চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

‘এত কিছু’র পরও তিন খাদ্য কর্মকর্তাকে শুধু বদলি

ভৈরবে খাদ্য গুদামে দুর্নীতি

তারা কিশোরগঞ্জের ভৈরবের খাদ্য গুদামে নানা দুর্নীতিতে জড়িত ছিলেন। এমনকি খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে ‘থোড়াই কেয়ার করে’ তারই সিলগালা করা গুদাম খোলার দুঃসাহস দেখিয়ে গ্রেপ্তার হওয়া জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ তানভীর হোসেনসহ দুই কর্মকর্তাকে শুধু শাস্তিমূলক বদলি করে বরিশাল বিভাগে পাঠানো হয়েছে।

অন্য দু্ই কর্মকর্তা হলেন, ভৈরব খাদ্য পরিদর্শক (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) মুহাম্মদ কামরুল হাসান ও উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. শরীফ মোল্লা।

সোমবার রাষ্ট্রপতির আদেশে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সংস্থা প্রশাসন বিভাগের উপ-সচিব ড. শেখ নুরুল আলমের স্বাক্ষরিত চিঠিতে জানানো হয়, মোহাম্মদ তানভীর হোসেনকে কিশোরগঞ্জ থেকে ঝালকাঠির জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক হিসেবে বদলি করা হয়েছে।

এছাড়াও গত রোববার প্রশাসন বিভাগের সংস্থাপন শাখার উপ-পরিচালক (সংস্থাপন) মামুন আল মোর্শেদ চৌধুরী স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, মুহাম্মদ কামরুল হাসানকে প্রশাসনিক কারণে আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক বরিশাল-এর অধীনে ন্যস্ত করা হলো।

একই দিনে মামুন আল মোর্শেদ চৌধুরী স্বাক্ষরিত আরেকটি চিঠিতে বলা হয় মো. শরীফ মোল্লাকে উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক হিসেবে বরগুনার পাথরঘাটায় বদলি করা হলো।

জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের বদলির চিঠি

তাদের বিরুদ্ধে সর্বশেষ অভিযোগ, করোনা ভাইরাসের পরিস্থিতিতে বড় ধরনের দুর্নীতির মাধ্যমে গুদাম থেকে চাল সরিয়ে ফেলেছেন ।

খাদ্য অধিদপ্তরের অবসরপ্রাপ্ত ও চাকরিরত কয়েকজন কর্মকর্তা চ্যানেল আই অনলাইনকে নিশ্চিত করেছেন, তাদের অধিদপ্তরে কোনো অনিয়ম, দুর্নীতিতে কারো নাম আসলে তাকে শাস্তিমূলক বদলি হিসেবে বরিশাল বিভাগে পাঠানো হয়।

তানভীরের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
২০১৫ সালে মুহাম্মদ তানভীর হোসেন কক্সবাজারের জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক থাকাকালীন সময়ে তার যোগসাজশে খাদ্যশস্য নীতিমালা লঙ্ঘন করে বগুড়া, ময়মনসিংহ, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় চালের মোকাম থেকে প্রতি কেজি ২০ থেকে ২১ টাকা দামের নিম্নমানের চাল কিনে তা ৩১ টাকায় দামে রামু খাদ্য গুদামে সরবরাহ কর হয়।

এছাড়াও তিনি সাড়ে আট কোটি টাকার দুর্নীতি সঙ্গে জড়িত ছিলেন। যা কিনা ওই সময়ে বিভিন্ন প্রথম সারির গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়।


                       মুহাম্মদ কামরুল হাসান ও  মো. শরীফ মোল্লার বদলির চিঠি

কিশোরগঞ্জের চারটি এলাকা অষ্টগ্রাম, মিঠামইন, ইটরা ও নিকলী খাদ্য গুদামের যাবতীয় মালামাল ভৈরব এলএসডি থেকে নৌপথে পরিবাহিত হয়। ভৈরব এলএসডির বিভিন্ন মৌসুমে প্রাপ্ত বরাদ্দের চাল হাওর এলাকার বিভিন্ন খাতের ডিও দিয়ে সমন্বয় করা হয়। আর এ সকল অনিয়ম উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক শরীফ মোল্লা সরাসরি জড়িত।

