এক ম্যাচ আগের ব্যবহৃত উইকেটে রোহিত শর্মার রেকর্ডময় শতকে প্রথমে ব্যাট করে ৯ উইকেটে ৩১৪ তুলেছিল ভারত। এই উইকেটে পরে ব্যাট করে ম্যাচ জেতা সম্ভব না- এমন জুজুতে ব্যাটসম্যানদের পেয়ে বসেছিল কিনা সেটা জানার সুযোগ নেই। তবে তাড়াহুড়ো দেখিয়ে যেভাবে বিলিয়ে এলেন উইকেট, কাঠগড়ায় তাই টাইগার ব্যাটসম্যানরাই। ১২ বল হাতে রেখে ২৮৬ রানে অলআউট, ২৮ রানে হেরে সেমির আশা যে শেষ বাংলাদেশের।
উইকেট বুঝে সাবধানেই এগোচ্ছিল বাংলাদেশ। আড়াল থেকে চোখ রাঙাচ্ছিল রানরেট। সেটাও আয়ত্তে ছিল অনেকটা সময়। কিন্তু এক সাকিব আল হাসান ছাড়া বাকিদের ম্যাচ পরিস্থিতি বুঝতে না পারা ডোবাল। মন্থর উইকেটে অহেতুক উইকেট ছুঁড়ে আসার মিছিল! ফলাফল যা হওয়ার হল তা-ই। যে ম্যাচটা জিতলে বেঁচে থাকত শেষ চারের স্বপ্ন, ব্যাটসম্যানদের দায়িত্ব নিতে না পারার হাহাকার, ম্যাচ যেন ছুঁড়েই এলো মাশরাফী দল।
নিজেরা বাদ পড়ে ভারতকে সেমিতে তুলে দিলো বাংলাদেশ। ৮ ম্যাচে ১৩ পয়েন্ট নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার পর নকআউটে বিরাট কোহলির দল। আর বাংলাদেশের পয়েন্ট ৮ ম্যাচে ৭। ৫ জুলাই পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচটা কেবলই আনুষ্ঠানিকতা রক্ষার। সেটি জিতলে একটাই লাভ হতে পারে টাইগারদের, পঞ্চম কিংবা ষষ্ঠ স্থান নিয়ে অন্তত দেশে ফেরা যাবে মাথা উঁচু করে।
অথচ ম্যাচটা এভাবে শেষ নাও হতে পারত! শেষদিকে সাব্বির রহমান ও মোহাম্মদ সাইফউদ্দিনের মারমুখী ব্যাটিংও চোখে আঙুল তুলে দেখিয়েছে, একটু ধৈর্য ধরলেই ফল ইতিবাচক হতে পারত। যাদের নামের পাশে প্রসিদ্ধ ব্যাটসম্যানের তকমা, তারাই যেন সময়মত হারিয়ে ফেললেন ব্যাটিংয়ের ধার!
শুরুটা করেন তামিম ইকবাল। উইকেট সুবিধার নয়, অবস্থা বুঝে ধীরে এগোনেই শ্রেয় মনে করেছিলেন, সঙ্গী সৌম্য সরকারও একই। চাননি অযথা ঝুঁকি নিতে। তাতে লাভ হয়নি। দশম ওভারে মোহাম্মদ সামির অফস্টাম্পের বাইরের বলে ব্যাটের খোঁচায় বোল্ড তামিম। ফেরার আগে ৩১ বলে করে গেছেন ২২ রান।
সৌম্য আরও কিছুক্ষণ টিকে ছিলেন। বেশি সময়ের জন্য নয় অবশ্য। যখন মনে হচ্ছিল থিতু হয়ে গেছেন, তখনই আত্মহনন! পান্ডিয়ার বলে কোহলিকে ক্যাচ নিয়ে ফিরলেন ৪ চারে ৩৮ বলে ৩৩ করে।
পরে বেশ কঠিন এক লড়াই জেতার জন্য এক সাকিব আল হাসানের দিকেই চেয়ে ছিল বাংলাদেশের সমর্থকরা। দারুণ ব্যাটিং নমুনার প্রদর্শনী ভারতের বিপক্ষেও সচল রেখেছিলেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার। ৫৮ বলে তুলে নেন চলতি আসরের ষষ্ঠ ফিফটি পেরোনো ইনিংস।
এমনিতেই ২০১৯ বিশ্বকাপ সাকিবের জন্য যেন সোনায়-সোহাগা। গড়ছেন একের পর এক রেকর্ড। ভারত ম্যাচেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। ব্যক্তিগত ২৪ রানের সময় গড়েন আরেকটি অনন্য কীর্তি। বিশ্বকাপে এক আসরে ১০ উইকেট ও ৫০০ রান করা একমাত্র ক্রিকেটের নামটি এখন সাকিব!
