চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

এখানে ছবি তার প্রোডাক্ট ভ্যালুর বাইরে শিল্পকর্ম হয়ে ওঠেনি: কামার

‘যে কারণেই হোক টেলিভিশন নাটক আর বিজ্ঞাপনে কয়েকটা প্রজন্ম হারিয়ে গেছে, যাচ্ছে। যাদের হয়তো সিনেমা বানানোরই কথা ছিল’

কামার আহমাদ সাইমন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যে ক’জন নির্মাতা নিজেদের কাজের মাধ্যমে সুপরিচিত তাদের মধ্যে অন্যতম তিনি। বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার এবং ফান্ড বাংলাদেশের নির্মাতাদের মধ্যে তিনিই প্রথম অর্জন করেছেন। কামার আহমাদ সাইমন তার অন্যতম আলোচিত চলচ্চিত্র ‘শুনতে কি পাও!’ এর জন্য ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত ইউরোপের প্রামাণ্য উৎসব ‘সিনেমা দ্যু রিলে’ সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘গ্রাঁপি’ এবং মুম্বাই আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘স্বর্ণশঙ্খ’ অর্জন করেছিলেন। এটি শ্রেষ্ঠ নন-ফিকশন-এর জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও অর্জন করে। এর কয়েকটি প্রদর্শনী বাংলাদেশে হয়েছে, সামনে ‘শুনতে কি পাও!’ কাউন্টার ফটো স্টুডেন্ট ফোরাম এবং উই আওয়ার্স সিনেমা’র যৌথ আয়োজনে ৭ ডিসেম্বর প্রদর্শিত হবে রাজধানীর উত্তরায়।

‘শুনতে কি পাও!’-এর পর কামার আহমাদ সাইমনের ওয়াটার ট্রিলজির ২য় ছবি ‘অন্যদিন’ লোকার্নো চলচ্চিত্র উৎসবে পিয়াতজা গ্রান্দায় ওপেন ডোর্স শ্রেষ্ঠ পুরষ্কার, আর্তে ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ জিতে নেয়। কানে শুধুমাত্র আমন্ত্রিতদের জন্য সংরক্ষিত প্রোগ্রাম এতেলিয়ারে, সেখানে আমন্ত্রিতদের মধ্যে অংশ নেন সাইমন।

‘শুনতে কি পাও!’ ও ‘অন্যদিন’ ছাড়াও কামার আহমাদ সাইমনের চলচ্চিত্র শিকলবাহা বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসব এ ওয়ার্ল্ড সিনেমা ফান্ড (ডব্লিও সি এফ ) পায়। ২০১৪ সালের ৬৭তম কান উৎসবে উদীয়মান নির্মাতাদের জন্য বিশেষ আয়োজন ‘লা ফ্যাব্রিক দ্য সিনেমা দ্যু মন্দ ২০১৪’-তে আমন্ত্রিত ১০টি চিত্রনাট্যের মধ্যে অন্যতম ছিল এ নির্মাতার চিত্রনাট্য ‘শঙ্খধ্বনি’ (শিকলবাহা)। এর আগে সুইডেনের গোটেনবার্গ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে চিত্রনাট্যের জন্য প্রতিযোগিতামূলক অনুদান পুরস্কার অর্জন করে শিকলবাহা। নয় মাসব্যাপী ইউরোপের ৩টি দেশে অনুষ্ঠিত ‘ইউরোপীয় প্রযোজক কর্মশালা ২০১২’-তে আমন্ত্রিত ২৪টি চিত্রনাট্যের মধ্যে একমাত্র নন-ইউরোপীয় চিত্রনাট্য ছিল এটি। এ ছাড়া ‘ইউরোপীয় পোস্ট প্রোডাকশন কানেকশন ২০১৩’ এবং ফ্রান্সের নন্তে অনুষ্ঠিত ‘ত্রি-মহাদেশীয় চলচ্চিত্র উৎসব ২০১৩’-এর কো-প্রোডাকশন কর্মশালা ‘প্রদিউর অ সুদ’-এও আমন্ত্রিত হয় ‘শিকলবাহা’।

