বহুকাল ধরে বাংলাদেশের ছবির মুখের দিকে তাকিয়ে তীর্থের কাকের মত অপেক্ষা—আর বারবারই আশায় বুক বাঁধা এবং স্বপ্নভঙ্গের গল্প। সর্বশেষ সবচেয়ে বেশি প্রত্যাশা নিয়ে দেখতে বসা ছবি ছিল তৌকীরের ‘অজ্ঞাতনামা’। দারুণ শক্তিশালী চিত্রনাট্য এবং ফজলুর রহমান বাবুর অসাধারণ অভিনয়ের পরেও ছবিটি শেষ পর্যন্ত কোথায় যেন খেই হারিয়ে ফেললো।
‘কমলা রকেট’-এর একাধিক ইতিবাচক পর্যালোচনা ছবিটি দেখার উৎসাহ যোগালো—দেখে ফেললাম সিনেপ্লেক্স এর পর্দায়। উৎসাহ, আশা, আশঙ্কা সবই ছিল। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সিনেমার ভাষায় গল্পটা বলতে পারবে তো? অপ্রয়োজনীয় মেলোড্রামা গল্পটাকে অহেতুক বেপথু করবে না তো? সব আশঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়েছে ‘কমলা রকেট’। ওই সিনেমা দেখার ঘন্টা, মিনিটগুলো জীবনের মূল্যবান সঞ্চয়ের মত জমা হয়েছে। পরিমিতিবোধ ও সংবেদনে কোনো ঘাটতি না রেখে ‘কমলা রকেট’ গল্পটিকে গুছিয়ে বলতে পেরেছে। এবং এই প্রথম মোশাররফ করিমের মত অভিনেতাকে যথাযথ ব্যবহার করা হয়েছে। অন্য অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও যার যার জায়গায় ভাল করেছেন—কিন্তু মোশাররফ করিমের ব্যবহার বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
গার্মেন্ট কারখানায় আগুন লেগে গুরুতর দুর্ঘটনার পর আত্মগোপনে থাকা মালিক (তৌকীর আহমেদ), এবং একই কারখানায় আগুনে পুড়ে কয়লা হওয়া নারী শ্রমিকের রিকশাওয়ালা স্বামী (জয়রাজ) গল্পের দুই কেন্দ্রীয় চরিত্র। ঢাকা থেকে খুলনাগামী স্টিমারের প্যাসেঞ্জার তারা। জয়রাজ লাশ নিয়ে বাড়ি ফিরছে। আরো অনেকগুলো চরিত্র এবং অনুষঙ্গ হাজির আছে কমলা রকেটে।
যৌনকর্মীর দালালীসহ বহুমুখী টাউটারী পেশায় নিয়োজিত স্টিমারের এক স্থায়ী বাসিন্দা (মোশাররফ করিম) গল্প এবং চরিত্রগুলোর মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করেছে। এই সংযোগ আলাদা আলাদা বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলোকে জোড়া দিলেই দুর্দান্ত এক গল্প বেরিয়ে এসেছে। বোন ও দুলাভাইয়ের সাথে ভ্রমণে থাকা সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করা তরুণী ও তার প্রেমিক— যে ছেলে কেবল একটা শরীরী রাতের আশায় স্টিমারে চড়ে বসেছে। এবং অভিসার শেষে সকাল হলেই নেমে পড়েছে। তরুণী নিজের ভবিষ্যত বা ক্যারিয়ার নিয়ে নানামুখী পরিকল্পনা ও উদ্বেগ, সবাইকে এড়িয়ে প্রেমিকের সাথে মিলন, তার ওভাবে চলে যাওয়ার বাস্তবতায় রিক্ততার অনুভূতি এবং তীব্র শরীরী আবেগ-আকুতি—এই পুরো উপস্থাপন ছিল বাস্তবানুগ এবং স্মার্ট।
স্টিমারে আছে চাকরীপ্রত্যাশী দুই যুবক। বাংলাদেশের আরো লাখ লাখ যুবকের মূর্ত বাস্তবতার প্রতিনিধিত্বকারী। এদের মধ্যে খুব সামাান্যসংখ্যকই মোটা অংকের টাকা ঘুষ দিয়ে চাকরি নামের সোনার হরিণ ধরতে পারে। তারপরও তাদের চেষ্টা ও প্রলোভন জারি থাকে। বাড়ির ভিটেটি বেঁচে দিয়েও যদি দশ লাখ জোগাড় করা যায়—ওই টাকা তুলে ফেলতে আর কতক্ষণ? কিন্তু টাকা দিলেই যে চাকরি হবে বা টাকা মার যাবে না তা তো নয়? নিম্ন মধ্যবিত্তের গ্র্যাজুয়েট বেকার যুবকের টানাপোড়েনের কী আর শেষ আছে?
এর মধ্যে কমলা রকেটেই আমরা বিসিএস-এর প্রিলিমিনারীর রেজাল্ট হতে দেখি। লাখ লাখ বেকার গ্র্যাজুয়েটের কয়জনই বা সেখানে টেকে? কমলা রকেটে আরো আছে একটি ক্ষয়িষ্ণু সার্কাসের দল—যারা কোনমতে পেটেভাতে টিকে আছে এখানে। জয়রাজের তীব্র শোক এবং উৎকণ্ঠার ব্যাকগ্রাউন্ডে সার্কাসের খেলা চলতে থাকে। প্রথমে কুয়াশায় ও পরে ডুবোচরে আটকে ঘন্টার পর ঘন্টা বিলম্বিত হতে থাকে স্টিমারের যাত্রা, ওদিকে পচন ধরে পোড়া লাশে। মাছির ভনভন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে পুরো কমলা রকেট জুড়ে। সিনেমা আগায় ক্লাইমেক্সের দিকে।
অভিনন্দন নুর ইমরান মিঠু। মিঠুর অভিনীত ফারুকী পরিচালিত পিঁপড়াবিদ্যা ছবিটিও হলে দেখেছিলাম। পিপড়াবিদ্যাকে আমি আমার দেখা বাজে ছবির তালিকায় উপরের দিকে রেখেছি, ওটার স্ক্রিপ্টটাই জঘন্য রকমের ফারুকীয়। ফারুকীর মূল সংকটটা হল মানুষ দেখার। একটা গৎবাঁধা সংকীর্ণতার বাইরে মানব চরিত্র দর্শণের বীশ্ববীক্ষা তার নেই। সেই ফারুকীর মাধ্যমে জানতে পারা মিঠু প্রথম ছবিতেই তার জাত চিনিয়ে দিলেন—তিনি দেখতে জানেন মানুষের ভেতর বাহির। মিঠুর কাছে আকাশ সমান প্রত্যাশা তৈরি হয়ে থাকলো।
খুব সম্ভাবনা আছে শিগগির হয়তো সিনেমাটি নামিয়ে ফেলা হবে। তার আগে বসুন্ধরা স্টার সিনেপ্লেক্স কিংবা যমুনা ব্লকবাস্টারে গিয়ে দেখে ফেলুন সবাই। পারলে আজই। বুকে হাত দিয়ে বলার মত বাংলা সিনেমা ‘কমলা রকেট’।
লেখক: বাকী বিল্লাহ