জানা যায়, ভৈরব উপজেলায় অটো/ সেমি অটো/ হাস্কিংসহ কাগজে-কলমে রয়েছে প্রায় ১৭টি মিল। কিন্তু বাস্তবে দুই থেকে তিনটি মিল ছাড়া আর কোনো রাইস মিলের অস্তিত্ব নেই।

বছরের পর বছর ধরে ধান-চাল ক্রয়ের নামে একটি সিন্ডিকেট নানা অনিয়মের মাধ্যমে সরকারি খাদ্য গুদাম থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এই সিন্ডিকেটের একজন প্রভাবশালী গুদামের শ্রম, সড়ক ও নৌ পথের মালামাল পরিবহনের ঠিকাদার মাম অটো রাইচ মিলের মালিক মো. ফারদুল্লাহ। বাস্তবে মিলের কোনো অস্তিত্ব নেই, কিন্তু কাগজে আছে। এমন মিলের নামে চাল কিনেন তিনি।

ঠিকাদার মো. ফারদুল্লাহর কিশোরগঞ্জ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ তানভীর হোসেন

পরে আশুগঞ্জ থেকে নিম্নমানের চাল কিনে গুদামের সাথে লাগোয়া তার নিজের মিল থেকে বস্তায় এসব চাল ভরে গুদামে সরবরাহ করছেন। একই সঙ্গে বোরো এবং আমন ধান ক্রয়েও রয়েছে তার আধিপত্য। তার অনুমতি ছাড়া এক কেজি ধানও সংগ্রহ বা কিনতে পারে না কর্তৃপক্ষ।

ফলে বছরের পর বছর ধরে উপজেলার শত শত প্রান্তিক কৃষকরা বঞ্চিত হচ্ছেন। তাছাড়া উপজেলা ও জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকদের মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে ব্যবস্থা করায় তার এসব অনিয়ম চাপা পড়ছে। এমনকি গুদাম কর্মকতাকে ডিঙিয়ে নথিপত্র নিয়ে ঠিকাদার নিজেই বিভিন্ন অফিসে দৌড়ঝাপ করেন। শুধু তাই নয়, খাদ্য অধিদপ্তরের লোকজনের সাথেও ঠিকাদার ফারদুল্লাহর রয়েছে যোগাযোগ ও সখ্যতা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মা অটো রাইস মিলের মালিক আব্দুল্লাহ আল মামুনের রাইস মিল বন্ধ, কিন্তু জেলা নিয়ন্ত্রকদের নানান সুবিধা দিয়ে বরাদ্দ নেয়। বরাদ্দ নিয়ে জোর পূর্বক গুদামে খারাপ চাল ঢুকানোর চেষ্টা করে থাকেন।

খাদ্য অধিদপ্তরের মহা-পরিচালক সারোয়ার মাহমুদ

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে খাদ্য অধিদপ্তরের মহা-পরিচালক (ডিজি) সারোয়ার মাহমুদ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, বিষয়টি মামলা হয়েছে, বেশকিছু বিষয় কোর্টের এখতিয়ারে চলে যাবে। কোর্টের বাইরে প্রশাসনিক ভাবে বিষয়টি আমরা দেখব এবং আমাদের তদন্ত প্রক্রিয়াধীন রয়েছে, তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে।

তিনি বলেন, ভৈরবের খাদ্য গুদামের অবস্থা একটু অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল, আমরা চাই সেখানে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসুক। এরমধ্যে কেউ যদি অন্যায় করে থাকে তাহলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা হবে।

ভৈরব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ শাহীন বলেন, সরকারের বিশ্বাস ভঙ্গ এবং সিলগালা করা গুদামের তালা ভেঙ্গে নয়ছয়ের দায়ে গুদাম কর্মকর্তা ও ঠিকাদারসহ ১২জনকে আসামি করে দুদকসহ পৃথক দু’টি মামলা দায়ের করেছে খাদ্য অধিদপ্তর। আটক হওয়া গুদাম কর্মকর্তা ও ঠিকাদারসহ ১২ জনকেই সোমবার সকালে কিশোরগঞ্জ কারাগারে পাঠানো হয়েছে।