আমাদের সন্তানেরা জঙ্গি হয়ে যাচ্ছে। তাদের নানাভাবে প্ররোচিত করা হচ্ছে ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে, প্রত্যেককে বিশ্বের নায়ক হবার মিথ্যা স্বপ্ন দেখিয়ে, বেহেশত পাওয়ার লোভ দেখিয়ে, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে, মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে জঙ্গি নেতারা। এ কাজে তারা বিভিন্ন ড্রাগ ব্যবহার করা শিখিয়ে মানব মস্তিষ্ককে আজ্ঞাবাহী রোবটে পরিণত করছে বলেও শোনা যাচ্ছে। শুরু হয়েছিল মাদ্রাসায় অধ্যয়নরত দরিদ্র ঘরের সন্তানদের দিয়ে। মাদ্রাসা বিশেষত কওমি মাদ্রাসার শিক্ষকগণ তাদের ছাত্রদের মগজ ধোলাই করতো নানা ভ্রান্ত তথ্য ও ব্যাখ্যা দিয়ে। তখন একমুখী শিক্ষা, কওমি মাদ্রাসার শিক্ষাক্রম সাধারণ শিক্ষাক্রমের সাথে সাযুজ্য রাখার আন্দোলন হয়। তাতে উল্লেখযোগ্য তেমন সাফল্য অর্জিত না হলেও জঙ্গি গোষ্ঠী তাদের টার্গেট পাল্টায়।
ইংরেজি মাধ্যমের বেশ কয়েকটি নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জামায়াত-শিবির ও হিযবুত তাহরির নিয়মিত মাহফিল তথা ক্লাশ শুরু করে। এখানে যেমন ইসলাম সম্পর্কে নানা ভুল ব্যাখ্যা দেয়া হয়, তেমনি রাষ্ট্র ও শাসনব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে তৈরি করা হয় নানা রকমের ভ্রান্তি এবং হিংসাপূর্ণ মনোভাব। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষকরাও এসবের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বয়েজ কমনরুমেও অনুরূপ মাহফিল চলে। যার ব্যাপারে প্রশাসন জেনেও না জানার, দেখেও না দেখার ভান করে প্রচ্ছন্ন প্রশয় দেন। এই মাহফিলের সদস্য ছেলে মেয়েরা হাত ধরে সহপাঠীদের অনুরোধ করে প্রথমে কিছু বই পড়তে দেয় তারপর ধীরে ধীরে মাহফিলে নিয়ে দলভুক্ত করে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আশির দশকের শেষ দিক থেকেই কমনরুমগুলোতে বোরখা পরা মেয়েরা ইসলাম সম্পর্কিত নানা ধরণের বই বিলি করতো। বলাই বাহুল্য, এসব বই ছিলো ইসলাম ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে পূর্ণ। এসব বই নিয়ে এখনও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে, পাড়ায়-মহল্লায় মাহফিলের নামে সন্ত্রাস ছড়াচ্ছে বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠী। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও এ চিত্র একেবারেই বদলায়নি।
বুয়েটে দেখেছি মেয়েরা মোটিভেটেড হয়ে মেধাবী ছাত্রদের সাথে সম্পর্ক তৈরি করে ধীরে ধীরে তাদেরও একই পথে নিয়ে যায়। অন্যদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশের গ্রামগুলিতে বিবাহ সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েও জামাতিরা তাদের আদর্শে লোকের মগজ ধোলাই করিয়ে রগ কাটা থেকে শুরু করে সকল প্রকার নৃশংস কাজ করিয়েছে ইসলামী জিহাদের নামে।
আমাদের রাজনৈতিক-সামাজিক নেতারা, প্রশাসন, সমাজচিন্তকরা তখন এ বিষয়টি ততোটা গুরুত্ব দিয়ে দেখেননি। তৎকালীন প্রশাসন প্রচ্ছন্ন মদদও দিযেছে। এর মধ্যে বিএনপি-জামাতের শাসনামলে প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে বিশেষত সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয, পুলিশ, সেনাবাহিনীর নিচু থেকে উঁচু- সকল পর্যায়েই মৌলবাদী আদর্শে দীক্ষিতদের নিয়োগ দেয়া হয় সুদূরপ্রসারী এক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। এরই