তবে সাকিব একা খেললেই যে ম্যাচ হাতে আসত এমনটাও নয়। দরকার ছিল যোগ্য সঙ্গের। সেখানেই ব্যর্থ বাকিরা। সৌম্যর সঙ্গে সাকিবের জুটিটা ভেঙেছে মাত্র ৩৫ রানে। বড় হতে হতেও হয়নি মুশফিকের সঙ্গে ৪৭ রানের জুটি। সাকিবকে এক পাশে রেখে যুজবেন্দ্র চাহালকে সুইপ করতে গিয়ে মুশফিক ২৪ রানে ধরা পড়েন সামির হাতে।
আশা দেখাচ্ছিলেন লিটন দাস। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ১৮৯ রানের জুটিতে ম্যাচ জেতানোতে তার অবদানও কম ছিল না। কিন্তু লিটনও এদিন ব্যর্থ। ২২ বলে ২৪ করে হার্দিক পান্ডিয়ার শর্ট বলে ফিরেছেন দীনেশ কার্তিককে ক্যাচ দিয়ে। কিছুক্ষণ বাদে বুমরাহর বাইরের বল স্টাম্পে টেনে এনে দলকে বড় বিপদে রেখে ফিরে যান মোসাদ্দেক, ৩ রানে।
বাকি সতীর্থদের আসা-যাওয়া দেখতে দেখতে হয়তো ক্লান্তই হয়ে পড়েছিলেন সাকিব! একা একা আর কতইবা লড়া যায়! অন্যদিকে প্রয়োজনীয় রানটাও বাড়ছিল উইকেটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। শেষ পর্যন্ত আর চাপটা নিতে পারলেন না, পান্ডিয়ার বাউন্সারে কার্তিককে ক্যাচ দিয়ে ফিরলেন ৭৪ বলে ৬৬ রানে। মাত্র ২ রানের জন্য সর্বোচ্চ রানের সিংহাসনেও আরেকবার বসা হল না। ৫৪৪ রানে আপাতত সেই আসনে বসা রোহিত। সাকিবের রান ৫৪২!
১৭৯ রানে ৬ উইকেট হারানোর পর বড় হার যেন হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের নিয়তি। তবে সেটা হতে দেননি সাব্বির ও সাইফউদ্দিন। আশা নেই ভেবেই যেন হাত খুললেন দুজনে। ৫৬ বলে তুললেন ৬৬ রান। অদ্ভুতভাবেই তাতে বাংলাদেশের ম্যাচ জয়ের স্বপ্ন মেঘ ফুরে বেড়িয়ে এলো আলো হয়ে!
