চেটিয়া লোকটি আসলে কেমন?
অনুপ চেটিয়াকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামছুন্নাহার হলে পুলিশি নির্যাতনের ঘটনায় প্রতিবাদ আন্দোলন চলাকালীন ২০০২ সালের ৯ সেপ্টেম্বর বিভিন্ন প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের নেতা কর্মীদের সাথে আমিও গ্রেফতার হই। ছাত্র ফেডারেশনের তৎকালীন নেতা ফিরোজ আহমেদ, এম.জে ফেরদৌস, বিপ্লবী ছাত্র সংঘের মাসুদসহ আমরা প্রায় ১০ জন তখন একই ঘটনায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে।
ডিটেনশন দিয়ে আমাদেরকে ৯০ নম্বর সেলে রাখা হয়। বন্দী জীবনে মাস দুয়েকের মধ্যেই বাইরে অপারেশন ক্লিনহার্ট শুরু হয়। জেলখানার ভিতর তিল ধারনের জায়গা খালি নেই। ৯০ নম্বর সেলের অনেকটা মুখোমুখি ডিভিশন (২৬ নম্বর সেল)। অনুপ চেটিয়া তখন সেখানে। তিনি যখন সেলের বাইরে বের হন বা হাঁটাহাঁটি করেন তখন আশেপাশে সব বিল্ডিং থেকেই বন্দীরা উৎসুক দৃষ্টিতে তাকে দেখেন।
সম্ভবতঃ নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে কোনো একদিন আমাদের সেলে ডিউটিরত একজন জেল পুলিশের সহায়তায় অনুপ চেটিয়ার কাছে একটি চিরকুট পাঠিয়ে দেখা করার ইচ্ছা পোষণ করি। কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি সেলের গেটের বাইরে এসে আমাকে খোঁজ করেন এবং দায়িত্বরত জেল পুলিশ কর্মকর্তার অনুমতি সাপেক্ষে আমাকে ডিভিশন সেলে উনার কক্ষে নিয়ে যান। শুরু হলো কথাবার্তা।
বললাম, ‘দাদা আপনার মুক্তির জন্য আমরা আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে বিক্ষোভ করেছি, পত্রিকায় প্রতিবাদ বিবৃতি দিয়েছি।’
‘অনেক ধন্যবাদ। কি খাবেন?’
‘দুই মাস ধরে চা খাওয়া হয় না …।’
সাথে সাথেই তিনি এক কয়েদিকে নির্দেশ দিলে ফ্লাস্ক ভর্তি চা এলো। চা খেতে খেতে আলোচনা। উলফার প্রসঙ্গ টেনে আমার অনেক প্রশ্ন! ‘ভারতীয় শাসক গোষ্ঠির নিপীড়ন থেকে রক্ষার জন্য আপনারা আসামকে স্বাধীন করতে চান। কিন্তু তারপর যে আপনার জনগণকে নিপীড়ন করবে না, তার গ্যারান্টি কি?’
আমি প্রসঙ্গক্রমেই ৭১’এ আমাদের দেশের উদাহরণ দিলাম। ‘পাকিস্তানের শোষণ-নিপীড়ন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এদেশে যারা স্বাধীনতার কথা বলেছিল, আজ স্বাধীন দেশে তারাই একই কায়দায় দমন নিপীড়ন করছে। তাদের সাথে আপনার উলফার পার্থক্য কি?’
এ বিষয়টি তিনি বিভিন্নভাবে বুঝানোর চেষ্টা করেছেন। তার এ চেষ্টার মাঝে বিনয়, আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি ছিল না। প্রসঙ্গক্রমে আমার প্রশ্ন: ‘নেপাল-ভারতসহ বিভিন্ন দেশের মাওবাদী কমিউনিষ্ট আন্দোলনকে কিভাবে দেখেন?’ তার জবাব, ‘সে সব ব্যাপারে আমাদের আরো জানতে হবে। তবে এ মুহূর্তে সঠিক বলতে পারছি না।’
তখন নেপালের মাওবাদীদের আন্দোলন বিশ্বব্যাপী বেশ আলোড়ন তুলছিল। ঐ বছর ১৯ ডিসেম্বর আমার কারামুক্তির পূর্ব পর্যন্ত বেশ কয়েকবার তার সাথে অনেক বিষয়ে আলোচনা হয়। কমিউনিষ্ট রাজনীতি সংক্রান্ত আমার জানা বিভিন্ন বইয়ের তালিকাও তিনি আমার কাছ থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নেন। এ সময়ে অনেক বৈষয়িক ব্যপারে আমাকে তিনি সাধ্যমতো সহযোগিতা করেন।
অনুপ চেটিয়া একজন মর্যাদাবান ব্যক্তি। ভিন্ন দেশের নাগরিক হলেও তিনি আমাদের জেলখানায় অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন মানুষ ছিলেন। নিয়মিত পড়াশুনা, শরীর চর্চা, আশেপাশের বন্দীদের ভালো-মন্দ খোঁজ রাখা- এগুলো তার প্রাত্যহিক রুটিনের অংশ। সবার সাথেই তিনি সহজে মিশে যেতেন। সবার কাছেই তিনি ছিলেন প্রিয় মানুষ। জেলখানায় দেশী-বিদেশী গুরুত্বপূর্ণ অনেক বন্দী থাকেন। তবে দল-মত, উঁচু-নিচু, কারাবন্দী-কারারক্ষী নির্বিশেষে সবাইকে জয় করতে পারার ক্ষমতা বোধহয় সবার থাকে না। যেমনটা ছিল অনুপ চেটিয়ার। আর এ ধরনের ব্যক্তি আর যে-ই হোন, কোনো সন্ত্রাসী নন।
উলফার সাথে ভারত সরকার বেশ কয়েক দফা শান্তি আলোচনায় বসেছে। সাম্প্রতিক বৈঠকে উক্ত আলোচনায় উলফার আত্মসমর্পণকারী নেতৃত্বদের পক্ষ থেকে তাদের সাধারণ সম্পাদক অনুপ চেটিয়াকে যুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছে। আমার বিশ্বাস কোনো কৌশলগত কারণ ছাড়া অনুপ চেটিয়া কখনও ভারত সরকারের সঙ্গে আপোষ করবেন না। তিনি মানব মুক্তির উপযোগী আদর্শের ভিত্তিতে আমৃত্যু জনগণের পাশে থাকবেন, এটাই প্রত্যাশা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)