মধ্যে আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইরান, ইরাক, পাকিস্তান ইত্যাদি দেশগুলোতে আল কায়দা, আইএসসহ নানা জঙ্গি অপ-তৎপরতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে বিশ্বব্যাপি। সারা পৃথিবীতে এক ভয়ানক হিংস্রতা ছড়িয়ে এইসব জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো ধর্মের নামে মানুষ হত্যাকে জায়েজ করে। পৃথিবীর নানা প্রান্তে নানা ধরণের সহিংসতা ছড়িয়ে সভ্যতার বিরুদ্ধে এক কুৎসিত যুদ্ধ ঘোষণা করে।
বাংলাদেশেও শক্তিশালী হতে থাকে মৌলবাদী অপগোষ্ঠী। প্রশাসনিক সুবিধাপ্রাপ্তরা স্বগোষ্ঠীকে সাহায্য সহযোগিতা করতে থাকে এবং প্রভাব খাটিয়ে আরো অনেককে দলে টানে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য শুরু করলেও কাদের মোল্লার যাবজ্জীবনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবার প্রেক্ষিতে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন শুরু হবার পর এ আন্দোলনকে প্রতিহত করতে হেফাজত নামে এক মৌলবাদী গোষ্ঠীকে সরকারের মদদেই মাঠে নামানো হয়। জন্ম হয় আওয়ামী ওলামালীগসহ নানা ধরণের সংগঠন যারা চূড়ান্ত সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী কর্মকাণ্ড চালাতে শুরু করে প্রশাসনের নাকের ডগায় বসে। এইসব গোষ্ঠীর যৌথ প্রচেষ্টায় প্রজন্ম মৌলবাদে দীক্ষিত হচ্ছে। আজ আই এস যে জঙ্গিবাদের নৃশংসতা চালাচ্ছে বিশ্বব্যাপি তা ধারাবাহিক সেই প্রক্রিয়ারই ফল।
এ সময়ের এই জঙ্গিবাদ, মৌলবাদী নৃশংসতাকে প্রতিহত করতে আমরা প্রতিনিয়ত, রাজপথে মিছিল, জনসভা, রোডমার্চ, মানববন্ধন করি। এসব প্রতিবাদের দরকার আছে বইকি সামাজিক প্রতিরোধ তৈরির জন্য। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, সমস্যার শিকড় যে গভীরে প্রথিত হয়েছে, তাকে সমূলে উৎপাটিত করতে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন অবশ্য প্রয়োজন।
এলাকাভিত্তিক সাপ্তাহিক- দেশপ্রেম, মানবতা অসাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, সম্প্রীতি বিষয়ে বৈঠক আয়োজন করা উচিৎ। কেবল মসজিদে খুৎবা ঠিক করে দেয়াই নয়, এলাকাভিত্তিক নানা ধরণের ক্লাব, যুব সংগঠন এসবেরও সঠিক নজরদারি প্রয়োজন। ভুলে গেলে চলবে না, বিগত সময়গুলোতে (বিএনপি-জামাতের শাসনামলে) এমনকি এখনও রাজনৈতিক নানা ফন্দি-ফিকির এঁটে স্বাধীনতাবিরোধী আর মৌলবাদী অপশক্তি নানাভাবে ঘাপটি মেরে আছে এলাকাভিত্তিক বিভিন্ন ক্লাবগুলোতে। জঙ্গিবাদ নিরসনের প্রথম ধাপই হলো প্রশাসনের সকল পর্যায়ে, অফিস-আদালতে ও অন্যান্য সামাজিক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদ ভাবাপন্ন মানুষদের নজরদারিতে আনতে হবে। প্রশাসনের মানসিকতার মধ্যে জঙ্গিবাদ রেখে জঙ্গিবাদ দমন সম্ভব না। তাই সর্ষের মধ্যে ভূত থাকলে, তা তাড়ানোর বন্দোবস্ত করতে হবে সবার আগে। এখনও এলাকাভিত্তিক, মহল্লাভিত্তিক নানা ক্লাব, যুব সংগঠন এদের প্রভাব আছে। এসব সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ইতিবাচকভাবে কাজে লাগাতে হবে। কেবল রাজনৈতিক বিবেচনাতেই নয়, সামাজিক বিবেচনাতেও এসব সংগঠনকে কার্যকর করতে হবে। জঙ্গিবাদ নিরসনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে, অসাম্প্রদায়িক দর্শনের নানাদিক নিয়ে কমিশনার অফিসে অথবা মসজিদসহ অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে আলোচনার বন্দোবস্ত করা প্রয়োজন।