সিনেমা-নির্মাণ-ভাবনা-বর্তমান কাজকর্ম নিয়ে চ্যানেল আই অনলাইনের সাথে আড্ডা হল এ নির্মাতার। তার কিছু অংশ রইলো পাঠকের জন্য…

বহুল আলোচিত ‘শুনতে কি পাও!’ ছবির পোস্টার

আপনার চলচ্চিত্রের শিরোনাম নিয়ে কথা শুরু করতে চাই। এই যে শিরোনামগুলো ‘শুনতে কি পাও!’, ‘একটি সুতার জবানবন্দী’, ‘শিকলবাহা’, ‘অন্যদিন’– এগুলো আগ্রহোদ্দীপক যে কারো কাছে। 
আমার প্রত্যেকটা ছবিরই একটা করে ক্লিক পয়েন্ট আছে। কিছু একটা আমাকে ক্লিক করে। ‘শিকলবাহা’র ক্ষেত্রেই ধরুণ, আমি একটা বন্ধুর ফোন কল পেলাম যে দেশের বাইরে থাকে, তার মায়ের মৃত্যুর খবর দিতে সে ফোন করেছিল। তখনই আমি ভেবেছিলাম, এখানে একটা ছবি আছে, এটা কিন্তু ‘শিকলবাহা’র প্রথম স্ক্রিপ্ট লেখার অনেক বছর আগের কথা!

‘একটি সুতার জবানবন্দী’র ক্ষেত্রে আমি একটা এক্সিভিশন দেখতে গেলাম যেখান থেকে এ চলচ্চিত্রের মূল প্লটের অনেক কিছুই খুঁজে পেলাম। ‘শুনতে কি পাও!’ এর সময় পত্রিকায় একটা ছবি দেখেছিলাম যা আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিলো, শিল্পী এস এম সুলতানের ক্যানভাস মনে হচ্ছিলো ছবিটাকে। তো প্রতিটা ছবিরই এরকম একটা করে ঘটনা আছে যেখান থেকে ছবির ভাবনাটা শুরু। ‘অন্যদিন…’এর প্লট আমার ছেলেবেলার একটা নস্টালজিক স্মৃতি থেকে নেয়া। তো ঐ ঘটনাগুলো ঘিরেই একটা করে নাম আসা শুরু হয়। যেমন ‘শিকলবাহা’র নাম কিন্তু আগে ছিল ‘শঙ্খধ্বনি’। আক্ষরিকভাবে এটা শঙ্খ থেকেই নামটা নিয়েছিলাম, শঙ্খের মধ্যে যে কালচারাল নুয়ান্স বা সাংস্কৃতিক উপাদান কিংবা মেটাফোর তাই কিন্তু এই স্ক্রিপ্টের মধ্যে ছিল। কিন্তু লেখাটা এগোতে এগোতে যেখানে গিয়ে শেষ করলাম, সেখানে গিয়ে দেখি একটা নদী, নাম তার ‘শিকলবাহা’। শুরুতে আমি কিন্তু ‘শিকলবাহা’ ধরে লিখিনি, আমি একটা টেলিফোন কলকে ধরে ‘শঙ্খধ্বনি’ শিরোনামেই কাজটা শুরু করেছিলাম। তো আমার সবার ভেতরে এই যে ছোট ছোট অসম্পাদিত অনালাপ, মানে আলাপের ভেতরে না তোলা আলাপ, লাইক দ্য সাইলেন্ট বিটস ইন ক্লাসিক্যাল মিউজিক… সেখান থেকেই আমার এক একটা ছবির নাম চলে আসে। এমন কিন্তু না যে খুব পরিকল্পনা করে নামগুলো নিয়ে আসি।

