করোনা মহামারির মধ্যে গত দেড় বছর দেশের বিভিন্ন জেলাতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটেছে। টানা দেড় বছর বন্ধ থাকার পর ১২ সেপ্টেম্বর সারাদেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলেছে। প্রতিষ্ঠান খুললেও অনেক ছাত্রী স্কুলে আসছে না ও অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিচ্ছে না বলে নজরে আসে শিক্ষকদের। একটু খোঁজ নিতে গিয়ে বেরিয়ে আসে বাল্যবিবাহের কারণে তাদের শিক্ষা জীবনের অকাল সমাপ্তির তথ্য।
বিভিন্নসময়ে গণমাধ্যমে বিভিন্ন জেলায় বাল্যবিবাহ ও স্কুল-কলেজের ছাত্রীদের এসব ঘটনা ইতিমধ্যে দেশবাসীর নজরে এসেছে। গণমাধ্যমের তথ্য অনুসারে, অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণিপড়ুয়া অনেক ছাত্রীরই বিয়ে হয়ে গেছে। প্রধানত করোনাকালে আর্থিক অনিশ্চয়তা ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতাকে বাল্যবিবাহের কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে।
নিরাপত্তাহীনতা, দারিদ্র্য ইত্যাদি কারণে দেশের চরাঞ্চলে বাল্যবিবাহের প্রবণতা এমনিতেই বেশি। আর করোনাকালে এই হার বহু গুণ বেড়েছে। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার প্রতিবেদনেও এটি উঠে এসেছে। সম্প্রতি মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনাকালে বেশি বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটেছে বরগুনায়; ১ হাজার ৫১২টি। এরপর কুড়িগ্রামে ১ হাজার ২৭২, নীলফামারীতে ১ হাজার ২২২, লক্ষ্মীপুরে ১ হাজার ৪১ এবং কুষ্টিয়ায় ৮৮৪ জন। আর কুড়িগ্রামের রাজারহাট ও উলিপুর উপজেলার নাজিমখাঁ, চাকিরপাশা, ধরনীবাড়ী ও দুর্গাপুর ইউনিয়নে বাল্যবিবাহের হার বেশি। এরকম নানা তথ্য আমাদের ভাবাচ্ছে।
এছাড়া জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের করা আরেকটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে কন্যা শিশুর উপরে যৌন নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ৮ মাসে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১১২ জন কন্যাশিশু। এই সময়ে পাচারের শিকার হয়েছে ১৪০ জন। গত বছরের তুলনায় এবছর কন্যাশিশুর যৌন নির্যাতনের হার বেড়েছে ৭ শতাংশ। এ বছর বাল্যবিয়েও বেড়েছে ১৩ শতাংশ।
উঠে এসেছে হত্যা ও ধর্ষণের চিত্রও। গত ৮ মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮১৩ জন নারী, আর হত্যা করা হয়েছে ১৯৩ জনকে। ২০১৬-২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত সারাদেশের থানাগুলোতে ২৬ হাজার ৬৯৫টি ধর্ষণ মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ৬২২০টি মামলা দায়ের হয়েছে।
আজ (৩০ সেপ্টেম্বর) জাতীয় কন্যাশিশু দিবস। ২০০০ সাল থেকে দিবসটি পালন করা হচ্ছে। মূলত মেয়েদের শিক্ষার অধিকারসহ নানা বৈষম্য থেকে সুরক্ষায় কার্যকর ভূমিকা পালনের লক্ষ্যে এ দিবসের সূচনা। এই সময়ে সমাজে কিশোরী ও নারীদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা অনেকটা কমেছে, তা বলা যেতেই পারে।
সাত বছর আগে লন্ডনে অনুষ্ঠিত গার্ল সামিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৫ ও ১৮ বছরের কম বয়সীদের বাল্যবিবাহ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা জানানোর পাশাপাশি ২০৪১ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহ নির্মূলের অঙ্গীকার ঘোষণা করেছিলেন। এছাড়া বাল্যবিবাহ নিরোধে নেওয়া জাতীয় কর্মপরিকল্পনায় সরকার ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে শূন্যের কোঠায় নামানোর লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিল। সবকিছুই অনেকটা হুমকির মুখে বলে আমাদের ধারণা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, জরুরি ভিত্তিতে খানা জরিপ করে আসল কারণ ও বাল্যবিবাহ-নির্যাতন চিত্র তুলে আনা জরুরি। এছাড়া স্থানীয় ভিত্তিতে আইনত ও সামাজিক প্রতিরোধের মাধ্যমে বাল্যবিবাহ ও নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। এরপরেও হয়তো বাল্যবিবাহ হবে, সেক্ষেত্রে নিরাপদ মাতৃত্ব সর্ম্পকে সচেতনতা তৈরি ও শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া বিষয়ে উপ-বৃত্তিসহ নানা পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও সচেতনতায় সমাজে কিশোরীসহ নারীদের নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত হোক, এই আমাদের প্রত্যাশা।