অভিভাবক ও শিক্ষকদের শিশু মনোবিজ্ঞান বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা এখন জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হলেও কোনো ফলপ্রসূ পদক্ষেপ কেউ গ্রহণ করেনি। কিন্তু শিশু মনস্তত্ত্ব না জেনে বা এ বিষয়ে না ভেবে তাদের পাঠদান করাও একটি বড় সমস্যা তৈরি করছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিশু শিক্ষার্থীদের প্রতি শিক্ষকদের বৈরী আচরণ তাকে বিপদগামী করে ফেলতে পারে। বিষয়টি অনেক সংবেদনশীল, তাই এর যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রয়োজন এবং এর মধ্যে দিয়েই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব। আরেকটি কথাও বলে রাখা প্রয়োজন যে, এখন বোধ করি সময় এসেছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একজন মনোবিজ্ঞানী নিয়োগ দেয়ার। কারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই একটি শিক্ষার্থী তার দিনের অনেকখানি সময় কাটায়। সুতরাং তার আচরণের অনেকটাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে পারে বলে একজন শিক্ষক হিসেবে আমি মনে করি।
শিক্ষার্থী বা নিজ সন্তানদের সাথে বন্ধুত্বের বন্ধন গড়ে তোলার বিষয়টি আগেও বলেছি। পরিবারের উচিৎ সন্তানদের মধ্যে জীবনের প্রতি মমত্ববোধ সৃষ্টি করা। ব্যস্ততা কমিয়ে সন্তানকে সময় দেয়া। তার বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ রাখা। বাড়িতে ডাকা। অনেক পরিবারই ভেবে থাকেন, সন্তানদের বন্ধুরা কেনো বাড়িতে আসবে। এটি ভুল ধারণা। কারণ সন্তানের বন্ধুদের সঙ্গে চেনা-পরিচয়ের মাধ্যমেই আপনি কিন্তু নিশ্চিত হতে পারবেন, আপনার সন্তান কাদের সঙ্গে মিশছে।
শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে বহুদিন ধরেই আলোচনা চলছে বিভিন্ন মহলে। সারাদেশে একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা যে কতোটা প্রয়োজন, তা আবারও প্রমাণিত হলো সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে। শিক্ষার ক্ষেত্রে শ্রেণি-বৈষম্যের চিন্তা যতকাল থাকবে, ততদিন আমাদের সমাজ থেকে অন্ধকার দূর করা সম্ভব নয়। শিক্ষা হতে হবে মানবিক, যা মানুষকে শ্রদ্ধা করতে শিখায়। একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে দেশের সকল ক্ষেত্রে শিক্ষার একটি সুসামঞ্জস্যতা বিরাজ করানো সম্ভব। অন্যদিকে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা আছে জানলে যে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের রেজিস্ট্রশেন বাতিল করা উচিৎ। যেমন: সারাদেশে অধুনা প্রতিষ্ঠিত পিস স্কুল এন্ড কলেজ অবিলম্বে বন্ধ করা প্রয়োজন।
আমরা একটি ঘোর অমানিশার মধ্যে ডুবে আছি। হাজার বছরের বাঙালি ঐতিহ্যকে কেন্দ্রে রেখে একটি উদার মানবতাবোধসম্পন্ন প্রজন্ম তৈরি করাই এখন জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদের নৃশংসতা মোকাবেলার একমাত্র উপায়। বাংলাদেশকে জঙ্গি রাষ্ট্র ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসাবে চিহ্নিত করার প্রচেষ্টা চলছে। চলছে নানা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। এ অপচেষ্টাকে রুখতে হলে জঙ্গিবাদকে সমূলে নির্মুল করতে হবে এ মাটি থেকে। আমাদের প্রত্যয় হোক আমাদের সংগ্রামের অনুপ্রেরণা। জয় বাংলা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)