“আয়ু যদি চাইলেই তবে দশ বছর কেনো? আরো হাজার বছরের আয়ু চাইতে।” ক্যান্সার আক্রান্ত হুমায়ূন আহমেদ চিকিৎসার জন্য শেষবারের মতো নিউইয়র্ক যাওয়ার আগে লেখক ও সাংবাদিক আনিসুল হককে এমন কথা বলেছিলেন।
আনিসুল হক বলেছিলেন, বাংলা সাহিত্যকে, প্রকাশনা জগৎকে একটা জায়গায় দাঁড় করাতে আরও দশ বছর হুমায়ূনের বিচরণ থাকতে হবে। জবাবে কথার যাদুকর হমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন, কেনো হাজার বছর আয়ু চাইলেন না আনিস!
সমকালীনবাংলা সাহিত্যের প্রধান লেখকদের একজন হমায়ূন আহমেদের তৃতীয় মৃত্যুবাষির্কী আজ। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এবং তুমুল জনপ্রিয় এই সাহিত্যিকের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আনিসুল হক অনেকটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন।
২০১২ সালের ১৯ জুলাই কোটি ভক্তকে কাঁদিয়ে সাহিত্যের নক্ষত্র আকাশের নক্ষত্র হয়ে যান। প্রায় চার দশক ধরে নিজের অসাধারণ লেখনি শৈলীর দিয়ে তিনি মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিলেন বাঙ্গালী পাঠক সমাজকে। অনেক নতুন পাঠক গড়ে তোলার কারিগর, এই কথার যাদুকর কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘ নয় মাস চিকিৎসাধীন থাকার পর নিউইয়র্কের বেলেভ্যু হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
হুমায়ূন আহমেদের তৃতীয় মৃত্যুবাষির্কীর কথা জেনে আনিসুল হক অনেকটাই চমকে যান।কিছুটা আনিসুল হক বলেন, ‘হুমায়ূন আহমেদ চলে গেছেন, তিন বছর হয়ে গেলো!’
হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে ঈদ উদযাপনের কোনো স্মৃতি নেই উল্লেখ করে আনিসুল হক বলেন, তবে তার সাথে আমার অনেকবার দেখা হয়েছে। অনেক মধুর স্মৃতি রয়েছে।
হুমায়ূন আহমেদকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে আনিসুল হক বলেন, নিউইয়র্কে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থাতেও তিনি আমাকে ভোলেন নি। সে অবস্থায় তিনি আমাকে একটি জোকসের বই পাঠিয়েছিলেন। মজা করে বলেছিলেন, ‘তোমার গদ্য কার্টুনের রস কমে যাচ্ছে। এইজন্য এই বইটা পাঠাচ্ছি।’
হুমায়ূন আহমেদের অসাধারণ এই রসবোধের কথা স্মরণ করে চ্যানেল আই অনলাইনকে আনিসুল হক বলেন, এই কথাটা মনে পড়লে একই সঙ্গে শ্রদ্ধাবনত হই, আবার মন খারাপও হয়।
হুমায়ূন আহমেদ’র সর্বশেষ সিনেমা ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ যা ৮৫তম অস্কার প্রতিযোগিতায় ‘সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র’ বিভাগে মনোনয়ন পেয়েছিলো। এই ছবির উদ্বোধনী শোতে ২০১২ সালের ৩০ মে আনিসুল হককে হুমায়ুন আহমেদ আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
‘গাড়ি থেকে নামার পর হাত ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন হলে। আমাকে পাশে বসিয়েছিলেন। পাশাপাশি বসে আমরা চলচ্চিত্রটি দেখি। চলচ্চিত্র শেষে আমাকে বক্তৃতা দিতে বলেছিলেন। হুমায়ূনের মৃত্যুর পর সেই বছরের ৭ সেপ্টেম্বর ছবিটি মুক্তি পায়,’ বলে হুমায়ূনকে স্মরণ করছিলেন আনিসুল হক।
১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর নেত্রকোণা জেলার কেন্দুয়ার কুতুবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করা এই যাদুকর লেখা ও চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্যে অধ্যাপনা ছেড়ে দেন। অসামান্য প্রতিভাধর এই সাহিত্যিক একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার, চলচ্চিত্র নির্মাতা, গীতিকার হয়ে ওঠেন মাত্র তিন দশকেই। তার রচিত গান বেশি না হলেও শ্রোতাদের মাঝে তা ব্যাপক আবেদন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলো। তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা দুই শতাধিক।
১৯৭০ সালে নন্দিত নরকে উপন্যাস এর মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের জগতে তার প্রবেশ। প্রথম উপন্যাস প্রকাশের পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত জনপ্রিয়তার বিচারে হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন অদ্বিতীয়। তার কোনো নতুন বই প্রকাশ পাওয়া মানেই পাঠকদের মধ্যে তা সংগ্রহের জন্য হুড়োহুড়ি পরে যেতো। বই মেলায় তার বইয়ের দোকানের স্টলে থাকতো সবচেয়ে বেশি ভিড়। বই মেলা মানেই হুমায়ূনের নতুন বই, আর তা সংগ্রহের জন্য পাঠকদের মধ্যে চলতো প্রতিযোগিতা। বাংলাদেশে তো বটেই, বিশ্বের সাহিত্যপাড়ায় তার মতো পাঠকপ্রিয় লেখক বিরলই বলা যায়।
হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্ট চরিত্র হিমু, মিসির আলী তরুণ পাঠক সমাজকে প্রভাবিত করেছিলো। আশির দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্য নাটক রচনা শুরু করেন তিনি। অসামান্য জনপ্রিয় এই নাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে এইসব দিন রাত্রি, বহুব্রীহি, কোথাও কেউ নেই, নক্ষত্রের রাত, অয়োময়, আজ রবিবার।
তার ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের বাকের ভাই চরিত্রটি দর্শকদের এতোটাই প্রিয় হয়ে উঠেছিলো যে শেষ পর্বে তার ফাঁসির ঘোষণা এবং মৃত্যুর ঘটনা পরিবর্তনের জন্য মানুষ বিক্ষোভ মিছিলও করেছিলো। শেষ পর্ব নির্ধারিত সময়ে প্রচার না করে কয়েকদিনের বিরতি নেয়াও হয়েছিলো। তবে হুমায়ূন আহমেদ তার উপন্যাস থেকে রচিত এই নাটকের কাহিনী পরিবর্তন করেননি। নাটকের একটি চরিত্রকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে মানুষের বিক্ষোভ একই সাথে বিস্ময়কর এবং বর্তমান সময়ের দুরবস্থার কথা ভাবলে তা একধরণের পীড়াও দেয়। এই মায়ার জালে মোহাবিষ্ট করা স্রষ্টার অভাব কখনোও পূরণ হবার নয়।
কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ অনেক পুরষ্কার পেয়েছেন তিনি। এর মধ্যে রয়েছে বাংলা একাডেমী পুরস্কার ১৯৮১, শিশু একাডেমী পুরস্কার, একুশে পদক ১৯৯৪, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (শ্রেষ্ঠ কাহিনী ১৯৯৪, শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র ১৯৯৪, শ্রেষ্ঠ সংলাপ ১৯৯৪), লেখক শিবির পুরস্কার ১৯৭৩, মাইকেল মধুসূদন পদক (১৯৮৭), বাচসাস পুরস্কার (১৯৮৮), হুমায়ূন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯০), জয়নুল আবেদীন স্বর্ণপদক উল্লেখ যোগ্য।