সিনেমায় গল্প বলার স্টাইল বা ধরণ নিয়ে যদি বলেন , আপনার একটা কথাই উদ্ধৃত করি, একবার এক আলোচনায় আপনি বলেছিলেন- আমি ‘শুনতে কি পাও!’ এ যেভাবে গল্প বলে গিয়েছি সেভাবে ‘একটি সুতার জবানবন্দী’তে বলতে পারিনি। তো এই যে পারা না-পারাগুলো, এটা কেন বা এ নিয়ে কী ভাবেন আপনি?
গল্প বলার স্টাইল-এর ক্ষেত্রে কি হয় সিনেমা একটা ভাষা হিসাবে আমাদের এখানে এখনো খুব অপরিনত একটা অবস্থায় রয়েছে। আপনি সাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রচুর কাজ দেখতে পাবেন, যেকোন একজন লেখক একেবারে নতুন লিখছেন তার লেখার মধ্যেও আপনি অনেকটা ম্যাচিউরিটি পাবেন…। ভাষাগত দিক থেকে বলছি আর কী, কিন্তু দুঃখজনকভাবে এই জিনিসটা আমাদের আলোচিত ভালো ছবিগুলোর ক্ষেত্রেও সাংঘাতিক দূর্বল। সাহিত্যে দেখুন তারাশঙ্কর বা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় উত্তর সময়ে শওকত আলী বা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের পর শহীদুল জহির, বা হালের শাহাদুজ্জামান, সুমন রহমানের লেখার মধ্যেও আপনি একটা নিরন্তর চলমান সময়ের ভাষা তৈরির একটা প্রক্রিয়া লক্ষ্য করবেন। সাহিত্যের এই যে ভাষা নিয়ে কাজ এটা কিন্তু হুট করে চলে আসেনি, আবার কেউ কারও থেকে বিচ্ছিন্নও না। এটা একটা ইভোলোশনারি প্রসেস, যেটা আমাদের লেখকদের হাত ধরে সাহিত্যে ভাষার ক্ষেত্রে হয়েছে, কিন্তু আমাদের চলচ্চিত্রে এই নিরন্তর ভাষা তৈরির চেষ্টাটা মিসিং বলে অন্তত আমার কাছে মনে হয়…। ‘মাটির ময়না’ বা ‘চাকা’র মতো দুই একটা এক্সসেপশন ছাড়া। ইদানীং আমরা যদিওবা চলচ্চিত্র নিয়ে অনেক কথা বলি, শুনি… পুরস্কার-ফেস্টিভ্যাল-ফান্ড-ফিল্ম বাজার, কিন্তু আমাদের চলচ্চিত্রের এই মৌলিক শুন্যতা নিয়ে কোথাও কোন আলাপ নাই!

সিনেমার ভাষা আমার কাজকে কীভাবে প্রভাবিত করে তা নিয়ে একটা ঘটনা শেয়ার করি, যখন আমি প্রথম ‘শুনতে কি পাও!’ শুরু করছি তখন আমার মাথায় প্রথমে ছিলো একটা প্রামাণ্যচলচ্চিত্র। অথচ যখন কাজ শুরু করছি তখন আমি ভাবলাম– না এটা তো একটা ফিকশন, লোকেশন, কাস্টিং, স্ক্রিপ্টিং পুরাটা করেছি ফিকশন স্টাইলে। তারপর আমি শুটিং-এর রাশ নিয়ে যখন বসলাম তখন দেখি না এটা প্রামাণ্যচলচ্চিত্র না এটা ফিকশন। এডিটের মাঝ পর্যায়ে আবার প্যাচ শুটিং করতে গিয়েছি, ফিরে এসে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে এটা ফিকশন- নন ফিকশনের মিড জঁরা হবে। এই যে ল্যাঙ্গুয়েজ নির্মাণ-বিনির্মানের প্রক্রিয়া, এইটা আমি দারুণ উপভোগ করি।

আর ‘একটি সুতার জবানবন্দী’র ক্ষেত্রে আমি স্ক্রিপ্ট যেভাবে করলাম কাজ করতে গিয়ে দেখি এটা কিছুতেই সেভাবে শুটিং করা যাচ্ছে না। যে কারণে এই ছবির প্রস্তাবনায় আমি সবসময় এটাকে মনোলোগ বলি, অনেকটা কোলাজের মতো। এখন যখন ‘অন্যদিন’-এর শুটিং এর প্রায় শেষের দিকে তখন দেখছি এটা একেবারেই ভিন্ন এক ভাষা, অন্তত আমার অন্য ছবিগুলোর চেয়ে। তো সিনেমাকে এই যে ল্যাঙ্গুয়েজ বা ভাষা হিসাবে ট্রিট করার ব্যাপারটা, এইটা আমাদের পোস্ট-৭১ জেনারেশনের মধ্যে একেবারেই মিসিং থেকে যাচ্ছে!