যতক্ষণ ছিলেন সাব্বির, ছিলেন আশা হয়ে। তবে বেশিক্ষণের জন্য না। ৩৬ করে বুমরাহর স্লোয়ারে ফিরলেন বোল্ড হয়ে। ভাঙল আশার দেয়ালও।
এরপর সাইফউদ্দিন একাই লড়ে গেলেন। স্রোতের বিপরীতে লড়ে পেলেন নিজের দ্বিতীয় ওয়ানডে ফিফটি। তার ব্যাটে চড়ে একটা সময় জয়ের খুব কাছেও চলে গেল টাইগাররা।
লড়তে লড়তে শেষ ১৮ বলে সমীকরণটা ৩৬ রানে নামিয়ে এনেছিলেন সাইফউদ্দিন। এমনকি বুমরাহর করা ৪৭ ওভারের তৃতীয় বলে চারও মেরেছিলেন। ছোট একটা আশা তাতে অল্প হলেও জ্বলছিল।
পরের বলে সিঙ্গেল নিয়েই বিপদ ডেকে আনলের সাইফ। স্ট্রাইকে দিলেন রুবেল হোসেনকে। দুর্বল ব্যাটসম্যানকে পেয়ে আর ভুল করেননি চতুর বুমরাহ। ইয়র্কারে ভাঙ্গলেন রুবেলের উইকেট। পরের বলে ঠিক একই ডেলিভারিতে মোস্তাফিজের উইকেট ভেঙে ভাঙলেন বাংলাদেশের সেমির স্বপ্নও!
চাইলে এরপরও ম্যাচ জেতানোর কৃতিত্বটা পুরোটাই নিতে পারেন ম্যাচসেরা রোহিত শর্মা। মন্থর উইকেটে আগে ব্যাট করে তার রেকর্ডময় ১০৪ রানের ইনিংসে ভর করেই তিনশো রানের সংগ্রহ তোলে ভারত।
সেঞ্চুরির পর হয়তো খুব একটা রান করেননি রোহিত, কিন্তু তাতেই যোগ হয়ে গেছে একাধিক রেকর্ড। চলতি বিশ্বকাপে এটি তার চতুর্থ সেঞ্চুরি, যা এক বিশ্বকাপে যৌথভাবে সর্বোচ্চ শতকের রেকর্ড। ২০১৫ আসরে টানা চার সেঞ্চুরি পান কুমার সাঙ্গাকারা। রোহিত টানা পাননি, করেছেন ভেঙে ভেঙে।
বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ তো বটেই এবং অবশ্যই ভারতীয়দের মধ্যে সেরা রোহিতের চার সেঞ্চুরি। এর আগে ২০০৩ বিশ্বকাপে তিন সেঞ্চুরি করে বিশ্বকাপের এক আসরে সর্বোচ্চ সেঞ্চুরিয়ান ছিলেন সাবেক অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলি।
রোহিত কাণ্ড এখানেই থামেনি। ৯২ বলের ইনিংসে ৭ চারের সঙ্গে ৫টি ছয় মেরেছেন, গড়েছেন ছক্কায় নতুন রেকর্ড। মহেন্দ্র সিং ধোনিকে পেছনে ফেলে ভারতীয়দের মধ্যে সর্বোচ্চ ছক্কার মালিক এখন ডানহাতি ওপেনার। রোহিতের ছক্কা সংখ্যা এখন ২৩০। সর্বোচ্চ ছক্কায় তার সামনে কেবল সনাথ জয়সুরিয়া, শহিদ আফ্রিদি ও ক্রিস গেইল। বিশ্বকাপে একমাত্র ওপেনার হিসেবে ৫০’র বেশি রান গড়ের মালিকও এখন তিনিই।
রোহিতের ব্যাটে যে গতিতে এগোচ্ছিল ভারত, তা থামিয়ে লক্ষ্যটাকে হাতের নাগালে রাখার মূল কৃতিত্বটা মোস্তাফিজুর রহমানের। শুরুরদিকে সুবিধা করতে পারেননি। কিন্তু ৩৯তম ওভারে কোহলি ও হার্দিক পান্ডিয়ার জোড়া উইকেট মেডেন নিয়ে শুরু করেন। ডেথ ওভারের মাঝামাঝি নিলেন রিশভ পান্টের উইকেট। একদম ইনিংসের শেষ ওভারে ধোনি ও সামির উইকেট তুলে নিয়ে দ্বিতীয় বাংলাদেশি বোলার হিসেবে গড়লেন বিশ্বকাপে ৫ উইকেট নেয়ার কীর্তি।