১৯৯০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮’র ৮ এপ্রিল। নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড থেকে অস্ট্রেলিয়ার গোল্ডকোস্ট। আবদুস সাত্তার নিনি আর আতিকুর রহমান থেকে আব্দুল্লাহ হেল বাকি। কমনওয়েলথ গেমস যাত্রায় বাংলাদেশের সাফল্য লেখা হয়েছে তাদের হাত ধরে। কিন্তু দুই প্রজন্মের ২৮ বছরের সেতুবন্ধনের হিসাব কষলে সাফল্যের সঙ্গে মুদ্রার উল্টো পিঠের বাস্তবতাটাই বড্ড বেশি চোখে লাগবে। দুই যুগেরও বেশি সময়ে যে কমনওয়েলথে সাত্র ৭টি পদকের দেখা পেয়েছে বাংলাদেশ।
লাল-সবুজের সাতটি পদকই আবার শুটিং থেকে এসেছে, যার দুটি সোনা। অকল্যান্ডে প্রথমে ব্রোঞ্জ, পরে সোনা এসেছিল শুটিংয়ের ১০ মিটার এয়ার পিস্তল ইভেন্টে; দেশকে উল্লাসে মাতিয়েছিলেন সাত্তার ও আতিকুর। বাকি সেখানে ১০ মিটার এয়ারে রুপা আনলেন। মাঝে গেছে দীর্ঘ খরাও। প্রবল সম্ভাবনা জাগানো শুটিংই ডানা মেলতে পারেনি সময়টাতে, অন্য ডিসিপ্লিনগুলো যেন ধুঁকে ধুঁকে চলছে!
এমন নয় ভারোত্তোলন, বক্সিং, স্প্রিন্টে সাফল্য আনার মতো অ্যাথলেট নেই বাংলাদেশের। আছে! কিন্তু তারা একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির বেশি এগোতে পারেন না। অকল্যান্ডের সাফল্য দেশের শুটিংয়ের চেহারা পাল্টে দিয়েছিল, পাল্টানো সেই সম্ভাবনাগুলো যেমন আরও কয়েকধাপ ওপরে টেনে নেয়া যায়নি, তেমনি অন্য ডিসিপ্লিনেও একই অবস্থা! কোন কোনটিতে তো বেহালদশা!
ফেডারেশন আছে। নেই নেই করে বাজেটও আছে। সেসব খরচের জন্য দলে দলে কর্মকর্তাও আছেন। কিন্তু খেলাগুলো এগিয়ে নেবেন যারা, সেই অ্যাটলেটদের জন্য নেই কোন উন্নত অনুশীলন ব্যবস্থা আর সময়োপযোগী পরিকল্পনা। কোন আসর যখন ঘনিয়ে আসে, বাছাই নামের একটা প্রক্রিয়ার পর যতজন অ্যাথলেট অংশ নিতে দেশ ছাড়েন, সমানসংখ্যক বা ক্ষেত্রবিশেষে বেশি কর্মকর্তা সঙ্গী হন তাদের। বেশিরভাগ সময়ই যারা জম্পেশ ঘুরে-বেড়িয়ে সময়টা কাটিয়ে দেন।
গোল্ডকোস্টেই যেমন বক্সিংয়ে অংশ নিতে পারেনি বাংলাদেশ দল। ইভেন্টের আগেই ডিসকোয়ালিফাই! কারণ, আগেরদিন গেমসের পূর্বনির্ধারিত মিটিংয়ে উপস্থিত থাকার কথা ছিল কোচ বা ম্যানেজারে, এই দুটির ভূমিকায় যিনি গেছেন, তার মনে হয়নি একটা সূচি ঠিক করা আছে। যার মূল্য চুকিয়েছেন কঠিন প্রস্তুতি নিয়ে উড়ে যাওয়া দুই বক্সার।
বিদেশে গেমসে অংশ নিতে গিয়েই যখন এই অবস্থা, দেশের চিত্রটা তখন কল্পনা করাই যায়!
ফেডারেশনগুলোতে কর্মকর্তা আছেন, আছে বাহারী সব পোস্ট-পদবী। কিন্তু বছরভর নতুন খেলোয়াড় তুলে আনায় তাদের কোন মনোযোগ নেই। যারা উঠে আসেন, তাদের জন্যও পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা নেই অনুশীলনের, অ্যাথলেটিক্সের কঠিন পরিশ্রমের খেলাগুলোর জন্য যেটা অপরিহার্য। ভাল কোচ, দীর্ঘ ক্যাম্পের বিষয়গুলো তো আরও দূরের। আরেকটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ, নির্বিঘ্নে খেলা চালিয়ে যাওয়ার জন্য অর্থের চিন্তা থেকে দূরে থাকতে পারা। একজন অ্যাথলেটকে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক অসংখ্য বিষয়ে মন দিতে হয়। পিছিয়ে থাকার পেছনে পৃষ্ঠপোষকতার অপ্রতুলতা তাই অন্যতম কারণ। ব্যক্তিগত খেলার ক্রীড়াবিদের পৃষ্ঠপোষকতার অভাব থাকাটা কেবল দৃষ্টিকটুই নয়, বঞ্চনাও!
এসব কারণে সাফ গেমসের মতো আঞ্চলিক প্রতিযোগিতায় সাফল্যের অভিজ্ঞতা কমনওয়েলথের মতো বৈশ্বিক আসরে নিয়মিত টেনে নেয়া সম্ভব হয় না। কমনওয়েলথেই যা সম্ভব হয় না, এশিয়ান গেমস, অলিম্পিকে তা আশা করা সুদূরপরাহত স্বপ্নই কেবল নয়, বোকামিও! অমিত সম্ভাবনা থাকার পরও তাই বড় সাফল্য এসে ধরা দেয় না বাংলাদেশের পতাকাতলে।
এরপরও ব্যক্তিগত বা দলীয় লড়াইগুলো এগিয়ে যায়। সাফে সোনার হাসিতে দেশ মাতানো মাবিয়া আক্তার সীমান্ত কমনওয়েলথে ব্যক্তিগত সেরা স্কোর গড়েও ষষ্ঠ হন। আরেকটু পরিচর্যা-মনোযোগ-সুবিধা পেলে হয়ত সেরাই হতেন। তখন অন্য কোন মাবিয়া-শিলা-আসিফ হয়ত উঠে আসত পথটা ধরে। নানা অসংগতির মাঝেও আব্দুল্লাহ হেল বাকি পথের রেখাটা এঁকে চললেন রোববার, রুপা জিতে ধরে রাখলেন এই আসরে গতবারের রুপা জয়ের সাফল্য। পথ পথিকের সৃষ্টি করুক অথবা পথিক পথের; বাকি তো দৃষ্টান্তটা অটুট রাখলেন। তাকে অভিনন্দন।