আর চলতি আলাপে মানে পপুলার ন্যারাটিভে ছবিকে এখনো বেশিরভাগ সময় এপ্রোচ করা হয় একটা গল্প মাথায় রেখে। ভাষার মধ্যে শিল্পীর যে প্রাণ প্রতিষ্ঠার ব্যাপার আছে তা নিয়ে এখানে আমাদের নির্মাতাদের ভাবনাটা নাই বললেই চলে।

২০১২ সালে জার্মানিতে নির্মাতা কামার আহমাদ সাইমন ও প্রযোজক সারা আফরীন

প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা বেশি বলেও কি মনে হয়?
একজন নির্মাতা হিসাবে প্রামাণ্য চলচ্চিত্র এই শব্দটাই খুব ঝামেলার লাগে। কোনটা প্রামাণ্য কোনটা ফিকশন এই জঁরা ঠিক করা নির্মাতার কাজ না, সমালোচকের কাজ!

না না আমি বলছি কেন, দেখুন এর আগে একসময় সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রামাণ্য চলচ্চিত্র না দেখার একটা প্রবণতা ছিল, তা কিন্তু আজ একটু একটু কমছে। ‘শুনতে কি পাও!’ বা ‘হাসিনা: অ্যা ডটার’স টেল’ এর মতো প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী হাউস ফুল হচ্ছে। সেটা কি ভাষা চেঞ্জের জন্য না কি অন্য কোন কারণে মনে হয়?
ভাষা চেঞ্জের কারণে বলে আমার মনে হয় না। ‘শুনতে কি পাও!’ প্রথমে হাউজ ফুল চলেছে এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আর পুরষ্কারের জন্য, পরে দর্শক এসেছে ছবির আবেদনে, অন্যের কাছ থেকে শুনে। এখন ‘ডটার্স টেল’ হাউজ ফুল যাচ্ছে এর ঐতিহাসিক কারণে, এর কেন্দ্রীয় চরিত্র মানে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ব্যাপারে মানুষের ভালোবাসা আর উৎসাহের কারণে। তারপরও হাউজ-ফুল দর্শক আসার ব্যাপারটা নিয়ে বলতে পারি লোকে ভিন্ন স্বাদের ছবি দেখছে, তার মানে ‘লোকের’ ক্ষুধা আছে।

ভাষার জায়গাটা আমার অবজারভেশনে চলচ্চিত্রে আমাদের প্রজন্ম মিসই করে গেছে। যে কারণেই হোক টেলিভিশন নাটক আর বিজ্ঞাপনে কয়েকটা প্রজন্ম হারিয়ে গেছে, যাচ্ছে যাদের হয়তো সিনেমা বানানোরই কথা ছিল। আর ভাষা পরিবর্তনের জন্য তো আসলে কয়েকটা ওয়েভ প্রয়োজন। একটা ‘মাটির ময়না’ বা ‘শুনতে কি পাও!’ বাংলা সিনেমার ভাষা পরিবর্তন করতে করতে পারবে না… পরিবর্তন আসতো যদি এর পরে আরও দু’জন অন্য আরও দুটো কাজ করতো, তাহলেই বোঝা যেত যে আমাদের চলচ্চিত্রের নতুন কোন ভাষা তৈরি হচ্ছে কী না! আবার দর্শককে আমরা সেজন্য তৈরি করছি কী না সেটাও ভাববার বিষয়। আমাদের এখানে চলচ্চিত্র নিয়ে মোস্ট পপুলার তিনটা প্রশ্ন হলো – কত টাকার ছবি, কয়টা হলে রিলিজ হয়েছে আর কয় টাকা মুনাফা করেছে। এটা বলিউডের একটা প্রত্যক্ষ প্রভাব, এটা এখন আমাদের জনসংস্কৃতিতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। ছবি তার প্রোডাক্ট ভ্যালু’র বাইরে শিল্পকর্ম হয়ে ওঠেনি এখানে এখনো। এখন এই অবস্থায় কী করে ভাষা নিয়ে দর্শকের ভাবনার বিস্তার সম্ভব বলুন। সিনেমার এই সঙ্কট সারা দুনিয়ায়, এটা এর জেনেটিক্যাল ক্রাইসিস। হঠাৎ করে কেউ কিন্তু সাহিত্যকে বিচার করতে বসে না, কিন্তু চোখ আর কানওয়ালা যেকেউই সিনেমা নিয়ে যা খুশি তাই বলতে পারেন। আমাদের মঞ্চ নাটকেও দেখবেন এই সঙ্কট নাই, সিনেমায় যেটা আছে। আপনি দেখবেন ‘গ্যালিলিও’ দেখতে চাইলেই দেখতে পারছেন না। বিশ বছর পর মাত্র তিনখানা শো করলো নাগরিক নাট্যগোষ্টী, পাঁচশো-হাজার টাকার টিকেট, কিন্তু সেটাও অনেক-কাঠ-খড় পুড়িয়ে জোগাড় করতে হয়েছে সবাইকে। কিন্তু সিনেমা যেহেতু পপুলার মিডিয়াম, এক্সেসেবল বেশিরভাগের কাছে, প্রযুক্তির কারণেই হয়তো।

আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল স্ক্রিপ্ট-ডেভেলপমেন্ট। ‘শিকলবাহা’ সুইডেনের গোটেনবার্গ স্ক্রিপ্ট ডেভেলপমেণ্ট ফান্ড পেয়েছিল। প্রস্তুতিটা এই যে স্ক্রিপ্টিং পর্যায় থেকেই শুরু হচ্ছে, এ নিয়ে কতটা সচেতন যারা আসছেন চলচ্চিত্র নির্মাণে তারা?
অনেকেরই হয়তো জানা নাই, স্ক্রিপ্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড বা গ্র্যান্টস বা পুরস্কারও কিন্তু প্রাথমিক স্ক্রিপ্টের উপর নির্ভর করেই দেওয়া হয়, শত শত স্ক্রিপ্টের মধ্যে প্রতিযোগিতা করেই পেতে হচ্ছে। ‘শিকলবাহা’র স্ক্রিপ্টকে বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসব থেকে যে দু-দুবার ‘ওয়ার্ল্ড সিনেমা ফান্ড’ দেওয়া হয়েছে সেটা কিন্তু দেওয়া হয়েছে হাজার হাজার স্ক্রিপ্টের থেকে বাছাই করেই। কারণ সারা বিশ্বের তরুণ নির্মাতাদের কাছে বার্লিনের প্রাইজ মানি’র চাইতে ভ্যালু অনেক বেশি, বার্লিনালের একটা লোগো মানে বিশ্ব-চলচ্চিত্র দরবারে আপনার স্বীকৃতি। এক্ষেত্রে আমি আমার ব্যাকগ্রাউন্ডটা শেয়ার করতে পারি, তাতে যদি কারো উপকার হয়।

‘শিকলবাহা’র ক্লিক পয়েন্ট হিসাবে আমি যে ফোনকলের কথা বলেছিলাম সেটা ২০০৫ সালের ঘটনা, গোটেনবার্গের যে ডেভেলপমেন্ট ফান্ডের কথা বলছেন সেটা পেয়েছি ২০১১ সালে। ‘শিকলবাহা’র প্রথম স্ক্রিপ্টের উপর যার নাম তখন ছিলো ‘শঙ্খধ্বনি’। ২০১৪ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে উদীয়মান নির্মাতাদের আসর ‘ল্য ফ্যাব্রিক সিনেমা দ্যু মুন্দে’ নির্বাচিত হয়েছিলো মাত্র ১০টা স্ক্রিপ্টের মধ্যে, আর সেটা ছিলো এর ৩য় বা ৪র্থ স্ক্রিপ্ট। আর বার্লিনালে ২০১৬ সালে এর ৫ম ড্রাফটে এবং ২০১৭ সালে এর ৬ষ্ঠ ড্রাফটে ‘ওয়ার্ল্ড সিনেমা ফান্ড’-এর জন্য নির্বাচিত করেছিলো। শেষ ড্রাফটা লিখেছি এই বছর অক্টোবরে, সাত নম্বর স্ক্রিপ্ট এটা। আর এই ড্রাফটা লেখার পর এই প্রথম আমার মনে হচ্ছে আমি প্রস্তুত। আমার সমস্যা হল ধ্যানে-জ্ঞানে আমি যতক্ষণ না স্ক্রিপ্টটা নিয়ে একটা জায়গায় পৌঁছাবো, ততক্ষণ পর্যন্ত সেটার চূড়ান্ত রূপ আমি দিতে পারি না বা দেই না। আমাদের তরুণদের মধ্যে এখন একটা উৎসাহ বা উত্তেজনা কাজ করছে ফান্ড-গ্র্যান্টস নিয়ে এটা ইতিবাচক, তবে এর উল্টোদিকটাও জানা উচিত। এটা জানা উচিৎ তাদের যে হঠাৎ করে কিছু হয়ে যায় না, এর পেছনে দীর্ঘ পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির ব্যাপার আছে। সমস্যাটা হলো সোশ্যাল মিডিয়ার বাড়-বাড়ন্তে কিছু ভুলভাল উত্তেজনা ছড়ানোর ব্যাপারও ঘটছে ইদানিং যা অনেককেই বিভ্রান্ত করছে। পৃথিবীর কোন সত্যিকারের নির্মাতা, প্রথম সারির নির্মাতা ফেইসবুক নিয়ে মাথা ঘামায় না। তারা ছবিটা ঠিকঠাক বানায়। যেকোন ক্ষেত্রেই কাজের চেয়ে উত্তেজনা বেশি তৈরি হওয়াটা নেতিবাচক, খাজনার চাইতে বাজনা বেশি না করাই ভালো।

সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশে চলচ্চিত্রের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যাপারে আপনার কী মনে হয়?
শিক্ষা, যেকোনো সাধন-ভজনই দুরকমের। গুরুমুখী নয়তো প্রাতিষ্ঠানিক। এখন যে পথেই যে কেউ যাক না কেন সাধনের ক্ষেত্রে ১০-১২ বছরের এই যে সময় তা কিন্তু তাকে অতিক্রম করতে হবে, সেটা তার নিজের প্রয়োজনেই। মূল কথা হল- কী বানাতে চাই এবং কেন বানাতে চাই সেটা তার জানতে হবে। নিজের সাথে নিজের সহবাস- এটা খুব জরুরী। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এক্ষেত্রে ফেসিলিটেট করতে পারে মাত্র… কিন্তু এই যাত্রাটা একান্ত নিজের। আমরা সবক্ষেত্রে ভারতের রেফারেন্স দেই, তাই ভারত থেকেই একটা উদাহরণ দেই। দেখবেন এতো বড় একটা দেশে সম্ভবত মাত্র দুইটা সরকারি ‘এফ টি আই’ আছে। সেখানে ভর্তি হতে প্রতিযোগিতাটাও তাই ভীষণ কঠিন, তার উপর গ্র্যাজুয়েশন ছাড়া আপনি এপ্লাই করতে পারবেন না। তারমানে সেখানে ভর্তি হওয়ার আগেই আপনি কোন একটা বিষয়ে স্নাতক পাশ করে আসতে হবে… তারপর এফ টি আইয়ে তিন বছরের কোর্স! সেটা পাশ করার পর ন্যুনতম ৪/৫ বছরের বা তারও বেশি শিক্ষানবিশি… তারমানে যাত্রাটা ১০/১৫ বছরের নিচে না। সেই বিচারে, আমাদের এখানে কিছু কোর্স হচ্ছে বটে কিন্তু সেটা বিশ্ব-চলচ্চিত্র অঙ্গনে প্রতিযোগিতার জন্য কতটুকু শক্ত খেলোয়ার তৈরি করতে পারবে সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত না।

চলচ্চিত্রে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নানান আয়োজনে এখন অনেক ফিল্ম-মেকাররা যাচ্ছেন। ল্যাব-হাব-পিচিং বা ফিল্ম-বাজার বা বিভিন্ন ধরণের ফিল্ম ডিস্ট্রিবিউশন প্রক্রিয়ার ব্যাপারগুলোর সাথে আমাদের সংযোগ ঘটছে। এসব নিয়ে কী মনে হয়?
এখন যেটা হয়েছে আমাদের এখানে ফিল্ম প্রফেশনাল তৈরির প্রাক-প্রক্রিয়া মাত্র শুরু হচ্ছে। কিন্তু একটা জিনিস খুব স্পষ্টভাবে মাথায় রাখা দরকার, একজন পরিচালকের কাজ কিন্তু বাজার নিয়ে ভাবা না। এখন পরিচালক যখন কী বানাতে চাই, কেন বানাতে চাই জানবে তখন সে প্রযোজককে সেটা জানাবে, প্রযোজক ভেবে দেখবে সেই চলচ্চিত্রকে কী করে কোথায় কোন কোন দর্শকের কাছে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। আর ফিল্ম বাজারে আমি বা সারা (প্রযোজক সারা আফরীন) তো আজ থেকে না, অনেকদিন আগে থেকেই যাচ্ছি। আমারতো মনে হয় এসমস্তই আপনার ফিল্ম নির্মাণের একান্ত নিজস্ব একটা প্রস্তুতিপর্ব। যখন প্রাপ্তি আসবে, তখনই সেগুলোর যথার্থতা, এর আগে না।

‘ওয়াটার ট্রিলজি’ নিয়ে বিস্তারিত বলুন। এর একটা তো ‘শুনতে কি পাও!’ তাইনা?
‘শুনতে কি পাও!’ শেষ করার পরে এই ভাবনাটা আমার মাথায় আসে। সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা আমাদের এই দেশটাকে প্রথমে কিন্তু আমরা বলি ‘সুজলা’… তাই আমাদের এই ব-দ্বীপের গল্প আসলে জলকে ছাড়া হয় না। তো ‘শুনতে কি পাও!’ বানাতে গিয়ে নিজের ভেতর অদ্ভুত এক পরিবর্তন লক্ষ্য করি, সেই জায়গাটা, মানুষগুলো ভীষণভাবে তাড়িত করে আমাকে।

এরপর ‘শুনতে কি পাও!’, ‘অন্যদিন’, ‘আরও কিছু জীবন’ – এ তিনটা শিরোনামে জল-ত্রয়ী বা ‘ওয়াটার ট্রিলজি’র পরিকল্পনা করি। একটার কাজ শেষ হল, আরেকটা চলমান, আরেকটা ধরা হয়নি এখনো। এর মধ্যে ‘শুনতে কি পাও!’-কে ফিকশন-নন-ফিকশন ফরম্যাটে করেছি। ২য়টা মানে ‘অন্যদিন’ ফিকশন নন-ফিকশন কোন ধাঁচেই ফেলছি না, শ্যুটিং আপাতত নিরীক্ষাধর্মী পর্যায়ে আছে। এখনই বিস্তারিত আর কিছু বলতে চাইছি না। ছয় বছর পর পর একটা ছবি বানাবো, এরকম একটা ভাবনা আছে। যেমন ধরেন সেই যে রিচার্ড লিংকলেটার-এর বিফোর ট্রিলজি আছে না! সময় একটা ভীষণ ব্যাপার। সময় অনেক কথা বলে! আমি চুপ থাকতে পছন্দ করি খানিকটা। মজার ব্যাপার হলো আমরা কিন্তু ‘শিকলবাহা’ আর ‘অন্যদিন’-এর বাইরেও অন্য এক সৃষ্টির অপেক্ষায় আছি। যে কথা এখনো কোথাও বলা হয়নি, এখন এই মুহূর্তে বলতেও চাই না।